১৫ আগস্টের শোক গাঁথা

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী

১৫ আগস্টের শোক গাঁথা
ফাইল ছবি

দুঃখ, বেদনা আর অন্তহীন শোক নিয় শোকের মাস আগস্ট আবার আমাদের জীবনে হাজির হয়েছে। শুধুমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশের নয়, বাঙালির ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ড ঘটেছিল এই মাসের ১৫ তারিখে। এটি মানবতিহাসেরও অন্যতম নৃশংস হত্যাকান্ড। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছিল একদল ঘণ্য হায়েনা, যাদের মধ্যে রাজনীতিবিদ আর সেনাবাহিনীর এক দলছুট ঘাতকদলও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করেছিল। তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানী ভাবাদর্শে ফিরিয়ে নিতে, মুক্তিযুদ্ধের সুফলকে ও আদর্শকে মুছে ফেলতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল। কারণ তারা জানত যে, বঙ্গবন্ধুকে সশরীরে হত্যা না করতে পারলে রাষ্ট্র ক্ষমতা তাদের হাতে আসবে না এবং ভাবাদর্শগতভাবে তারা সফলকাম হবে না।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মতাদর্শগত ভাবেই পাকিস্তানী রাষ্ট্রনৈতিক ও রাজনীতির বিরোধী ছিলেন। তাঁর ‘‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’’, ‘‘কারাগারের রোজ নামচা’’, ‘‘আমার দেখা নয়া চীন’’ যাঁরাই মনোযাগ দিয়ে পাঠ করেছেন তাঁরা সবাই আমার সাথে একমত পোষণ করবেন। ১৯৩৯ সনে গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনীতির সূচনা হয়। এর পর থেকে শাহাদৎ বরণের সময় পর্যন্ত তিনি ৩৬ বছর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কখনও রাজনীতির সক্রিয় মাঠ থেকে সরে দাঁড়াননি বা বিচ্ছিন্ন হননি। এই সময়ের অতিক্রমনেই তিনি ছাত্ররাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। ছিলেন একজন এজিটেটর, ক্রমশ: হয়ে উঠেন নেতা। টুঙ্গিপাড়া আর গোপালগঞ্জের ছাত্র-যুব কর্মীদের ‘মিয়াভাই’ হয়ে যান ‘মুজিবভাই’। চূয়ান্নর নির্বাচনের পর (১৯৫৪) হয়ে যান ‘শেখ সাহেব’। এই মুজিবভাই আর শেখ সাহেবই আমাদের বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতা। পরিবার পরিজন বা আত্মস্বার্থ নয়, মানুষের কল্যাণ তথা বাঙলার মানুষের কল্যাণই যার স্বপ্ন, সাধনা আর ধ্যান-জ্ঞান। তাঁর ভাষায় “As a man, what concerns mankind concerns me. As a Bengalee, I am deeply involved in all that concerns Bengalees. This abiding involvement is born of and nourished by love, enduring love, which gives meaning to my politics and to my very being.”
Sheikh Mujibur Rahman
30.05.73

তাঁর এই জীবন দর্শন তিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে প্রমাণ করে গেছেন। ছাত্র রাজনীতির হাতে খড়ি মুসলিম লীগ দিয়ে হলেও সাম্প্রদায়িকতা কখনও তাঁকে স্পর্শ করেনি। অথচ পাকিস্তানের ভিত্তিই ছিল সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি। সে কারণই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বৎসরান্ত অতিক্রম করার আগেই তাঁর মোহবঙ্গ হয়েছিল। নেতা হোসন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রতি অবিচল আস্থাবান থাকলেও শিষ্য শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মোহমুক্ত। তাই তো ১৯৬৬ সনের ফেব্রুয়ারীতে তিনি ৬ দফা দাবী নামা নিয়ে বাঙালির স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সূচনা করতে পেরেছিলেন।

অসাম্প্রদায়িক চিন্তা, গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল আস্থা, বাঙালির সার্বভৌম ক্ষমতায় বিশ্বাসী শেখ মুজিব রাজনীতি থেকে, রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে ধর্মকে দূরে রাখতে চেয়েছিলন। তাই তিনি গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মূলনীতি হিসবে (বাঙালি) জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র (শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজ) ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে স্থান দিয়েছিলেন। এই মূলনীতি চতুষ্ঠয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরও ভিত্তি। বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অভিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য।

