চীনের পিপল’স লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) বিপুল সংখ্যক সদস্য চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) পেরিয়ে ভারতের বেশ কিছু অংশ দখলে নিয়েছে। লাদাখে চীনা বাহিনীর অনুপ্রবেশ নিয়ে প্রায় দুই সপ্তাহ লুকোচুরির পর প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংকে উদ্ধৃত করে মঙ্গলবার সংবাদমাধ্যম সিএনএন-নিউজ ১৮ এ তথ্য জানায়। সংবাদমাধ্যমটি এ বিষয়ে রাজনাথ সিংয়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল।
সেখানে রাজনাথ বলেন, ‘বেশকিছু চীনা নাগরিক ওই এলাকায় ঢুকে পড়েছে। চীন ওই এলাকাকে নিজেদের বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ভারতীয় ভূখণ্ড।
তবে, এই সাক্ষাৎকার প্রকাশের পরই মোদি সরকার এটিকে ফেক নিউজ বলে দাবি করছে।
যদিও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংকে ওই সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার বলতে শোনা গেছে “বেশ বড় সংখ্যায় চীনের সৈন্যরা কিন্তু এসে গেছে”, তার পরও সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেল তাদের খবরটি আজ প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
এদিকে ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত অচলাবস্থা নিয়ে শনিবার ৬ জুন সামরিক পর্যায়ে দুপক্ষের মধ্যে বৈঠক হতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
পাশাপাশি চীন সীমান্তবর্তী লাদাখের বাসিন্দারা চলমান পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত করছেন।
বস্তুত গত প্রায় মাসখানেক ধরেই ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম রিপোর্ট করছে, ভারত ও চীনের মধ্যে যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বা এলএসি রয়েছে সেটা পেরিয়ে এসে লাদাখের অন্তত তিনটি জায়গায় চীনা সৈন্যরা অবস্থান নিয়েছে।
কিন্তু এখবরের সত্যতা নিশ্চিত করে বা অস্বীকার করে দিল্লিতে প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সরকারের পক্ষ থেকে এতদিন প্রকাশ্যে একটিও শব্দ বলা হয়নি।
সেই নীরবতা ভেঙে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং গত রাতে ভারতের নিউজ-১৮ চ্যানেলকে একটি সাক্ষাৎকার দেন।
ঠিক কী বলেছিলেন রাজনাথ সিং?
সেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, “সম্প্রতি যেটা ঘটেছে, হ্যাঁ এ কথা সত্যি যে সীমান্তে এখন চীনের সৈন্যরা … ওদের দাবি হল যে ওদের সীমান্ত নাকি এই পর্যন্ত, আর আমরা বলছি যে না, আমাদের সীমানা ওই পর্যন্ত – এটাকে কেন্দ্র করে একটা মতভেদ তৈরি হয়েছে।”
“আর প্রচুর সংখ্যায় চীনের লোকজনও এখন এসে পড়েছে, তবে এর জবাবে ভারতের যেটা করা উচিত সেটাও কিন্তু ভারত করেছে।”
এই সাক্ষাৎকার প্রচারিত হওয়ার একটু পরেই ভারতের নামী প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ অজয় শুক্লা টুইট করেন, অবশেষে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং প্রকাশ্যে স্বীকার করলেন যে বিপুল সংখ্যক চীনা সৈন্য সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের দিকে ঢুকে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলটিও এই শিরোনামে খবর করে, “বড় সংখ্যায় চীনা সৈন্যরা পূর্ব লাদাখে ঢুকে পড়েছে”।
কিন্তু এর পরই দিল্লিতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের টুইটার হ্যান্ডল থেকে অজয় শুক্লার বক্তব্যকে ফেক নিউজ বলে দাবি করা হয়।
এদিন সকালে ওই চ্যানেলটিও ভুল স্বীকার করে তাদের খবর প্রত্যাহার করে নেয়, তারা জানায় যে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পূর্ব লাদাখের কথা কখনও উল্লেখই করেননি।
যুদ্ধের আতঙ্ক লাদাখে
সরকারের তরফ থেকে এভাবে তড়িঘড়ি ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামা হলেও লাদাখে পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ কিন্তু চাপা দেওয়া যাচ্ছে না।
লাদাখের বাসিন্দা ও এনজিও কর্মী স্ট্যানজিন কুনজাং সংবাদ সংস্থাকে বলছিলেন, “একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তিনি উদ্বিগ্ন ও বিচলিত – সীমান্তে যা ঘটছে তা ভেবে আমি রাতে ঘুমোতে পারছি না।”
আর এক তরুণী ফারিহা ইউসুফ বলছেন, “আতঙ্ক তো আছেই – কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে আমরা কিছুই জানতে পারছি না। কী হচ্ছে না হচ্ছে, তা তাদের স্পষ্ট করে করে বলা উচিত।”
বস্তুত চীন-ভারত যুদ্ধের সম্ভাবনা যে লাদাখের মানুষকে রীতিমতো আতঙ্কিত করে তুলেছে সেটাও এখন আর গোপন নেই।
থানীয় বাসিন্দা আসমা ইউসুফের কথায়, “যুদ্ধ হওয়া উচিত নয় – দুদেশের কূটনীতিকদের প্রথমে নিজেদের মধ্যে কথা বলে সঙ্কট সমাধানের চেষ্টা করা দরকার।”
“যুদ্ধ সত্যিই হলে দুদেশের মানুষের, লাদাখের লোকজনকে ভীষণ ভুগতে হবে – আর কোভিড-সঙ্কটের মধ্যে সেটা হবে বিরাট বিপর্যয়”, সতর্ক করে দিচ্ছেন তিনি।
পরিবেশকর্মী ডেচেনও এটা দেখে বিস্মিত যে দুদেশের নেতারাই বলছেন তারা যুদ্ধ চান না – তারপরও হাজার হাজার সৈন্য রোজ সীমান্তে পাঠানো হচ্ছে। “যুদ্ধ নয়, আলোচনাই একমাত্র পথ” বলে তার বক্তব্য।
আগামী শনিবার ৬ জুন, ভারত ও চীনের মধ্যে সামরিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ে সেই বহুপ্রতীক্ষিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং নিজেই ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আর সম্ভবত সেই আলোচনার রাস্তা মসৃণ করতেই “চীনা সৈন্যরা এসে গেছে” – এ কথা প্রকাশ্যে বলার পরও তাকে সেই মন্তব্য এখন হজম করে নিতে হল। বিবিসি অবলম্বনে।