কোরবানির ঈদ ঘনিয়ে আসায় বেসরকারি চাকরিজীবী শফিক রহমানের দুশ্চিন্তা আরো বেড়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের ২০ শতাংশ বেতন কেটে নেওয়া হচ্ছে। প্রতিবছরই তিনি কোরবানি দেন। এবার পারবেন কি? মাঝে মধ্যে আরো বড় দুশ্চিন্তা ভর করে—কোরবানির ঈদ পর্যন্ত চাকরি থাকবে তো? ছোট মেয়েটা নতুন জামার আবদার করেছে। পূরণ করতে পারবেন তো?
শফিকের মতো এমন অবস্থা বেসরকারি খাতে এখনো চাকরিতে টিকে থাকা বেশির ভাগের। তবে তাঁরা নিজেদের কিছুটা সৌভাগ্যবান ভাবতে পারেন। কারণ চাকরি হারানো চার কোটি মানুষের দুশ্চিন্তা আরো তীব্র।
আর ঠিক এসবের উল্টো চিত্র সরকারি খাতে। বেতন বা বোনাস নিয়ে তো চিন্তা নেই-ই বরং আগামী মাস থেকে যোগ হচ্ছে ইনক্রিমেন্ট। ফলে বেতন বাড়ছে আরেক দফা। বেড়েছে বোনাসের পরিমাণও।
দুই কূলের এই দুই শ্রেণির চাকরিজীবীদের ব্যাপারে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকারি ও বেসরকারি চাকুরেদের মধ্যে ভয়াবহ বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। এখন সরকার চালাচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারা। জনপ্রতিনিধিদের হাতে এখন আর ক্ষমতা নেই। নিজেদের বেতন-ভাতা নিয়েই ব্যস্ত তাঁরা। এ বিষয়ে জাতীয় সংসদেও কেউ কোনো প্রশ্ন করছে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে দেশে ফিরেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন পাকিস্তান আমলের মতো দেওয়া সম্ভব নয়। এই দৃষ্টান্ত এবং আদর্শ থেকে আমরা কোথায় সরে এসেছি?’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ভদ্রতা ও শিষ্টতার কথা মনে রেখে সরকারি কর্মকর্তাদের নিজেদের বেতন কমানো উচিত। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই এটা করা উচিত। সরকারি কর্মকর্তাদের ইউনিয়নের মাধ্যমে এ প্রস্তাব দেওয়া উচিত। সহমর্মিতা দেখিয়ে ঈদের বোনাস নেওয়া উচিত না। গাড়ির তেল খরচসহ অন্যান্য ভাতাও কমানো উচিত। রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে এটা করা সরকারের দায়িত্ব।’
করোনায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন চিকিৎসাব্যবস্থায় সরাসরি যুক্ত ডাক্তার-নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের যাঁরা সরকারি চাকরি করেন তাঁরা আর্থিক দিক দিয়ে এ বিষয়ে কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত। কারণ করোনায় আক্রান্ত হলেই গ্রেডভেদে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা পাবেন। আর মারা গেলে পরিবার পাবে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা।
এ ছাড়া করোনা চিকিৎসায় সরাসরি যুক্ত সরকারি ডাক্তার-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা পাবেন দুই মাসের মূল বেতন। এ দুই খাতে অর্থ মন্ত্রণালয় ৮৫০ কোটি টাকা পৃথক বরাদ্দ রেখেছে। এর মধ্যে ৫০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য। আর ৩৫০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে ডাক্তার-নার্সদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য। করোনা ইউনিটে রোগীদের একই মাত্রায় সেবা দিয়ে কিংবা সরাসরি যুক্ত থেকেও বেসরকারি খাতের চিকিৎসকদের প্রাপ্তির খাতা শূন্য।
বেসরকারি খাত যে কতটুকু অবহেলিত তা করোনাকালে আরো স্পষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে এই মহামারি পরিস্থিতির মধ্যেও সরকারি চাকরিজীবীদের খাতায় যোগ হচ্ছে একের পর এক সুবিধা। করোনার সময়ে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, শতভাগ কর্মকর্তাকে অফিসে আসতে হচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে ২৫ শতাংশ কর্মকর্তা অফিসে এসে কাজ করছেন। তাও পালাক্রমে। বাকি ৭৫ শতাংশ ঘরে বসে অনলাইনে কাজ করছেন। বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রথম দিকে ৫০ শতাংশকে বাড়িতে বসে কাজ করার সুবিধা দেওয়া হলেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান তা তুলে নিয়েছে।
যেসব সরকারি কর্মকর্তা বাড়িতে বসে কাজ করছেন তাঁদের ভাতায় কিন্তু এসবের প্রভাব নেই। বরং অফিসে নিয়মিত না গেলেও প্রাধিকারপ্রাপ্ত অফিসাররা গাড়ি খরচের জন্য ৫০ হাজার করে টাকা তুলছেন। সিনিয়র সচিব, সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা সরকারের বরাদ্দ করা গাড়ির বিপরীতে ২৫০ লিটার পেট্রোল/অকটেন অথবা ৩৫৮ ঘনমিটার সিএনজি পাচ্ছেন। বিপরীতে এখানেও বঞ্চিত বেসরকারি খাত।
এই সময়ে এত সব পাওয়া নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটি বিবেচনা করার মতো বিষয়। কিন্তু যেহেতু এসংক্রান্ত নীতিমালা আছে আপাতত সেভাবেই চলছে। তবে বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করে দেখব, কী করা যায়।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘এটা খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন। নীতিগত অবস্থান থেকে যে অফিসাররা গাড়ির খরচ কম নেবেন তাঁদের জন্য এটা খুবই উচ্চ পর্যায়ের নৈতিক অবস্থান হবে।’ তিনি বলেন, ‘সরকার চাইলে খুব সহজেই এসংক্রান্ত নীতিমালা সংশোধন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।’
করোনাকালে বেসরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো অস্তিত্বের লড়াইয়ে লিপ্ত। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের বাঁচাতে এবং খরচ কমাতে ছাঁটাই চালাচ্ছে। এতে গত চার মাসে চাকরি হারিয়েছে চার কোটি মানুষ। যাদের চাকরি যায়নি তাদের বেতন থেকে ১০, ১৫ এমনকি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কেটে নেওয়া হচ্ছে। ফলে সামনের ঈদের খুশিও নেই এসব পরিবারে।
দেশের অন্যতম ভরসার খাত ব্যাংক খাত। ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) তো কর্মীদের বেতন কাটাসহ ১৩ দফা সুপারিশ পাঠিয়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান বরাবর। ওই সব সুপারিশের মধ্যে ব্যাংক কর্মীদের পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট, ইনসেনটিভ বোনাস, নতুন নিয়োগ, নতুন শাখা খোলা, বিদেশ ভ্রমণ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। সুপারিশ মোতাবেক অনেক বেসরকারি ব্যাংক কর্মীদের বেতন কেটে নিচ্ছে।
সরকারি খাতে অবশ্য এসব চিন্তা নেই। বরং ২০১৫ সালের বেতন কাঠামো অনুযায়ী, আগস্ট মাস থেকে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট যোগ হচ্ছে। ১ আগস্ট ঈদ হলে সরকারি চাকরিজীবীরা বেশি বোনাস পাবেন। এতে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হবে ১৩০-১৪০ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত সরকার সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা দিতে ব্যয় করেছে তিন লাখ ৫৮ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে এ খাতে ৬৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এটিও যোগ করা হলে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতায় ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় চার লাখ ২৭ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় আগামী দুই অর্থবছরের জন্য সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা বাবদ কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হতে পারে তার একটি হিসাব করেছে।
এতে দেখা গেছে, আগামী অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় হবে ৭৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। আর এর পরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যয় হবে ৮৬ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী এ দুই অর্থবছরের টাকা যোগ করা হলে তা দেশের চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকারকে ছাড়িয়ে যায়।
সরকারি চাকরিজীবীরা অবসর গ্রহণ করলে পেনশন পান, ভাতা পান। এ ক্ষেত্রেও বেসরকারি খাত বঞ্চিত। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর কথা বলেছিলেন। পেনশন কার্যক্রমের সংস্কার আনতে ২০১৭ সালে বিদ্যমান গণকর্মচারী (অবসর) আইন, ১৯৭৪ এবং এবিষয়ক বিধি সংশোধনের উদ্যোগও নিয়েছিল সরকার। তবে তা আর হয়নি। কবে হবে তা কারো জানা নেই।