প্রায় ছয় মাস ধরে দেশে মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চলছে। জুলাইয়ের শুরুতে সংক্রমণের মাত্রা অনেকটা বেড়ে যাওয়ার পর তা আস্তে আস্তে কমে আসে। যদিও পরীক্ষার সংখ্যা কম হওয়ায় শনাক্ত কম হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ঈদ, কোরবানি ও বন্যা পরিস্থিতির কারণে সংক্রমণের মাত্রা আবার বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত ঈদুল ফিতরের পর সংক্রমণের মাত্রা বেড়েছিল আশঙ্কাজনক হারে। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সংক্রমণের মাত্রা বাড়লেও তা সামাল দেয়ার সামর্থ্য স্বাস্থ্যখাতের আছে।
গত তিন মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন করোনা পরীক্ষা হয়েছে গত রবিবার, মাত্র তিন হাজার ৬৮৪টি। করোনা শনাক্ত হয়েছেন ৮৮৬ জন। পরদিন সোমবার চার হাজার ২৪৯ জনের নমুনা পরীক্ষায় এক হাজার ৩৫৬ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
সরকারিভাবে করোনা পরীক্ষার জন্য ফি নির্ধারণ, দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা, টেস্ট করতে ভোগান্তি, টেস্টের রিপোর্ট পেতে দেরিসহ নানা কারণে দেশে করোনার পরীক্ষা কমেছে, এতে কমেছে শনাক্তও। সাধারণত, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার দুই সপ্তাহের ভেতরে লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশ পায়। আর ঈদের সময়ে ঢাকা থেকে মানুষের গ্রামে যাওয়া, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে পশুর হাট যাওয়া, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কোরবানিও দিয়েছে মানুষ। যার কারণে মধ্য আগস্টে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন মনে করছেন এবারের ঈদ ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ এ ঈদেই মানুষ গ্রামের বাড়ি বেশি যায়, পশুর হাট বসেছে। কতজন সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোরবানি দিয়েছেন সেটাও আতঙ্কের একটা জায়গা। তাতে করে এবারে সংক্রমণের হারটা বেশি হবে।
খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও গতকাল এক অনুষ্ঠানে এই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘ঈদে অনেক লোকজন বাড়ি গেছে, বিভিন্ন স্টিমারে গেছে, বাসে গেছে। আমরা দেখেছি যে, গাদাগাদি করে ফেরিতে পার হয়েছে। আমরা একটু আশঙ্কা করছি, কিছুটা সংক্রমণ বাড়তে পারে।’
এদিকে গতকাল নতুন করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সেখানে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সরকারি বিধিনিষেধ ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ওই প্রজ্ঞাপনে বাড়ির বাইরে বের হলেই মাস্ক পরা ও পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তবে এ ধরনের বিধিনিষেধগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ থাকছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ এখন আর তেমনটা দেখা যায় না।
এ কারণে এই বিধিনিষেধগুলো মানতে জনসম্পৃক্ততা তৈরি করা যাচ্ছে না বলে জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ। তিনি বলেন, ‘যদি জন-সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে কাগজে কলমে এসব নিয়ম জারির কোনো মানে নেই।’
বিধি নিষেধ জারি করলেও সেগুলো কার্যকর করার ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারকদের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, যদি জেলা উপজেলা পর্যায়ে দায়িত্বশীলদের মধ্যে যদি দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়, তাহলে ছোট বড় প্রতিটি এলাকায় স্থানীয় মানুষদের সম্পৃক্ত করা সম্ভব হবে। যদি সমন্বিত ব্যবস্থা না হয় তাহলে এগুলো কথার কথাই থাকবে। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে খুব একটা সহায়ক হবে না। কারণ নীতি নির্ধারকদের ওপরই নির্ভর করবে জনগণ মানবে কি মানবে না।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার শুরুতে জন সচেতনতা দেখা গেলেও এখন তাতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। তার উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, এবারে বিপুলসংখ্যক মানুষ বিশেষত ঈদের আগে গণপরিবহনগুলোয় কোনো সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখেই গাদাগাদি করে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় ভ্রমণ করেছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়াও অনেকেই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসছেন। এজন্য নতুন করে করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে স্বাস্থ্য সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।