পনের আগস্টের ঘটনাবলির শুধুমাত্র একটা ঘৃণ্য দিকই উন্মোচিত হয়েছে। দলছুট সামরিক কর্মকর্তাদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করে শায়েস্তা করা সম্ভব হয়েছে। ঘাতকদের কেউ কেউ এখনও পর্যন্ত শাস্তি ভোগ না করলেও আদালতে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু রাজনীতিবিদদের চক্রান্তকে আজও অব্দি পুরোদস্তুর পাদপ্রদীপের আলোতে আনা সম্ভব হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বা মুক্তিযুদ্ধের নেতত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগও তা করেনি। গতানুগতিকতার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

পঁচাত্তুরের (১৯৭৫) পনের আগস্টে ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তাঁর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে পাকিস্তানী ভাবধারায় দাঁড় করাতে অপপ্রয়াস পায়। দুর্ভাগ্যবশত : সাংগঠনিক ও অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটকৌশলের কারণে আওয়ামী লীগ এবং সদ্য গঠিত বাকশাল কোনটাই বঙ্গবন্ধু হত্যার (তাঁর পরিবার পরিজন ও রাজনৈতিক সহকর্মী যাঁরা শাহাদৎ বরণ করেছিলেন) বিরুদ্ধে কোনরূপ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। কিছু ছাত্র-যুব কর্মী (যাঁরা ছিলেন নেতৃত্বের তৃতীয়-চতুর্থ স্তরে) ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিবাদের যে ক্ষুদ্র প্রয়াস পায়, তাতেও প্রথম ও দ্বিতীয় সারির আওয়ামী নেতৃত্বের নিকট থেকে কোন সাড়া ও সমর্থন পায়নি। আমরা মুষ্টিমেয় কয়েকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সারা দেশ ভ্রমণ করেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাঙ্গনের অন্যান্য স্থানে মিছিল সংগঠিত করার প্রয়াস পেয়েছি (যদিও আমাদের অনেকেই সিদ্ধান্ত সত্বেও মিছিলে যাননি) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে যাত্রা করে ‘বঙ্গবন্ধু ভবন’ পর্যন্ত রাজপথের মিছিল সংগঠিত করেছি।

আমাদের কতিপয় বন্ধু কাদের সিদ্দিকীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধও গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছিলন। এ সময়টাতে আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা স্বপরিবারে ভারতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন। তিনি নির্বাসনে থেকেও দেশের অভ্যন্তরে কি ঘটছে তা জানার চেষ্টা করেছেন। সেনা শাসক জিয়া ঘরোয়া রাজনীতির অনুমোদন দিলে আওয়ামী লীগের বড় বড় সাহেবরা খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছিলেন। এবং মূলধারার আন্দোলনকারীদেরকে (পঁচাত্তুর পরবর্তী আন্দোলনকারীদেরকে) বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে নানা তৎপরতায় লিপ্ত হন। ঘরোয়া রাজনীতির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ধানমন্ডিতে রংপুরের মতিউর রহমান সাহেবের বাড়িতে। শোক প্রস্তাবে শেখ কামালের নাম নেই। কথা বলতে হল আমাকে । তাঁর নাম, শোক প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দলকে ‘বাকশাল’ নয় আওয়ামী লীগ হিসেবে পুনর্গঠনের প্রস্তাবও আমার এবং তা গ্রহণ করা হয়।

তৎপরতা শুরু হল সেনা শাসক জিয়ার ইচ্ছানুযায়ী আওয়ামী লীগের ঘোষনাপত্র ও গঠনতন্ত্র তৈরীর অপপ্রয়াস। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, শামসুদ্দিন মোল্লা ও মোল্লা জালালউদ্দিন এর নেতৃত্বে ছাত্র-যুব নেতাকর্মীদের প্রবল বাঁধার মুখে মিজান চৌধুরী, মালেক উকিল গং এর অপতৎপরতা ব্যর্থ হয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ভিত্তিতে দেশ পুনর্গঠনের প্রত্যয় ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র সরকারের বরাবর জমা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, সরকারের অনুমোদন উপক্ষা করেই সাংগঠনিক তৎপরতা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা মাঠে থাকার প্রত্যয় দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কর্মতৎপর হয়ে উঠি। পরবর্তী ও আজকের আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেরই সেদিন কোন খোঁজ ছিল না। পাকিস্তানী ভাবধারা পুষ্ট মোশতাকপন্থীরা পঁচাত্তর পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ যেমন দখল করে নিয়েছিল অনকাংশই (যা পনেরই আগস্ট পরবর্তী ঘটনা প্রবাহই প্রমাণ করে), অনুরূপ পাকিস্তানী ভাবধারার রাজনীতিও অনেকের আশ্রয় প্রশ্রয়ে লালিত পালিত হয়ে ক্রম মহিরুহের রূপ ধারণ করেছে।

