করোনা কি ৪র্থ শিল্প বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করবে?।। ড. মোঃ সিরাজুল ইসলাম

ড. মোঃ সিরাজুল ইসলাম

ড. মোঃ সিরাজুল ইসলাম
ড. মোঃ সিরাজুল ইসলাম। ফাইল ছবি

লকডাউনের মাঝে ‘নেটফ্লিক্স’ এ ‘দি ইমিটেশন গেম’ ছবিটি দেখলাম। অনেকটা সেই ‘এ বিউটিফুল মাইন্ড’ এর কাছাকাছি। বাস্তব ইতিহাসের উপর ভিক্তি করে এই দুটি ছবিই তৈরী। একজন গনিতবিদ ‘এলেন টিউরিং’, যে কি না ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের আক্রমণ কৌশলের নির্দেশনা সম্বলিত একটি ‘কোড’ ল্যাংগুয়েজ ‘এনিগমা’ এর ‘ডিকোড’ করতে গিয়ে যে মেশিনটি আবিস্কার করেন, কালের পরিক্রমায় তাই হয়ে উঠে আধুনিক ‘কম্পিউটার’ এর অনুষঙ্গ বা বৈজ্ঞানিক ভিক্তি। বর্তমানে যে ‘মেশিন ল্যঙ্গুয়েজ’ এবং ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজ্যান্স’ বা ‘কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা’র কথা বলা হচ্ছে, তারও স্বপ্নদ্রষ্টা এই এলেন টিউরিং। মজার বিষয় হচ্ছে,সেকালে লোকজন তাঁর এই ধারনাগুলোকে মোটেই পাত্তা দেয়নি।

বলা হয়ে থাকে, ২য় বিশ্বযুদ্ধ্বের সময় এই ‘এনিগমা’ এর ‘ডিকোড’ করার মাধ্যমে তিনি যুদ্ধটাকে প্রায় দুই বছর কমিয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। ব্রিটিশ বাহিনী তখন মরিয়া হয়ে এই ‘ডিকোড’ এর পিছে লেগেছিলেন। ‘নেসেসিটি ইজ দ্যা মাদার অব ইনভেনশন’ এই আপ্ত বাক্যটির এর চাইতে ভাল উদাহরণ সম্ভবতঃ আর কিছু হতে পারে না।

universel cardiac hospital

বর্তমানের এই সময়ে, আমরা ৩য় বিশ্বযুদ্ধ না হলেও এক মহাক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। বোমায় নয়, মানুষ মরছে এক অদৃশ্য শত্রুর আঘাতে। আপাততঃ একমাত্র সমাধান ঘরে বসে থাকা। কিন্তু ঘরে বসে থাকলে তো আর দুনিয়া চলে না। ডাক্তার আর ঔষুধ বিজ্ঞানীরা তাঁদের কাজ করছেন। কিন্তু যা বুঝা যাচ্ছে, আগামী এক বছরের মধ্যে তেমন আশার বাণী নেই। তাঁর উপর এই করোনা একেবারে নির্মূল হবার নয়। ফলে এসময়ে আরেকটি সমাধানের কথা আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে, আর তা হচ্ছে ‘ঘরে বসে কিভাবে কাজ করা যায়’।

এ প্রসংগে একটি বিষয়ের সাথে এর সংযোগ বেশ লক্ষণীয়। বেশ কিছুদিন ধরে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের একটি ধারনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহলে ব্যাপক আলোচনায় আসছে। ১ম শিল্প বিপ্লব ছিল কয়লার ব্যবহার আর স্টিম ইঞ্জিন, ২য় শিল্প বিপ্লব বিদ্যুৎ এর ব্যবহার, মটর আর কম্বাসন ইঞ্জিন, আর ৩য় শিল্প বিপ্লব ছিল কম্পিউটার এবং সেমিকন্ডাক্টর আবিস্কার। ৪র্থ এই শিল্প বিপ্লবটির মূল উপদান মূলতঃ সর্ব ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তি আর অটোমেশন এর ব্যবপক ব্যবহার। আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজ্যান্স, রোবটিক্স, ৩-ডি প্রিন্টিং, ইন্টারনেট অব থিংস, ৫জি পযুক্তি, ইত্যাদির মাধ্যমে প্রযুক্তিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এর পাশাপাশি ন্যানোটেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা বিকল্প জ্বালানীর মত বিষয়গুলিও আলোচনায় আসছে।

এই নতুন প্রযুক্তিগুলির কয়েকটির ব্যবহারে অফিসের ধারনা এবং ‘কালচার’ অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে আসছিল। আর এই করোনাকালে এর অনেকগুলিই আমাদের উপকারে আসতে পারে। আসলে করোনা শুরু হবার আগ থেকেই এধরনের কিছু ধারনা ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করছিল, যেমনঃ ‘হোম অফিস’ বা বাড়ি থেকে কাজ করা।‘গুগল’ অফিসের ধারনাটিও জনপ্রিয়। খোদ ঢাকার ‘গ্রামীন ফোন’ অফিসটি এই আদলে করা। এখানে ঢুকে দেখবেন, বড় কর্মকর্তাদেরও কোন নির্দিষ্ট অফিস নেই। অফিস নিজের ল্যাপটপে, আর সকালে গিয়ে আপনি যে টেবিলটিতে বসবেন সেটাই অফিস। পরের দিন অন্য যায়গায়। নিজের জন্য একটা লকার থাকতে পারে বড়জোড়। বেশ অনেকগুলি মিটিং রুম আছে, যেখানে পূর্ব নির্ধারিত একটি সময়ে একেকটি বিভাগের সদস্যরা সারাদিনের কাজের সমন্বয় সাধন তথা দেখা-সাক্ষাতের জন্য আলোচনায় বসেন। এছাড়া বাকী যোগাযোগ অধিকাংশ সময় অনলাইনেই হয়ে থাকে বা ইমেইলে। একইভাবে ‘হোম অফিস’ এর ধারনাটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে আসছিল যে, অনেক পদের জন্য এটি অফিসে এসে কাজ করার চেয়ে বেশি কার্যকর মনে করা হচ্ছিল। ফলে, কিছু বড় বড় কোম্পানী তাঁদের ভাড়া করা বড় অফিস ছেড়ে দিয়ে, ছোট অফিসে এসে অধিকাংশ কর্মচারীদের বাড়িতে বসে কাজ করার অনুমতি দিচ্ছিল। ভাড়া বাঁচল, একই সাথে বাঁচল অফিসে আসা যাবার সময়। রাষ্ট্রের উপরি পাওনা, ট্রাফিক জ্যাম লাঘব।

এ প্রসংগে, ঢাকায় কর্মরত একজন মধ্যম সারির সরকারি কর্মকর্তার অভিজ্ঞতার কথা বলি। তাঁর ধারনা সপ্তাহে গড়ে তাঁর অফিস চলাকালীন সময়ের প্রায় অর্ধেকই নাকি কেটে যায় মিটিং এ যোগ দিতে গিয়ে এ অফিস থেকে ওই অফিসে দৌড়াতে দৌড়াতে আরে ট্রাফিক জ্যামে আটকে থেকে। অনেক বলার পরও এই সরকারি কাজের প্রক্রিয়ায়, অনলাইন ব্যাবস্থার উন্নয়নে তেমন আগ্রগতি ঘঠেনি। তবে এই করোনাকালে নিঃসন্দেহে তাঁদের টনক নড়েছে। এই উসিলায় যদি সরকারি অফিসগুলি তাঁদের ভার্চুয়াল সুযোগ সুবিধগুলির উন্নয়ন সাধন করে ফেলতে পারেন, তবে তা হবে শাপে বর ! ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম কমে যেত অর্ধেক, আর সাথে সাথে বায়ু দুষন।

করোনা অভিজ্ঞতার পর শিক্ষা ক্ষেত্রেও একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আশা করা করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেক পরিবর্তন দৃশ্যমান। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজের মত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এতদিন গর্ব করে আসত তাঁদের বিশালায়তন লাইব্রেরী আর তাতে সারি সারি তাক করা দুঃষ্প্রাপ্য সব বইয়ের জন্য। আফসোসের বিষয়, অচিরেই, প্রিন্ট বইয়ের ধারনা সম্ভবতঃ বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে। তার পরিবর্তে আসছে ই-বুক, ই-জার্নাল। ই-নিউজ পেপারের দৌরাত্মে বিশ্বের অনেক ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা তাঁদের প্রিন্ট ভার্সন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। আজকালকার ছেলে-মেয়েদের মোবাইল ফোনেই থাকে ডজন খানেক বইয়ের কপি।

