ইতিহাসের পাতা আতিপাতি করে খুঁজেও এতটা বাজে পাওয়া গেলো না বার্সেলোনাকে। দলটির অভ্যন্তরে যে কি চলছে, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো বার্সেলোনা। অগোছালো মেসিদের নিয়ে স্রেফ ছেলেখেলা করল বায়ার্ন মিউনিখ। পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে মেসিদের জালে গুনে গুনে আটবার বল জড়ালো জার্মান জায়ান্টররা। নিজেদের জালে নিজেরাই জড়িয়েছে একবার।
১০ গোলের ম্যাচে ৯টি’ই দিলো বায়ার্ন। বার্সার হয়ে একটি মাত্র গোল করতে পেরেছেন লুইস সুয়ারেজ। শেষপর্যন্ত লিওনেল মেসির বার্সেলোনাকে ৮-২ গোলের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে উঠল বায়ার্ন মিউনিখ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে নকআউট পর্বে এই প্রথম এতবড় একটি জয় পেলো বায়ার্ন।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাবেক ডিফেন্ডার রিও ফার্ডিনান্ড বার্সার খেলা দেখে মন্তব্য করলেন, ‘সত্যিকার অর্থেই নৃশংস পরিস্থিতির মুখোমুখি বার্সা, স্ট্রিম রোলার চালানো হলো তাদের ওপর। পুরোপুরি বোকা বানিয়ে ছেড়ে দেয়া হলো তাদের।’
ম্যাচ শেষ হওয়ার আগেই লিওনেল মেসি, লুইস সুয়ারেজদের মুখখানা হয়েছিল দেখার মত। চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসবে যেন। আর কোচ কিকে সেতিয়েন তো টেন্টের ওপর দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে যেভাবে আকাশের দিকে তাকিয়েছেন, তাতেই নিশ্চিত হওয়া গেছে, ন্যু ক্যাম্পে আর হয়তো ফেরা হবে না তার। এর আগেই বিদায়ের চিঠি হয়তো ধরিয়ে দেয়া হবে।
খেলায় জয়-পরাজয় থাকবেই। কিন্তু এভাবে স্রেফ আউটক্লাস হয়ে যাওয়া, বার্সার ক্ষেত্রে একেবারেই বেমানান। বায়ার্ন-বার্সা ম্যাচটি দেখে ২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে বেলো হরাইজন্তে ব্রাজিল বনাম জার্মানির ম্যাচটির কথাই মনে পড়েছে সবার। ঐ ম্যাচে যেমন জার্মানির খেলার সামনে ব্রাজিলিয়ানরা দাঁড়িয়ে ছিল, ঠিক তেমনি আজও বার্সার খেলোয়াড়রা যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল তাদের জালে বায়ার্নের গোল উৎসব।
মুলার, পেরিসিক, লেওয়ানডস্কি, গিনাব্রি, কিমিচরা গোল করে যাচ্ছিলেন। শেষ দিকে যোগ হলেন বার্সারই ঘরের ছেলে কৌতিনহো। একের পর এক বঞ্চিত করে লোনে বায়ার্নের কাছে দিয়ে দেয়ার কারণে কৌতিনহোকে নামতে হয়েছে বার্সার বিপক্ষেই এবং শেষ দুটি গোলও করলেন তিনি।
গোল করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লো যেন খোদ বায়ার্নই। শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে বার্সাকে ৮-২ গোলের অবিশ্বাস্য ব্যবধানে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠলো বায়ার্ন মিউনিখ।
প্রথমার্ধেই গোল হয়েছে মোট ৫টি। পরের অর্ধে ৫টি। মোট ১০টি। এর মধ্যে ৯টিই দিলো বায়ার্ন মিউনিখ। কিন্তু ম্যাচের স্কোরলাইন ৮-২। একটি গোল বায়ার্ন নিজেদের জালে যদি না জড়াতো, তাহলে বার্সার ভাগে গোলের পাল্লা থাকতো মাত্র একটি। যেটি এসেছিল লুইস সুয়ারেজের পা থেকে।
ম্যাচটিকে সবাই ধরে নিয়েছিল, ফাইনালের আগে আরেক ফাইনাল হিসেবে। বার্সেলোনা এবং বায়ার্ন মিউনিখের খেলা বলে কথা। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই তো হবেই!