ফলাফল রাজনীতিতে দুর্বত্তায়ন ও দুষ্টচক্রের দাপট। এ দাপটের কারণে সর্বত্র আজ অন্ধকারের কালো ছায়া। পনের আগস্ট পরবতী সীমিত আকারের প্রতিরোধ আন্দোলন সংগ্রামে যারা সেদিন ঘরে বসে বসে কাজ করেছে তারা আজও ঘরে বসে বসেই রাজা উজির মারছে। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। রাজনীতি এখন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে নেই। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র আর ধনিক-বণিকদের হাতে চলে গেছে রাজনীতি। রাজনীতির বাণিজ্যিকরণ হয় গছ। পাকিস্তানি ধারায়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছে ক্রমান্বয়ে। তাই চারিদিকে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবশ বিদ্যমান।

যে কারণে আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতক পূর্বে বঙ্গবন্ধুর শাহাদৎ হয়েছিল সকল লক্ষণই আজকের বাংলাদেশে দৃশ্যমান। নেত্রীর শ্রম, নিষ্ঠা, একাগ্রতার সাথে তাল মিলাতে পারছে না, অথচ তারাই দলের কান্ডারি। রাষ্ট্র আর সরকার পরিচালনায় অরাজনীতির প্রাধান্য। সমৃদ্ধি হয়তো আসছে, কিন্তু সে সমদ্ধির স্থায়ীত্ব নিয়ে সংশয় আছে। রাজনীতি আর অর্থনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দুর্বত্তায়ন সকল সীমা ছাড়িয় গেছে। তবে সময় হয়তো কখনও চলে যায়নি। লাগাম টেনে ধারার সময় এখনও আছে। কি কাজটা একাই করতে হবে তাঁকে, নেত্রী শেখ হাসিনাকে। কেননা তাঁর চার পাশ অর্থগৃধনু মৌ-লোভী লোকদের ভিড় যোগ্য ও সফল রাজনীতিকের বড়ই অভাব (অবশ্য) পদ প্রাপ্তি যদি যোগ্যতার মাপকাঠি হয়, তবে ভিন্ন কথা)। এরা শুধু রাজনৈতিক দুর্বত্তদেরই পৃষ্ঠপোষক এবং রাজনীতির বাণিজ্যিক কারবারীদের সহায়ক।

তাই, আমরা মনে করি দ্রুত কিছু ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, যাতে করে রাজনীতির মাঠটা আদর্শিক রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত হয় এবং রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় রাজনীতির সুস্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কেননা রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা রাজনীতির বিষয়। ব্যবসায়িক বিষয় নয়। সংসদ, মন্ত্রিসভা, প্রশাসনের যেখানে রাজনৈতিকরণের সুযোগ আছে সে সব জায়গায় রাজনীতির প্রাধান্য সুনিশ্চিত করতে হবে। দলকে সুসংগঠিত করার যোগ্যতা রাখে এমনদেরকে দিয়ে দলকে ঢেলে সাজানো দরকার। আদর্শহীন কান্ডজ্ঞানহীন দরবারীদের হাত থেকে রাজনীতিকে উদ্ধার করা দরকার। লুটেরা ও তঞ্চক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের হাত থেকে অর্থনীতিকে উদ্ধার করা দরকার। যার যা কাজ তাকে সে কাজ করতে দেওয়া উচিৎ। এবং এ সকল বিষয়েই সিদ্ধান্ত তাঁকেই, শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে। আমরা বাংলাদেশের পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীতের আড়ালে পাকিস্তানী ভাবধারার পুনর্বাসন চাই না। বৈষম্যহীন অর্থনীতি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, গণতান্ত্রিক আর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ার সংগ্রামই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ। এই আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাব, পনের আগস্টের শহীদদের রক্তের শপথ এটাই।
জয় হউক মুজিবাদর্শের।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখকঃ যুদ্ধাহত মুক্তিযাদ্ধা ও রাজনৈতিক কর্মী।
সম্পাদক, মত ও পথ।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে