জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামাল জন্মেছিলেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট। যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে এখন তাঁর বয়স হতো ৭১ বছর। কিন্তু বেঁচে থাকতে পারেননি। মাত্র ২৬ বছর বয়সে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। এই সামান্য বয়সেও তাঁর কীর্তি ছিল ব্যাপক এবং অনেকের কাছে ঈর্ষণীয়। আমি নিশ্চিত যে তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশের কোথাও বয়সের সঙ্গে মিলিয়ে ৭১ কেজি ওজনের কেক কাটা হবে না। কারণ এই বদ্-কালচারটি বঙ্গবন্ধু পরিবারে নেই। সেদিন বিভিন্ন জায়গায় দোয়া হবে, কোথাও কোথাও আলোচনা সভা হবে, কোনো কোনো পত্রিকায় স্মৃতিচারণামূলক প্রতিবেদন ও উপসম্পাদকীয় ছাপা হবে। এর সবগুলোই হবে অনাড়ম্বর কিন্তু আন্তরিক। সেখানে বিজ্ঞ আলোচক ও বক্তারা শেখ কামালের সাদাসিধা জীবন ও তাঁর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবদান চমত্কারভাবে তুলে ধরবেন। তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিকের অনেক অজানা তথ্য আমরা তাঁদের আলোচনা ও লেখা থেকে জানতে পারি।
এর প্রয়োজন রয়েছে। কারণ আমাদের দেশের বেশ কিছু মহল থেকে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অনেক আজগুবি অসত্য তথ্য নিরবচ্ছিন্ন ও সংগঠিতভাবে প্রচার করা হয়েছে জনমনে তাঁদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টির হীন উদ্দেশ্যে। তারা সফল হয়নি। কিন্তু তাদের প্রচার এখনো অব্যাহত রয়েছে। ইন্টারনেটে ঢুকলে এসব অপপ্রচার এখনো পাওয়া যায়, বিশেষ করে ধর্ম ব্যবসায়ী ও পাকিস্তান বেসড্ ওয়েব পেজগুলোতে। এসব অপপ্রচারের জবাবও অনেকে দিচ্ছেন, সত্যকে তুলে ধরছেন, কিন্তু তা খুব সংগঠিতভাবে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না। অথচ বিষয়টা অত্যন্ত জরুরি, বিশেষ করে তরুণসমাজের কাছে সত্যকে প্রকাশ করার জন্য।
শেখ কামাল সম্পর্কে যাঁরা লিখেছেন বা আলোচনা করেছেন তাঁরা একটি সত্য এখনো প্রকাশ করেননি। এটি তাঁদের না জানার কথা নয়। হয়তো তাঁর অনেক অবদানের ভিড়ে সেটি তাঁরা উল্লেখ করে ওঠতে পারেননি। সেটি হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ‘শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন’ নামে একটি আন্দোলন শুরুর কথা। আমার ও আমার বন্ধুদের সৌভাগ্য যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা শেখ কামাল, আমাদের কামাল ভাইকে সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলাম। তিনি সোশিওলজির আর আমরা অন্যান্য বিভাগের। তিনি ক্লাসমেট ছিলেন না, ছিলেন ব্যাচমেট। সৌভাগ্য এ জন্য যে তিনি ছিলেন সেই সময় আক্ষরিক অর্থেই একজন লিজেন্ড। কিন্তু তা শুধু বঙ্গবন্ধুর সন্তান বলেই নয়। তিনি ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে মাঠ পর্যায়ে রাজপথে অংশ নিয়েছেন। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে তিনি অনায়াসেই ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা হতে পারতেন। কিন্তু কর্মীদের উপর্যুপরি অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি তা হননি। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন, তা-ও অন্যরা জোর করায়। পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শুধু সদস্য হয়েছেন। তিনি সাধারণ কিন্তু অত্যন্ত সক্রিয় কর্মীর মতো রাজপথে মিছিল করেছেন, স্লোগান দিয়েছেন, পুলিশের তাড়া ও কাঁদানে গ্যাস খেয়েছেন, আশপাশের সবাইকে উদ্দীপ্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি মিলিটারি বন্দি করার পর ছোট ভাইকে নিয়ে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছেন। অন্যদের সঙ্গে কঠিন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। নৈপুণ্যের জন্য আর্মির ওয়ারটাইম কমিশন পেয়েছেন। এরপর এইড-দ্য-ক্যাম্প (এডিসি) হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। বিজয় লাভের পর সামরিক বাহিনীতে না থেকে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে ফিরে এসেছেন। লেখাপড়ায় মনোনিবেশের পাশাপাশি ছায়ানটে গিয়ে সেতার বাজানো শিখতেন। খুব ভালো সেতার বাজাতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো বিভাগের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তুমুল উত্সাহ জোগাতেন। নাটকপাগল ছিলেন। তখন সদ্যঃস্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নাটকের গতানুগতিক ধারার বিপরীতে নব নাট্য আন্দোলন চলছিল। সেখানে নাটক উপস্থাপনায় চমত্কারিত্ব ছিল। জবরজং পোশাক, ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাক সিন ইত্যাদির বালাই ছিল না। ‘থিয়েটার’, ‘নাগরিক’ ইত্যাদি নতুন নাট্য দলের পাশাপাশি শেখ কামাল এই আন্দোলনকে আরো বেগবান করার জন্য ‘ঢাকা থিয়েটার’ নামে আরেকটি নাট্য দল গঠনে হাত লাগালেন। তখন থিয়েটার ও নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের পাশাপাশি ঢাকা থিয়েটারও বেশ কয়েকটি সাড়া-জাগানো ও জনপ্রিয় নাটক দর্শকদের উপহার দিয়েছিল। তিনি নিজে ভালো খেলতেন। বিশেষ করে ক্রিকেট ও বাস্কেটবলে ফার্স্ট ডিভিশন খেলোয়াড় ছিলেন। এমন একটি অফুরন্ত প্রাণশক্তির গতিময় বর্ণিল প্রতিভাধর ছাত্রটি আবার ছিলেন সাধারণ কম দামি পোশাকের অত্যন্ত বিনয়ী, ভদ্র ও সদালাপী । ভাবা যায়! তিনি তো লিজেন্ড হবেনই। এমন একজন লিজেন্ডের সহপাঠী হওয়া অবশ্যই সৌভাগ্যের ব্যাপার।
আমরা একসঙ্গে ১৯৬৭ সালে এসএসসি আর ১৯৬৯ সালে এইচএসসি পাস করলেও এবং একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও তাঁকে আমরা ‘কামাল ভাই’ ডাকতাম, কারণ তিনি ছিলেন আমাদের তিন বছরের বড়। না, তিনি খারাপ ছাত্র ছিলেন না যে উপর্যুপরি ড্রপ দেওয়ার কারণে আমাদের সঙ্গে চলে এসেছেন। বরং কারণটা ছিল কামাল ভাইয়ের স্কুলজীবনের প্রায় পুরো সময়টাই বঙ্গবন্ধুকে জেলে কাটাতে হয়েছে। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম পুরুষটি যখন একটানা জেলে থাকেন, তখন চরম আর্থিক দুর্দশায় নিপতিত পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটবে, এটাই তো স্বাভাবিক। পাকিস্তানি মিলিটারিদের সেটাও ছিল লক্ষ্য। কিন্তু কামাল ভাইয়ের মহীয়সী মা তা হতে দেননি। তিনি তীব্র আর্থিক কষ্টের মধ্যেও বাচ্চাদের লেখাপড়া বন্ধ হতে দিতে চাননি। পাকিস্তান সরকারের ভয়ে কোনো স্কুলও এই সন্তানদেরকে ভর্তি করত না। বাড়িওয়ালারা তাদেরকে বাড়ি ভাড়া দিতে চাইত না। সন্তানদের সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখা ও তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য মা প্রাণপাত করেছেন। তা সত্ত্বেও আর্থিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে কামাল ভাইয়ের জীবন থেকে তিনটি শিক্ষা বছর হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ জন্য কামাল ভাইয়ের কোনো খেদ ছিল না। বরং বাবার কাজের জন্য গর্ব ছিল। আর এ জন্য আমরা তাঁকে অন্তর থেকে আরো শ্রদ্ধা করতাম।
