ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে সময় কাটছে স্কুলছাত্রী সামিয়ার। চাচাতো ভাই আর চাচার বিরুদ্ধে মামলা কড়া করতে সে ধর্ষিত হয়েছে জবানবন্দি দিতে তাকে চাপ দিচ্ছেন মা। সঙ্গে পুলিশ। তা না হলে আবার নিরাপত্তা হেফাজতে পাঠানো হবে বলে ভয় দেখানো হয় এই স্কুলছাত্রীকে।
তাকে ও তার পরিবারকে হয়রানি থেকে বাঁচানোর সাংবাদিকদের কাছে আবেদন জানায় সামিয়া। তার ভাষ্য, মা শাহেনা বেগম তাকে (সামিয়া) চাচা-চাচি ও প্রতিবেশীদের ঘায়েল করার অস্ত্র বানিয়েছে। ২৬ দিন নিরাপত্তা হেফাজতে থেকে বাড়িতে আসার দু-তিন দিন পরই মা তাকে নিয়ে যান উকিলের কাছে। মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে মা আর উকিলের চাপ, থানা-পুলিশের ভয়ভীতি, নিরাপত্তা হেফাজতে দিনগুজরানে বিপর্যস্ত এই কিশোরী।
এর আগে এই নাবালিকাকে জোর করে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন মা। এসব ঘটনায় আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে সামিয়ার মনে। পড়াশোনা উঠেছে লাঠে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের টিঘর গ্রামের মধ্যপ্রাচ্য-প্রবাসী আবু সায়েদ মিয়ার মেয়ে সামিয়া আক্তার (১৪)। স্থানীয় ব্লুবার্ড স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সে।
একের পর এক মামলা নিয়ে সরাইল থানার পুলিশ দাবড়াচ্ছে শাহানার ভাসুর-জার পরিবারের ওপর। এর আগে ওই পরিবারের ১০ বছর বয়সী এক শিশুকে আসামি বানিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে পুলিশ। এ ঘটনায় অভিযুক্ত এএসআইকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়। বদলি হন আরেক দারোগা। কিন্তু হয়রানি থেকে পরিত্রাণ মিলছে না দরিদ্র কাশেম মিয়া ও আবদুস সাত্তারের পরিবারের। শাহেনার সঙ্গে যোগসাজশ করে চলছে পুলিশ।
মেয়ে সামিয়াকে অপহরণের অভিযোগে শাহেনা গত ২৯ মে সরাইল থানায় একটি মামলা করেন। এতে টিঘর গ্রামের ইয়াছিন মিয়াসহ (২২) ৭ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে আছেন সামিয়ার দুই চাচা কাশেম মিয়া ও আবদুস সাত্তার মিয়া। আবদুস সাত্তার ইতিপূর্বে এই থানায় কর্মরত এএসআই হেলালের বিরুদ্ধে করা একটি মামলার বাদী।
অভিযোগ উঠেছে, সামিয়া অপহরণ মামলা ও আসামি গ্রেপ্তারের পরম্পরা নিয়ে। ২৯ মে মামলা রেকর্ড হলেও তার এক দিন আগেই আসামি ইয়াছিন মিয়া ও ফয়েজ মিয়াকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। সামিয়াকে থানায় ডেকে নিয়ে উদ্ধার দেখানো হয়। ভয়ভীতি দেখানো হয় অপহরণ-ধর্ষণের স্বীকারোক্তি দিতে। এতে রাজি না হওয়ায় পরদিন তাদের তিনজনকে আদালতে পাঠানো হয়।
আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দিতে সামিয়া জানায়, তাকে কেউ অপহরণ করেনি। সে নিজেই তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে লুকিয়ে ছিল।
মেয়েকে নিজ জিম্মায় নেয়ার জন্য শাহেনা আদালতে আবেদন করলে সামিয়া তার জিম্মায় যেতে রাজি হয়নি। এরপর আদালত তাকে নিরাপত্তা হেফাজতে পাঠিয়ে দেয়।
অপহরণ মামলা হওয়ার আগে ২৭ মে সামিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে মায়ের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ দেয়। এতে সামিয়া জানায়, মা শাহেনা বেগম জোর করে রবিন নামের এক ছেলের সঙ্গে তাকে বিয়ে দিতে চায়। বিয়েতে তার প্রবাসী বাবা মো. আবু ছায়েদের কোনো সম্মতি নেই বলেও উল্লেখ করে সামিয়া।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরাইল থানার ওসি ও মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাকে বিষযটি তদন্ত করতে বলেন। কিন্তু এই অভিযোগের তদন্ত বাদ রেখে ওসি শাহেনার দেয়া অপহরণ মামলা রেকর্ড করেন। ২৯ মে মামলা হলেও অপহরণ ঘটনার তারিখ দেখানো হয় ১৫ মে। মাঝের ১৪ দিন সামিয়া কোথায় ছিল, তার মা কেন তখন আইনি পদক্ষেপ নেননি- এসব তদন্ত করেনি পুলিশ।
তাকে কেউ অপহরণ করেনি দাবি করে সামিয়া বলে, ‘এর পরও পুলিশ আমার চাচাতো ভাই ও চাচাকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। আমি গেলে তাদের ছেড়ে দেবে বলে আমাকে থানায় নিয়ে আটক করে। ওরা আমারে অপহরণ-ধর্ষণ করছে এই কথা বলার জন্য ভয়ভীতি দেখানো হয়। আমি ২৬ দিন জেলে ছিলাম (নিরাপত্তা হেফাজতে)। সেখান থেকে আসার পর আম্মু আমাকে নিয়ে উকিলের কাছে যান মামলা আরো কড়া করার জন্য। তাদের ৭ বছর জেল খাটাবে। আমাকে বলেছেন, তারা ধর্ষণ করেছে এই কথা বলার জন্য। তা না হলে আমাকে আবার জেলে পাঠাবে।’
দেশে স্ত্রীর এই কাণ্ডকীর্তিতে দুশ্চিন্তায় সৌদি প্রবাসে ঘুম হারাম সামিয়ার বাবা আবু ছায়েদের। ফোনে বলেন, ‘এর আগে আমাকে না জানিয়ে গোপনে আমার বড় মেয়েকে এক ডাকাতের কাছে বাল্যবিবাহ দিয়েছে শাহেনা। এ নিয়ে ঝগড়া হলে সে তার বাবার বাড়িতে চলে যায়। আমার মেঝ মেয়ে সামিয়াকে আমি তার সাথে যেতে দেইনি। তাকেও শাহেনা এক ডাকাতের সাথে বিয়ে দিতে তৈরি হয়।’
আবু ছায়েদ আরও অভিযোগ করেন, ‘আমার মেয়েকে কেউ অপহরণ করেনি। গত ২৪ মে এসআই খলিল ১২ জন পুলিশ নিয়ে গিয়ে আমার শিশুকন্যাকে ধরার জন্য এক কিলোমিটার পর্যন্ত ধাওয়া করে। আমার স্ত্রী অন্যের প্ররোচনায় এ পর্যন্ত আমাদের ভাইদের বিরুদ্ধে ৫টি মিথ্যা মামলা করেছে।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কথিত অপহরণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো. খলিলুর রহমান বলেন, ‘ আসামি পক্ষ এসব কথা বোলবেই। মামলার রেকর্ড ওসি করেন। এ ব্যাপারে তার সঙ্গে কথা বলেন।’
সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল মামুন মুহাম্মদ নাজমুল আলম বলেন, ‘মা মেয়েকে পাচ্ছে না। মা অপহরণের অভিযোগ দিল। আমরা মামলা নিয়ে ভিকটিম উদ্ধার ও আসামি গ্রেফতার করি।’ ইউএনওর কাছে কিশোরীর দেয়া অভিযোগের তদন্তের বিষয়ে তার কাছ কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।