অনলাইন কোর্স আর পাঠদান পদ্ধতিও এগোচ্ছিল তাঁর আপন গতিতে। তবে এই করোনাকালে এর প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ত্ব পাচ্ছে। প্রায় এক যুগ আগ থেকেই, ‘গুগল ক্লাসরুম’ বা ‘ব্ল্যাকবোর্ড’ জাতীয় অনলাইন শিক্ষাদান প্লাটফরমের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির ডিন থাকাকালীন প্রায়শঃই বিভিন্ন কোম্পানীর কাছ থেকে এধরনের নিত্য-নতুন শিক্ষা সারঞ্জামের বিজ্ঞাপন পেতাম। আজকাল এর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এসবের উপর ভিক্তি করে ‘কোর্স এরা’ বা ‘এডেক্স’ এর অনলাইন কোর্সগুলি ইতোমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়। যদিও অদ্যবধি, এই প্রযুক্তিগুলির ব্যবহার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল, তবে এই করোনাকালে এই প্রযুক্তিগুলির ব্যাপক ব্যবহার আশা করা হচ্ছে, এমন কি স্কুল পর্যায়েও। ‘হোম স্কুলিং’ পদ্ধতিটি অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সহ পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশে বহু যুগ ধরেই প্রচলিত। করোনাকালে এ ধারনাটির ব্যপক প্রসার ঘটবে নিঃসন্দেহে। ঢাকার অনেক নামী-দামী স্কুলগুলি তো এখন উঠেপড়ে লেগেছেন এই প্রযুক্তিগুলি আয়ত্ত্ব করতে। কেননা, এই করোনাকালে ছাত্র-ছাত্রী আর আভিভাবকরা আন্দোলনে নেমেছেন, ‘নো ক্লাস, নো টিউশন ফি’ ! আমার দুই ছেলে-মেয়ের স্কুল ‘স্কলাস্টিকা’ তেও একই কান্ড !

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এখনই কাম্য। বহুযুগ আগে আবিষ্কৃত, সেই আলেকজেন্ডার ফ্লেমিং এর ‘এন্টিবায়োটিক’ যেখানে ‘ব্যক্টেরিয়া’ নির্মূলে অব্যার্থ, তথাপি দুঃখজনকভাবে আজ অব্দি ভাইরাস নির্মূলে কিছুই করা গেল না – ‘সারস’, ‘মারস’ বা ‘ইবোলার’ ব্যাপক তান্ডবের পরও। এবার করোনায় যদি কিছু একটা হয় ! একইভাবে রোবট প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়তে পারে রোগীর সেবা-শুশ্রষায়। আজ থেকে আরও এক যুগে আগেই দেখেছিলাম, জাপানে বৃদ্ধদের সেবা-শুশ্রষায় রোবটের ব্যবহার। এই করোনাকালে এর চাইতে মোক্ষম উপকারী প্রযুক্তি আর কি হতে পারে ?

শিল্পক্ষেত্রে রোবটের ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াও বেগবান হতে পারে। কেননা মানুষের সংষ্পর্শ যত এড়ানো যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী আপনার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করতে পারে উড়ন্ত ড্রোন। ড্রাইভার বিহীন গাড়ি তো ইতোমধ্যেই বাজারে এসে গেছে। অনলাইন শপিং আরও দুই যুগ আগে থেকেই শুরু আর উন্নত বিশ্বে ইতোমধ্যেই এর জনপ্রিয়তা তুংগে উঠে এসেছিল। করোনাকালে বাংলাদেশের মত দেশেও তা বাড়বে দিন কে দিন। অনলাইন ব্যাংকিং সেবাও প্রায় সব ব্যাংকই শুরু করে দিয়েছে। এর আরও প্রসার প্রয়োজন। আর তাহলে সকাল বেলা উঠে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ব্যাংকগুলির সামনে লম্বা লাইন অনেকটাই কমে যেত। সর্বোপরি, সবচেয়ে বড় পাওনা হতে পারে ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম অনেকটাই কমে যাওয়া। এতে করে শহরটি হয়ত ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যেত। এ সব কিছুই আসলে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের অনুষঙ্গ। ভার্চুয়াল দুনিয়া আর রোবটের দৌরাত্ম।

ফলে এই প্রশ্নের উদ্রেগ হতেই পারে যে, এই করোনায় কি তাহলে, ৪র্থ শিল্প বিপ্লবটি আরও বেগবান হয়ে উঠবে ? হয় তো বা ! আবারও সেই একই কথা ‘নেসেসিটি ইস দ্যা মাদার অফ ইনভেনশন’। এই দুর্যোগে সবার সুস্থতা কামনা করছি আর আশা করছি, বরবরের মতই, স্রষ্টার আশীর্বাদে পুষ্ট হয়ে বজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদগণ এই কঠিন সময় উৎরে উঠতে মানব জাতিকে সময়োপযোগী সমাধান দিবেন।

লেখক, ড. মোঃ সিরাজুল ইসলাম; অধ্যাপক, সিভিল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও পরিচালক, সেন্টার ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার রিসার্চ এন্ড সার্ভিসেস, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে