না ফেরার দেশে চলে গেলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক শাহজাহান সিরাজ

নিজস্ব প্রতিবেদক

শাহজাহান সিরাজ
ফাইল ছবি

প্রায় আট বছর ফুসফুসের ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস করে অবশেষে না ফেরার দেশে চলে গেলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক শাহজাহান সিরাজ। মুক্তিযুদ্ধের আগে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ যে চার ছাত্র নেতাকে ‘চার খলিফা’ হিসেবে অভিহিত করা হতো তাদের অন্যতম ছিলেন শাহজাহান সিরাজ। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ‘ছাত্র আন্দোলনের নিউক্লিয়াস’র পক্ষে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করে গর্বিত ইতিহাসের অংশ হয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত এই রাজনীতিক।

আজ মঙ্গলবার বেলা তিনটার পর রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি মারা গেছেন। বুধবার তাকে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হবে।

একসময়ের প্রভাবশালী এই রাজনীতিকের ফুসফুসে ২০১২ সালে ক্যানসার ধরা পড়ে। এর কয়েক বছর পর ক্যানসার ধরা পড়ে মস্তিষ্কেও। আগে থেকে তিনি ডায়েবেটিস, কিডনি জটিলতা, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছিলেন।

জানা গেছে, ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্যদিয়ে শাহজাহান সিরাজ ছাত্র-রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। সেই সময় তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত কলেজের ছাত্র ছিলেন। এরপর তিনি ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্র-রাজনীতিতে উঠে আসেন। ১৯৬৪-৬৫ এবং ১৯৬৬-৬৭ দুই মেয়াদে তিনি করটিয়া সা’দাত কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। একজন সক্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন।

এরপর তিনি ১৯৭০-৭২ মেয়াদে অবিভক্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’র (যার অন্য নাম নিউক্লিয়াস) সক্রিয় কর্মী, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা।

শাহজাহান সিরাজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের ‘চার খলিফা’ বলা হতো শাহজাহান সিরাজ ছিলেন তাদেরই একজন।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ তিনি সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব প্রভৃতি ছাত্রনেতাদের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন আ স ম আবদুর রব। সেখান থেকেই পরদিন স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের পরিকল্পনা করা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বিশাল এক ছাত্রসমাবেশে বঙ্গবন্ধুর সামনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন শাহজাহান সিরাজ। এরপর যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নেন।

মুক্তিযুদ্ধের পর শাহজাহান সিরাজ সর্বদলীয় সমাজতান্ত্রিক সরকার গঠনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠনে ভূমিকা পালন করেন, যা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতিষ্ঠাতা সহকারী সাধারণ সম্পাদক হন শাহজাহান সিরাজ। পরে জাসদের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। জাসদের মনোনয়নে তিনবার তিনি জাতীয় সংসদের টাঙ্গাইল-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

শাহজাহান সিরাজ ১৯৯৫ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিতে যোগ দেন। তিনি বিএনপির মনোনয়নেও একবার একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। চারদলীয় জোট সরকারে বন ও পরিবেশমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেপ্তার হন শাহজাহান সিরাজ। তখন দুর্নীতির মামলায় তার সাজার রায়ও হয়েছিল।

১৯৭২ সালে এক সময়ের রাজনৈতিক সহকর্মী, সাবেক ছাত্রনেত্রী রাবেয়া সিরাজের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন শাহজাহান সিরাজ। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে আছেন। তার স্ত্রী রাবেয়া সিরাজ একজন শিক্ষিকা এবং রাজনীতিবিদ।

‘চার খলিফা’র মধ্যে এর আগে মারা গেছেন আবদুল কুদ্দুস মাখন। আজ চলে গেলেন শাহজাহান সিরাজ। এখনো জীবিত আছেন ডাকসুর তৎকালীন ভিপি আ স ম আবদুর রব ও ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী ।

এদের মধ্যে নুরে আলম সিদ্দিকী রাজনীতিতে সক্রিয় নেই। আওয়ামী লীগ থেকে জাসদে যাওয়া আ স ম রব জেএসডি নামের একটি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে