কোরবানি ঈদের ছুটি শুরু হতে এক সপ্তাহের মতো সময় বাকি। এরই মধ্যে প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে শহর ছেড়ে গ্রামে এবং গ্রাম ছেড়ে শহরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে সাধারণ মানুষ। ঈদে এমন চিত্র স্বাভাবিক হলেও করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবের সময়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের যাতায়াত এই ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার ঝুঁকি বাড়াবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত রোজার ঈদে কার্যত লকডাউন পরিস্থিতি এবং গণপরিবহন বন্ধ থাকার কারণে অনেকেই এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাতায়াত করতে পারেনি। কিন্তু কোরবানির ঈদে দূরপাল্লার গণ-পরিবহনে চলাচলে এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় এবার বেশিসংখ্যক মানুষ চলাচল করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঢাকার বাসিন্দা আসমা আক্তার লিমা এরই মধ্যে পরিবার নিয়ে যশোরের চৌগাছায় নিজের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।
‘রোজার ঈদে বাস ট্রেন সব বন্ধ ছিল এজন্য বাড়িতে ঈদ করতে পারি নাই। ঈদের সময়টাতেই আমাদের সবার সাথে সবার দেখা হয়। তাই কুরবানির ঈদে মিস করবো না। তাছাড়া বাড়িতে বাবা মাও চিন্তা করছে,’ বলেন মিসেস লিমা।
তবে আগে যে আনন্দ নিয়ে তিনি ঈদে বাড়ি যেতেন এখন সেখানে ভর করেছে উদ্বেগ। গণপরিবহনগুলোয় আদৌ স্বাস্থ্যবিধি মানা হবে কি না, সুস্থ অবস্থায় পরিবার নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পারবেন কি না, এমন দুশ্চিন্তা তাকে ঘিরে ধরেছে।
তিনি বলেন, ‘আমার সাথে ছোট বাচ্চা আছে, বাড়িতে বাবা মা আছে, তাদের কেউ যদি আক্রান্ত হয়! আমিও তো ভাইরাস বহন করতে পারি। আর এবারে বেশি মানুষ যাবে। বাসে কিংবা ফেরিতে কতোটা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা হবে আমার সন্দেহ আছে।’
এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ঈদকে কেন্দ্র করে সড়কপথ ও রেলপথে প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়ে যান। বাংলাদেশে যা বছরের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ চলাচল।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যার হিসেবে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ঢাকা মহানগরী।
যে মুহূর্তে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, সে সময়ে করোনাভাইরাস উপদ্রুত এই শহর থেকে একসঙ্গে এতো মানুষের চলাচল ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলায় ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ শারমিন ইয়াসমিন।
‘রোজার ঈদে লকডাউন থাকা সত্ত্বেও আমরা নৌপথে দেখেছি মানুষ কিভাবে গাদাগাদি করে চলাচল করেছে। কেউ কোন স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করেনি। এরপর করোনাভাইরাসের প্রকোপ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এবারও তাই হবে।’
রোজার ঈদের চাইতে এবারের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আরও নাজুক থাকায় ঝুঁকি কয়েকগুণ বেশি বলেই তিনি মনে করছেন। এমন অবস্থায় এবারের ঈদেও গণ চলাচলে লাগাম টানার পরামর্শ দেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
‘যতো টেস্ট হচ্ছে তার ২৩%-২৫% পজিটিভ ফলাফল আসছে। যদি মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা না হয়, তাহলে ঈদ-পরবর্তী সময়ে সংক্রমণ বেড়ে যাবে। সীমিত পরিসরেও যদি চলে সেখানে গণপরিবহনগুলো কতোটা সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে পারবে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে।’
করোনাভাইরাস বিস্তারের এমন ঝুঁকি বিবেচনা করে এবারের ঈদে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রাম থেকে অন্যান্য জেলায় যাতায়াত বন্ধ রাখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির পরামর্শে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে গত বুধবার লিখিতভাবে এই অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত গণপরিবহন বন্ধ বা সীমিত করার বিষয়ে সরকারি কোনো নির্দেশনা আসেনি।
তবে সবাই যদি ভ্রমণের ক্ষেত্রে সরকারি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে তাহলে করোনাভাইরাস ঠেকানো সম্ভব বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র আয়েশা আক্তার।
তিনি বলেন, ‘ঈদের সময় গণপরিবহন যেন সীমিত পরিসরে চলে সেজন্য আমরা টিকেট কাটার বিষয়টা অনলাইনে করছি। তারপরও আশঙ্কা তো থাকেই। কিন্তু গণ-বিজ্ঞপ্তিতে আমরা স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলতে বলছি। সবাই সচেতন থাকলে সংক্রমণ ঠেকানো যাবে। নিয়ম মানলেই সেটা সম্ভব।’
সরকারি স্বাস্থ্যবিধি যেন সবাই মেনে চলে সে ব্যাপারে জেলা উপজেলা পর্যায়ে প্রচার প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পরিস্থিতি দেখভালে নিয়োজিত করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
তবে ঈদের এই মৌসুমে করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে গণ-পরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে কী ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, বাড়ির বাইরে ভ্রমণের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে সে ব্যাপারে একটি সমন্বিত নীতিমালা তৈরি করে আরও জোরালো প্রচারণা শুরু করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র : বিবিসি বাংলা