কিন্তু মাঠের খেলায় বার্সাকে খুঁজে পাওয়াই ছিল কঠিন। লিওনেল মেসিরা মাঠে নেমেছিলেন যেন শুধু বায়ার্নের আক্রমণ ঠেকানোর জন্যই। নিশ্চিত আরও কয়েকটি গোলের সুযোগ মিস না হলে স্কোরলাইন আরও বাজে হতে পারতো। লিখতে হতো হয়তো, বার্সার জালে একের পর এক গোল দিয়েই গেলো বায়ার্ন।
প্রথমার্ধের খেলা দেখে মনে হচ্ছে, বার্সেলোনার ডিফেন্স বলতে কিছুই নেই। মাঝমাঠে ভিদাল আর বুস্কেটস ওপরে-নিচে দৌড়াচ্ছেন শুধু। মেসি বারবার জায়গা পরিবর্তন করে চেষ্টা করছেন একটা-দুটা বল পাওয়া যায় কি না। সুয়ারেজ মাঠে ছিলেন কি না দেখা গেছে শুধুমাত্র প্রথমার্ধের শেষ দিকে বায়ার্নের পোস্টে একটি শট নেয়ার পর। বলা বাহুল্য, সেই শট কোনো কাজেই আসেনি।
মেসি ওয়ান-টু-ওয়ান একটি বল পেয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সামনে ছিলেন শুধু গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নুয়্যার। কিন্তু তার বাম পায়ের শটটি ট্রেডমার্ক শট ছিল না। সুতরাং, জালের দেখা পায়নি মেসির সেই শট। ওই একটি ছাড়া পুরো ৪৫ মিনিটে আর শটই নেয়ার সুযোগ মেলেনি মেসির।
প্রথম থেকেই এক তরফা খেলছে বায়ার্ন আর বার্সা। দেখে মনে হচ্ছিল পাড়ার বড় ভাই আর ছোট ভাই খেলছে। ছোট ভাইয়ের কাজই হলো বড় ভাইয়ের আক্রমণ ঠেকানো। যার ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল ম্যাচের একদম প্রথম দিকে।
৪র্থ মিনিটেই বার্সার জালে বল জড়িয়ে দেন বায়ার্নের থমাস মুলার। রবার্ট লেওয়াডস্কির পাসকে আলতো পায়ে বার্সার জালে ঠেলে দিলেন মুলার। খেলার সপ্তম মিনিটে নিজেদের জালেই বল জড়িয়ে দেন ডেভিড আলাবা। ব্যবধান ১-১।
২১তম মিনিটে ইভান পেরিসিক বাম পায়ের দারুণ এক প্লেসিং শটে বার্সার জালে বল জড়ান। গোলরক্ষক টার স্টেগান ঝাঁপিয়ে পড়ে, পায়ে ঠেকিয়েও পারেননি গোল ঠেকাতে। ২৭ মিনিটে সার্জি গিনাব্রি বক্সের মাঝ বরাবর থেকে ডান পায়ের শটে বল জড়িয়ে দেন বার্সার জালে। গোরেৎজকার পাস থেকে বল পেয়েছিলেন তিনি।
৩১ মিনিটেই ৪-১ ব্যবধান করে ফেলেন থমাস মুলার। ডান কর্নার থেকে জসুয়া কিমিচের দারুণ একটি পাস থেকে আসা বলে শুধু পা ঠেকিয়ে দেন মুলার। টার স্টেগানকে ফাঁকি দিয়ে বলটা জড়িয়ে গেলো মেসিদের জালে। হয়ে গেলো ৪-১।
প্রথমার্ধ শেষ হলো ৪-১ ব্যবধানে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা নিতে চাইলো বার্সা। যার ধারাবাহিকতায় ৫৭ মিনিটে গোল করে বসেন লুইস সুয়ারেজ। মাঝ মাঠ থেকে মেসির লম্বা পাস থেকে জর্দি আলবা বলটা রিসিভ করে দেন সুয়ারেজকে। একজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে দারুণ গোলটি করেন তিনি।
এরপরই যেন পুনরায় জ্বলে ওঠে বায়ার্ন। ৬৩ মিনিটে আলফনসো ডেভিস যে গোলটি তৈরি করে দিয়েছিলেন তা অবিশ্বাস্য। মাঝ মাঠ থেকে লেফট উইং ধরে বল নিয়ে এসে পুরো বার্সা ডিফেন্সকে একা কাটালেন। এরপর ছোট বক্সের মাঝ থেকে যেভাবে কয়েকজনকে ফাঁকি দিয়ে পাসটি দিলেন, সেটাই ছিল অবিশ্বাস্য। জসুয়া কিমিচ শুধু পা’টা লাগিয়ে গোল করলেন।
৭৫ মিনিটে সার্জি গিনাব্রির পরিবর্তে মাঠে নামেন ফিলিফ কৌতিনহো। নেমেই যেন বার্সাকে কিছু দেখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন মনে করলেন তিনি। যার ফলে ৮২ মিনিটে ডি-বক্সের সামনে থেকে অসাধারণ একটি ক্রস করেন সেটাতেই মাথা লাগিয়ে গোল করেন রবার্ট লেওয়ানডস্কি।
এরপর নিজেই গোল করেন কৌতিনহো। ৮৫ মিনিটে মুলারের পাস থেকে ভেসে আসা বলকে ডান পায়ের শটে জড়িয়ে দেন বায়ার্নের জালে। এরপর ৮৯ মিনিটে আবারও গোল করেন কৌতিনহো। শেষ পর্যন্ত ৮-২ গোলে বার্সাকে হারিয়ে সেমিতে উঠে যায় বায়ার্ন।