লোকসানের বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া পাটকলেও অর্থ বরাদ্দ

মত ও পথ প্রতিবেদক

পাটকল
পাটকল। ফাইল ছবি

বেসরকারি খাতের পাটকলগুলো লাভ করলেও নানা অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতিতে বছরের পর বছর লোকসান গুনছে সরকারি পাটকলগুলো। লোকসান কাটিয়ে মিলগুলো চালু রাখতে প্রতি বছরই জনগণের করের টাকা দিয়ে আসছে সরকার। এবারও বাজেটে পাটকলগুলোর জন্য বরাদ্দ থাকছে দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

লোকসানে থাকা পাটকলগুলোর অর্থায়নের বিষয়ে গত বছরের ১৪ মে সচিবালয়ে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোকে গত ১০ বছরে সাত হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। পাটকলে আর কতদিন অর্থায়ন করব? গত ১০ বছরে তো আমরা সাত হাজার কোটি টাকা দিয়েছি। এটা অনেক বড় টাকা।’

এরপরও আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে আড়াই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। যেখানে করোনাভাইরাসের কারণে খরচের চাপ বাড়ার পাশাপশি রাজস্ব আয় কমার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সেখানে এ খাতে বিপুল অংকের অর্থ বরাদ্দ রাখায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এভাবে বছরের পর বছর জনগণের করের টাকায় পাটকলগুলো টিকিয়ে রাখার বিপক্ষে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। পাটকলগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ তাদের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লোকসানের বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের পাটকলগুলো। অনেক আশা নিয়ে বর্তমান সরকার পাটশিল্পের পুনরুজ্জীবনে নানা পদক্ষেপ নিলেও লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না। অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক দলাদলি, সময়মতো কাঁচাপাট কিনতে ব্যর্থ হওয়া, পাটের গুণগত মান ভালো না হওয়া, বেশি জনবল, সিবিএ’র দৌরাত্ম্য, পুরাতন যন্ত্রপাতি, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেই লাভের মুখ দেখছে না সরকারি পাটকলগুলো।

গত আট (২০১১-১৮) বছরে পাটকলগুলোর লোকসান দাঁড়িয়েছে চার হাজার কোটি টাকা। ফলে বকেয়া বেতনের দাবিতে মাঝে মাঝেই রাজপথ কাঁপাচ্ছেন শ্রমিকরা। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে গোটা দেশ। সারাদেশে চালু ২৫টি পাটকলের ২৫ হাজার ৬১৯ জন স্থায়ী শ্রমিকের বকেয়া বেতন-ভাতায় বছরে গুনতে হচ্ছে কয়েকশ’ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরেও এক হাজার ৭৪০ কোটি টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে কয়েক দফায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ছাড়ও করেছে মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) অধীন রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকলে স্থায়ী শ্রমিক আছেন ২৫ হাজার ৫১৯ জন। বদলি তালিকাভুক্ত শ্রমিক ২২ হাজার ৯৯৮ জন। দৈনিকভিত্তিক তালিকাভুক্ত শ্রমিক চার হাজার ৯১০ জন। এসব মিলে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে কাজ করেন ২৭ হাজার ৯৫৭ শ্রমিক।

এসব শ্রমিকের জন্য ২০১৫ সালের মজুরি কমিশন গঠিত হলেও অদ্যাবধি তা বাস্তবায়ন হয়নি। এখনও তারা ২০১০ সালের বেতন কাঠামোতেই বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। এরপরও তা মাসের পর মাস বাকি থাকছে।

২০১১-১২ অর্থবছরে বিজেএমসির লোকসান ছিল ৭৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এরপর ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩৯৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫১৩ কোটি ৮ লাখ টাকা, পরের অর্থবছরে ৭২৯ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৬৯ কোটি ২০ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে।

এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৮১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৯৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫৭৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা লোকসান হয়।

সম্প্রতি বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী কতদিন ধার করে চলবেন— বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) চেয়ারম্যানের কাছে এমন প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘বিজেএমসিকে নিজের টাকায় চলতে হবে। বারবার সরকারের কাছে হাত পেতে চলা যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘সুশাসন চাই, ভালো ব্যবস্থাপনা চাই। পাটশিল্পকে ধ্বংস হতে দেয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। দুর্নীতি থাকলে পাট খাতের কোনোদিন উন্নত হবে না। এ খাতে দুর্নীতি দূর করার সঙ্গে সঙ্গে সুশাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই পাটশিল্প টিকে থাকবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যেখানে বেসরকারি পাটকলগুলো লাভ করছে সেখানে সরকারিগুলো বছরের পর বছর লোকসান করছে। আবার লোকসান পুষতে বাজেট থেকে টাকা দেয়া হচ্ছে। সরকারি খাতের পাটকলগুলোর লোকসানের মূল কারণ হচ্ছে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও রাজনীতিকরণ। সরকারি খাতের কিছু মানুষের দুর্নীতির কারণে লোকসানের ঘানি টানতে হচ্ছে জনগণকে। যেটা মোটেও ঠিক নয়। বরং সরকারি পাটকলগুলো যখন নিজেরা চলতেই পারছে না তখন এগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়াই ভালো।’

বিশ্লেষকরা বলেন, লোকসানে নিমজ্জিত থাকা এসব প্রতিষ্ঠান সরকারি খাতে রাখার কোনো যুক্তি নেই। এসব প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। সরকারের কাজ হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনা করার পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জন্য নীতিনির্ধারণ ও অবকাঠামো নির্মাণ করে দেয়া। এসব ব্যবসা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালানো সরকারের কাজ নয়। এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে অনেক আগেই আলোচনা হয়েছে, সমাধানও দেয়া হয়েছে। এগুলো বেসরকারি খাতের শিল্প, বেসরকারি খাতেই রাখা উচিত।

তারা আরও বলেন, এগুলো সরকারিভাবে উৎপাদনে নিয়ে আসলে সরকারের কোনো লাভ হবে না বরং ক্ষতিই বাড়াবে। আর এ ক্ষতিপূরণটা দিতে হবে সাধারণ মানুষকে। সাধারণ মানুষের করের মাধ্যমে যে রাজস্ব আদায় হচ্ছে সেখান থেকে অর্থ দিয়ে এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা হচ্ছে মাত্র। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও যেখানে সরকারি উদ্যোগে উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান চালানো হয় সেগুলোর সবই আর্থিক ক্ষতি মুখে পড়ে।

বেসরকারিকরণ হলে ওইসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমস্যার মুখে পড়তে হবে— এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদরা বলেন, যারা এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ছিলেন তাদের তো একটা ব্যবস্থা করা হয়। তাদের যেন পথে বসতে না হয় সেজন্য বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে একটা প্রথা চালু আছে। এ ব্যবস্থা সরকারই করে থাকে, এটাকে ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’ বলা হয়।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে