দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে কিউবানদের ধৈর্য, শক্তি বা সাহস হয়ে দাঁড়িয়েছে পাথরের মতো কঠিন। বিপদের মুখে সরকারি নির্দেশনা মানার প্রবণতাটাও হয়তো এসেছে সেখান থেকেই। ফলে মার্কিনিদের মতো করোনাভাইরাসও দাঁড়াতে পারল না তাদের সামনে। খুব শিগগিরই শতভাগ করোনামুক্ত হওয়ার পথে রয়েছে ক্যারিবিয়ান দেশটি।
লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে যখন তাণ্ডব চালাচ্ছে মহামারি করোনা, সেখানে কিউবায় মোটেও সুবিধা করতে পারেনি ভাইরাসটি। দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন সব মিলিয়ে ২ হাজার ৪শ’র মতো, এর মধ্যে ২ হাজার ২শ’র বেশি ইতোমধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। মারা গেছেন মাত্র ৮৭ জন (সূত্র: ওয়ার্ল্ডোমিটারস)।
এরই মধ্যে সচল হয়েছে দেশটির আন্তঃপ্রদেশীয় যোগাযোগ (রাজধানী হাভানা বাদে)। দেশি পর্যটকদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে হোটেলগুলো। ১ জুলাই থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় চালু হয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যটনও। কিন্তু, কীভাবে সেটা সম্ভব হলো? ইউরোপ-আমেরিকা যা পারছে না, তা কিউবা পারল কীভাবে?
কিউবান ব্যবস্থার চমক
মূলত কড়া কোয়ারেন্টাইনের মাধ্যমেই মহামারির লাগাম টেনে ধরেছে কিউবা। লকডাউন শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই দেশটিতে বন্ধ করে দেয়া হয় সবধরনের আন্তর্জাতিক চলাচল। কেবলমাত্র চিকিৎসা সহায়তা দেয়ার জন্য বিশেষ কিছু ফ্লাইট চলাচল করেছে অল্প কয়েকটি দেশের সঙ্গে।
লকডাউন দিয়ে আন্তঃপ্রদেশীয় যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল কিউবান সরকার। সব রাস্তায় ছিল পুলিশের কড়া পাহারা। বাইরে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয় মাস্ক পরা, নিষিদ্ধ হয় সবধরনের জনসমাবেশ। খাদ্যপণ্য কিনতে লাইন দেয়াকে করোনার বিস্তারের অন্যতম প্রধান মাধ্যম বিবেচনা করে এক্ষেত্রে নেয়া হয় বিশেষ সতর্কতা।
করোনা মোকাবিলায় অনেকটা রাসায়নিক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রাস্তায় নামে কিউবার সশস্ত্র বাহিনী। পাম্প ও ট্যাঙ্ক ট্রাক ব্যবহার করে সড়কগুলোতে নিয়ম করে জীবাণুনাশক ছিটানো হয়। বেশি সংক্রমিত এলাকায় মানুষজনের যাতায়াত বন্ধে মোতায়েন করা হয় কয়েক হাজার সেনা।
লকডাউনের সময় ট্যাক্স, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, টেলিফোন, ইন্টারনেটের বিল পরিশোধ স্থগিত করে দেশটির সরকার। ছাড় দেয়া হয় ব্যাংক ঋণের কিস্তিতেও। মানুষের চলাচল কমাতে ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়ায় কাজে লাগানো হয় স্বেচ্ছাসেবকদের।
নতুন কোনও করোনা রোগী শনাক্তের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কোথায় কোথায় গিয়েছেন, কার সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ কি না- দ্রুতই এসব তদন্ত শুরু করে কিউবার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। কাউকে সন্দেহভাজন মনে হলেই তাকে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পাঠানো হয়। অবস্থা বুঝে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয় অনেককে, তবে সেক্ষেত্রে তাদের অবস্থান দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয় প্রতিবেশীদের।
কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের প্রতিদিনই দেখতে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। সামান্য উপসর্গ দেখা দিলেও সঙ্গে সঙ্গে পাঠানো হচ্ছে হাসপাতালে। এছাড়া, ব্যাপক হারে পরীক্ষা তো আছেই। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসলেও এখনও দৈনিক দুই হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে দেশটিতে।
শক্তিশালী চিকিৎসা ব্যবস্থা
কিউবানদের করোনা যুদ্ধে জেতার সবচেয়ে বড় অস্ত্র মনে করা হচ্ছে তাদের বিপুল সংখ্যক দক্ষ চিকিৎসাকর্মীদের। ১ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে এ মুহূর্তে চিকিৎসক আছেন প্রায় ৯৫ হাজার, নার্স আছেন ৮৫ হাজারের বেশি। জনপ্রতি মানুষের জন্য বিদ্যমান চিকিৎসকের সংখ্যায় স্পেনের চেয়ে প্রায় তিনগুণ এগিয়ে কিউবা।
সেখানে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত অনুশীলন নিষিদ্ধ। ফলে দেশটির সব হাসপাতাল, ক্লিনিক, সমাজে পারিবারিক চিকিৎসকের বাড়িসহ সবধরনের মানবিক ও বৈষয়িক চিকিৎসা সম্পদ সরকারের অধীনে।
এছাড়া, মহামারি মোকাবিলায় কিউবান চিকিৎসকের অভিজ্ঞতাও রয়েছে যথেষ্ট। কিউবার আন্তর্জাতিক চিকিৎসক বাহিনী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগের মহামারিগুলোর বিরুদ্ধে লড়ার অভিজ্ঞতা নিয়েছে। যেমন- আফ্রিকায় ইবোলা মহামারির সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় ব্রাজিলে কাজ করেছেন আট হাজার কিউবান চিকিৎসক।
ফলে কিউবায় যখন প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়, তখনই এটি প্রতিরোধে অনেকটাই প্রস্তুত ছিল দেশটির চিকিৎসক বাহিনী। শুধু নিজ দেশেই নয়, কিউবান চিকিৎসকরা এবারের মহামারিতেও সেবা দিচ্ছেন বিশ্ববাসীকে। কিউবার চিকিৎসক বাহিনীর ২০টি দলের প্রায় আড়াই হাজার সদস্য বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। করোনায় মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া বিশ্বকে রক্ষায় অক্লান্ত লড়ে যাচ্ছেন এসব চিকিৎসা সৈনিক।