ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কড়া সমালোচনা করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মামলার ভয়ে আজ জাতির কণ্ঠ রুদ্ধ। বিবেকের স্বাধীনতা শৃঙ্খলিত। যা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।
শুক্রবার সকালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ নিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরতে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, এখন পর্যন্ত এই আইনে করা মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে সরকারি দলের লুটেরাদের বিরুদ্ধে কথা বললে, রাজনৈতিক মত প্রকাশ করলে, সরকারের সমালোচনা করলে মামলা করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে ফখরুল বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা হরণের সরকারি নীলনকশার চিত্র তুলে ধরতে চাই। মত প্রকাশ ও বিবেকের স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই মৌলিক অধিকার, চিন্তা চেতনার অধিকার, মতপ্রকাশ ও বিবেকের স্বাধীনতাকে বৈষম্যমূলকভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত অপমান করা হচ্ছে, যার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’র দেয়া তথ্য তুলে ধরে ফখরুল বলেন, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৫৩ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করে হয়রানি করা হয়েছে। প্রায় সবগুলো মামলার কমন অভিযোগ হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মত প্রকাশের জন্য তথাকথিত সম্মানহানি বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপরাধ।
বিএনপি মহসচিব বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন ২০২০ সাল পর্যন্ত ১২ জন সাংবাদিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ইতোমধ্যে সংবাদপত্র- সম্পাদক পরিষদ তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’র জন্য সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে লিখতে পারছেন না। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই কালো আইন বাতিলের দাবি তুলেছে। বিএনপি শুরু থেকেই বলে এসেছে এই আইন কালো আইন। এই আইন সংবিধান বিরোধী এবং এই আইন জনগণের কণ্ঠ রোধ করার জন্য সরকারের হাতিয়ার। সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এই আইন করেছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, মানবাধিকার সংস্থার তথ্যমতে ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) কার্যকর রয়েছে। আর্টিকেল ১৯-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের ২২ জুন পর্যন্ত মোট মামলা হয়েছে ১০৮টি। এই সব মামলায় মোট আসামি ২০৪ জন। তাদের মধ্যে সাংবাদিক ৪৪ জন, আর অন্যান্য পেশায় কর্মরত ও সাধারণ মানুষ ১৬০ জন। এই হিসেবে প্রায় ২৫ ভাগ আসামিই হলেন সাংবাদিক। এরমধ্যে মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১০, ফেব্রুয়ারিতে ৯, মার্চে ১৩, এপ্রিলে ২৪, মে-তে ৩১ এবং জুন মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত ২১টি মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। আর্টিকেল ১৯ অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে ৬৩টি। ২০১৮ সালে ডিএসএ এবং আইসিটি অ্যাক্ট মিলিয়ে মামলা হয়েছে ৭১টি।
ফখরুল বলেন, তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালে এক বছরে মোট মামলা হয়েছে ৬৩টি। আর সেখানে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই মামলা হয়েছে তার চেয়ে বেশি ১০৮টি। আর সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের তথ্যমতে বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ। কারণ অনেক মামলার খবরই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয় না। তাই মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তার খোঁজ পায় না। ফলে তাদের সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, বাংলাদেশে একটি মাত্র সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল আছে ঢাকায়। ডিজিটাল এবং তার আগের আইসিটি আইনের সব মামলার হিসাব আছে সেখানে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, এই বছরের মার্চ পর্যন্ত ডিজিটাল আইনে মামলা হয়েছে মোট ৩২৭টি। জানুয়ারি মাসে মোট মামলা হয়েছে ৮৬টি। এরমধ্যে থানায় ৪১টি এবং আদালতে ৪৫টি। ফেব্রুয়ারি মাসে হয়েছে ১১৯টি মামলা। থানায় ৯৫টি এবং আদালতে ৩৪টি। মার্চ মাসে মামলা হয়েছে ১২২টি। এরমধ্যে থানায় ৭৫টি এবং আদালতে ৩৭টি। ২০১৯ সালে মোট মামলা হয়েছে এক হাজার ১৮৯টি। এর মধ্যে থানায় ৭২১টি এবং আদালতে ৪৬৮টি। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫৫০টির মতো মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। বিচারাধীন মামলা আছে এ পর্যন্ত মোট এক হাজার ৯৫৫টি। এরমধ্যে থানায় দায়ের করা এক হাজার ৬৬৮টি এবং আদালতে ২৮৭টি। ৫৫টি মামলা হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত আছে।
ফখরুল বলেন, এই আইনের নগ্ন শিকার হয়েছেন অন্যান্যদের মধ্যে ৮৫ বছরের বেশি বয়সের সম্পাদক আবুল আসাদ, সাংবাদিক কাজল ফকির, নেত্র নিউজের সম্পাদক তাসনিম খলিল, ব্যবসায়ীসহ অজস্র নিরীহ নাগরিক। আমরা অবিলম্বে তাদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি।
ফখরুল বলেন, এই আইনে হয়রানির অন্যতম একটি দিক হলো, সারা বাংলাদেশে একটি মাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনাল যা ঢাকাতে অবস্থিত। এই আইনের অধীনে কোনো আপিল ট্রাইব্যুনাল এখন পর্যন্ত গঠিত হয়নি। ফলে প্রত্যন্ত গ্রামঞ্চলের কোনো ব্যক্তি বা সাংবাদিক ফেইসবুকে সরকারের লুটপাটের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা করলে, তার বিরুদ্ধে মামলা সংশ্লিষ্ট থানা করলেও তার বিচার হবে ঢাকায় অবস্থিত একমাত্র সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে। একবার ভাবুন ন্যায়বিচার কতটা দুরূহ করেছে এই স্বৈরাচার।