কামাল ভাইয়ের বিষয়ে জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনায় ও লেখায় উপরোক্ত সবগুলো বিষয়ই বিভিন্ন সংশ্লিষ্টজন আলোচনা করেছেন ও লিখেছেন। কিন্তু কামাল ভাইয়ের যে বিষয়টি কোনো আলোচনা বা লেখায় আসেনি আমি সেটি নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কামাল ভাই শিক্ষার পরিবেশ উন্নতকরণের জন্য যে কাজটি শুরু করেছিলেন তা বর্তমানেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং কিছুটা হলেও আলোচনার দাবি রাখে। সেই সময় যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা শিক্ষক ছিলেন তাঁরাও নিশ্চয়ই এ আলোচনায় আরো তথ্য যোগ করতে পারবেন।
কামাল ভাইয়ের নেতৃত্বে এই আন্দোলনের মূলকথা ছিল দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রথিতযশা শিক্ষকদের কাছ থেকে পাঠ নিচ্ছেন। এর পাঠ্যসূচি ও শিক্ষকরা যেমন উন্নত, শিক্ষার পরিবেশটুকুও তেমনি উন্নত হওয়া চাই। পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব সবটুকুই প্রশাসনের এমন ভাবলে চলবে না, শিক্ষার্থীদেরও এ ব্যাপারে অনেক কিছু করার আছে। তিনি এই আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আহ্বান জানালেন প্রতিটি বিভাগ থেকে সবচেয়ে মেধাবী তিনজন করে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের। কিন্তু এতে কোনো জোরাজুরি নেই। যদি কোনো মেধাবী শিক্ষার্থী এতে যোগ দিতে না চান, তাহলে তার পরের মেধাবীজন যোগ দেবেন। তিনিও না এলে তার পরের জন। আর স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হলো প্রতি বিভাগ থেকে একজন করে সবচেয়ে মেধাবী মুখ নিয়ে। এই প্রতিনিধিত্বকারী শিক্ষার্থীরা পুরুষ না মহিলা তা বিবেচ্য নয়। সবার অধিকার সমান। কেন্দ্রীয় কমিটি প্রতি মাসে একবার টিএসসিতে বৈঠকে বসবে। আর স্টিয়ারিং কমিটি বসবে প্রয়োজনমতো, তবে দুই সপ্তাহে অন্তত একবার। আবহাওয়া প্রতিকূল না থাকলে সভা বসার ব্যাপারে কামাল ভাইয়ের প্রথম পছন্দ ছিল খোলা মাঠ। আমরা এভাবে কলাভবন, কার্জন হল, সায়েন্স এনেক্স ও টিএসসির লনে ঘুরে ঘুরে অনেকবার বসেছি। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কেনা বাদাম আর চা ছিল আমাদের সভার নিত্যকার মেন্যু। সবার নাম মনে নেই। তবে আমাদের কার্জন হল এলাকার কয়েকজনের নাম এই মুহূর্তে মনে আসছে। যেমন—ফিজিকসের রকীব ও ইকবাল, অ্যাপ্লাইড ফিজিকসের তরীকুল, কেমিস্ট্রির জাহাঙ্গীর, বোটানির সানি, বায়োকেমিস্ট্রির রহমত ও মোসাদ্দেক, সয়েল সায়েন্সের এনায়েত, জিওলজির বদরুল, স্ট্যাটিসটিকসের খন্দকার, আইনের মকবুল প্রমুখ। এঁরা সবাই ছিল যার যার বিভাগের প্রথম শ্রেণিতে প্রথম বা দ্বিতীয়। আমি মেধাবীদের তালিকায় ছিলাম না। কিন্তু আমার বিভাগের বন্ধুরা স্টিয়ারিং কমিটিতে ফার্মেসি বিভাগের প্রতিনিধিত্বের জন্য আমাকেই মনোনীত করেছিল।
আরো একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়। তখন বেশির ভাগ মেধাবীই রাজনীতি বিমুখ ছিলেন না। তাই কেন্দ্রীয় কমিটি তো বটেই, এমনকি স্টিয়ারিং কমিটিতেও বেশির ভাগই ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজবাদী ছাত্রজোট প্রভৃতি সংগঠনের সদস্য। কিন্তু সবাইকে নিয়ে আন্দোলন করতে কামাল ভাই বা অন্যদের কারো কোনো সমস্যা হয়নি।
