চলে গেলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঢাকা-১৮ আসেনের সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ১১টার দিকে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
৭৭ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমানো সাহারা খাতুন বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন। মানুষের অধিকার আদায়ে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন আস্থাভাজন।
১৯৪৩ সালের ১ মার্চ ঢাকার কুর্মিটোলায় জন্মগ্রহণ করেন সাহারা খাতুন। তার বাবার নাম আব্দুল আজিজ। মায়ের নাম তুরজান নেসা। শিক্ষাজীবনে তিনি বিএ এবং এলএলবি ডিগ্রি আর্জন করেন।
এলএলবি পাসের পর সাহারা খাতুন ১৯৮১ সালে আইন পেশায় নিজেকে যুক্ত করেন। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের জুনিয়র হিসেবে কাজ শুরু করেন।
তৃণমূল থেকে লড়াই করে রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে উঠে আসা সাহারা খাতুনের রাজনৈতিক জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। রাজনীতির প্রথম জীবনেই নাম লেখান ছাত্র রাজনীতিতে। আইনপেশায় আসার পর সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে।
১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের মহিলা শাখা গঠিত হলে সেখানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং সারা ঢাকা শহরে মহিলাদের আইভি রহমানের নেতৃত্বে সংগঠিত করতে শুরু করেন। অংশ নিয়েছিলেন সব মিছিল মিটিংয়ে।
সাহারা খাতুন প্রথমে নগর আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে মহিলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক হন। পরবর্তী সময়ে সাধারণ সম্পাদিকা এবং একই সঙ্গে নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এরপর তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহ-আইন সম্পাদিকা, পরে আইন সম্পাদিকা নির্বাচিত হন, তখন তিনি নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদ এবং মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ আর গ্রহণ করেননি। এরপর পরবর্তী কাউন্সিলে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন।
সাবেক এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজপথের রাজনীতিতে সব সময়েই সরব ছিলেন। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, আইয়ুব-ইয়াহিয়া বিরোধী আন্দোলন, দেশ স্বাধীনের আন্দোলন, ৭৫’র পর অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং খালেদা জিয়ার নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন করেছেন রাজপথে। রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে হরতাল, সভা-সমাবেশ করতে গিয়ে একাধিকবার গ্রেপ্তার এবং নির্যাতিত হয়েছেন।
আইনপেশায় নিয়োজিত থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের বহ সংখ্যক নেতাকর্মীর মামলা বিনাপয়সায় লড়েছেন এবং তাদের জেল থেকে মুক্ত করেছেন।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে আওয়ামী লীগের যে কয়েকজন নেতা দলীয় সভানেত্রীর প্রতি আনুগত্য ধরে রেখে ছিলেন সক্রিয়, তাদেরই একজন সাহারা। দীর্ঘদিন রাজনীতিতে থাকলেও শেখ হাসিনার পক্ষে তখন আইনজীবী হিসেবে দাঁড়িয়েই ব্যাপক পরিচিতি পান তিনি। বিনা পারিশ্রমিকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নামে করা মামলা পরিচালনায় ভূমিকা রেখেও দলের নেতা-কর্মীদের কাছাকাছি ছিলেন সাহারা।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-১৮ আসন থেকে নির্বাচিত হয় তিনি। এরপর মন্ত্রিসভা গঠনের সময় ডাক পান। দায়িত্ব পান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তিন বছর দায়িত্ব পালনের পর ২০১২ সালে মন্ত্রণালয়ের রদবদল হলে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এরপর মন্ত্রীর দায়িত্ব আর না পেলেও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করা হয়েছিল সাহারা খাতুনকে। ২০০৮ সালের পর দুটি নির্বাচনেই ঢাকা-১৮ থেকে তাকে নৌকার প্রার্থী করা হয়েছিল। দুটিতেই নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
জ্বর, অ্যালার্জিসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে অসুস্থ অবস্থায় গত ২ জুন সাহারা খাতুন ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে আইসিইউতেও ছিলেন কিছুদিন।
অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে কয়েকদিন পর তাকে আইসিইউ থেকে ফিরিয়ে আনা হলেও অবনতি ঘটলে আবার নিতে হয়। এর মধ্যেই পরিবারের সদস্যরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে চাইছিল, যদিও করোনাভাইরাস মহামারির কারণে তাতে দেরি হয়। সবশেষে গত সোমবার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে থাইল্যান্ড নেওয়া হয়। বিকাল চারটার দিকে তাকে বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে মারা যান সাবেক এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।