এই আন্দোলনের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নের দাবি। তখন বাণিজ্য অনুষদের সবগুলো বিভাগ ছিল কলাভবনে অবস্থিত। ক্লাসরুম খালি না থাকায় বিভিন্ন বিভাগের অনেক ক্লাস সময়মতো হতে পারত না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো বিভাগ অনেক জায়গা অপ্রয়োজনে দখল করে রাখলেও অনেকের প্রয়োজনীয় জায়গাটুকুও ছিল না। কার্জন হলের বিভাগগুলোরও অনেকের এই সমস্যা ছিল। মনে আছে, আমাদের ফার্মেসি বিভাগেই প্রয়োজনীয় ক্লাসরুমের অভাবে আজাদ স্যার, অর্থাত্ পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. এ কে আজাদ চৌধুরী, আমাদের ক্লাস নিতেন বিভাগের সামনের তমালগাছটির নিচে। ছাত্র সংখ্যার তুলনায় আবাসিক হলের সংখ্যাও যথেষ্ট ছিল না। সদ্যঃস্বাধীন দেশটির অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেও যথাসম্ভব জরুরিভিত্তিতে অবকাঠামো সম্প্রসারণের দাবিটি অত্যন্ত জোরালো হয়েছিল।
এখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আগের চেয়ে অনেক পরিচ্ছন্ন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ভবনের দেয়াল ও করিডরে কোনো দেয়াল লিখন বা স্লোগান চোখে পড়ে না। এখন স্লোগান লেখা হয় মূলত বাইরের দেয়ালে। কিন্তু সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি একাডেমিক ভবন, লাইব্রেরি, রেজিস্ট্রার বিল্ডিং, টিএসসি, আবাসিক হল ও রাস্তার পাশের দেয়ালগুলো ছিল দেয়াল লিখনে ও পোস্টারে কণ্টকিত। এমনটি শ্রেণিকক্ষের ভেতরেও স্লোগান লেখা বাদ ছিল না। সরকারি দল ও বিরোধী দল-নির্বিশেষে সব ছাত্রসংগঠনই তাদের বক্তব্য প্রচারের জন্য সভা-মিছিলের পাশাপাশি দেয়াল লিখনের ওপর জোর দিত। এসব লেখা সবগুলোই যে খুব রুচিসম্মত ছিল তা-ও নয়। ফলে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন ও দেয়ালগুলোর চেহারা ছিল কদর্য। এটি যে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ এবং তা কিছুটা পরিপাটি থাকাই বাঞ্ছনীয় সে বোধটুকু অনেকের মধ্যেই ছিল অনুপস্থিত। এই আন্দোলন থেকে সব সংগঠনকে অনুরোধ করা হলো সৌন্দর্য রক্ষার্থে ভবনগুলোর দেয়ালে বা অভ্যন্তরে পোস্টার না লাগাতে বা দেয়াল লিখন না করতে। প্রশাসনের কাছে দাবি করা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানে স্থানে বড় বোর্ড নির্মাণের, যাতে সবার স্লোগান লেখা যায় বা পোস্টার লাগানো যায়। এতে সৌন্দর্য রক্ষার পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীরাও বোর্ডগুলো থেকেই কোন সংগঠনের কী বক্তব্য তা সহজেই জেনে নিতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বড় না হলেও বেশ কয়েকটি পাকা বোর্ড বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করেছিল, যার দুটি এখনো কার্জন হল এলাকায় রয়েছে।
কলাভবনের সামনের বটতলার ঐতিহাসিক মূল্যের কথা ভেবে এখানে প্রায়ই বিভিন্ন সংগঠনের সভা হতো। সভা চলাকালীন মাইকের আওয়াজে কলাভবনে ক্লাস করা ছিল খুবই অসুবিধাজনক। আন্দোলন থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল ক্লাস চলার সময়ে এখানে সভা না করে মল চত্বরে সভা-সমাবেশ করার জন্য। বলা হয়েছিল এখানে থাকবে উন্মুক্ত মঞ্চ এবং অ্যাম্ফিথিয়েটারের মতো সিমেন্ট নির্মিত গোলাকার বসার ব্যবস্থা। এ জন্য উপাচার্যের বাসভবনের বিপরীতে মল চত্বরে স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল এবং ছাত্রলীগসহ কয়েকটি সংগঠন সেখানে বেশ কিছুদিন সভা করেছেও।
তখনো অপরাজেয় বাংলা নির্মিত হয়নি। আন্দোলন থেকে দাবি করা হয়েছিল মল চত্বরের মাঝামাঝি জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের একটি বড় স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণের। এখানেও থাকবে একটি মঞ্চ এবং এর চারপাশের বাগান শোভিত সবুজ প্রাঙ্গণে দর্শক-শ্রোতারা রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন থেকে তার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। তখনকার মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীর স্থাপন করা সেই ভিত্তি প্রস্তরটি এখনো বাণিজ্য ভবনের পশ্চিমে মল চত্বরে কোনোমতে টিকে আছে। নামের সঙ্গে মিল রেখে মল চত্বরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে সত্যি সত্যিই বাগান করা হয়েছিল। লাগানো হয়েছিল অনেক কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল, কনকচাঁপা, কামিনী, শিউলি ও মহুয়ার গাছ। এর রাস্তাগুলোর দুই ধারে লাগানো হয়েছিল সারিবদ্ধ ঝাউগাছ। বাগান পরিচর্যার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল চারজন মালি। কিন্তু কালক্রমে বাগানটি টেকেনি। শাহবাগের ফুলের দোকানিরা তোড়া বানাবার জন্য প্রতিদিন ভোরে এখানকার ঝাউগাছগুলোর ডাল ভাঙত নির্বিবাদে। এ ছাড়া আরেক উপদ্রব ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের গৃহপালিত অগুনতি গরু-ছাগলের এই বাগানে অবাধ বিচরণ। এভাবে এই বাগানটি বিনষ্ট হয়েছে। এখন মল চত্বরে সেই সময়কার মাত্র কয়েকটি কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল, কনকচাঁপার গাছ টিকে আছে। আর আছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার একটিমাত্র মহুয়ার গাছ।
মল চত্বরে বক্তৃতা মঞ্চ, অ্যাম্ফিথিয়েটার ও ভাস্কর্য নির্মিত না হলেও পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে অপরাজেয় বাংলা নির্মাণ করা হয়েছে, অ্যাম্ফিথিয়েটার নির্মিত হচ্ছে সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের সামনে, নতুন নতুন অনেকগুলো ভবন ও হল তৈরি হয়েছে, সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক উন্নতি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের দেয়ালগুলো ছাড়া একাডেমিক ভবনগুলোতে বা ক্লাসরুমে এখন আর কেউ স্লোগান লেখে না। প্রক্টরিয়াল নিয়ন্ত্রণের কারণে যত্রতত্র পোস্টার লাগানোর হারও এখন অনেক কম। সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও সুবিধাবলি এখন অনেক উন্নত। বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত আমাদের মাননীয় উপাচার্যদের এ জন্য অবশ্যই অভিনন্দন জানাই।
কিন্তু এখন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সভা-সমাবেশ-সম্মেলনগুলো বটতলা ছেড়ে আরো এগিয়ে কলাভবনের লাগোয়া অপরাজেয় বাংলায় এসে ঠেকেছে। সরকারি দল বা বিরোধী দল-নির্বিশেষে সবাই এখন এই ভাস্কর্যটিকেই মঞ্চ বানাচ্ছে। এর চারদিকে মাইক লাগানোর পর দুঃসহ শব্দে কলাভবন বা এর আশপাশে যখন ক্লাস নেওয়া দূরের কথা, হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক স্বাভাবিক স্বরে কথাও বলতে পারেন না, তখন কামাল ভাইয়ের কথা আর তাঁর নেওয়া শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনের কথা খুব মনে পড়ে।
কামাল ভাই সম্পর্কে আলোচনার সময় তাঁর অনেক অবদানের কথা সংগতভাবেই আলোচনায় আসে। কিন্তু তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনের কথা উল্লেখ না করলে ব্যাপারটি অসম্পূর্ণ থেকে যায় বলেই আমার বিশ্বাস। এই আন্দোলনের সঙ্গে আমার চেয়েও সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন এমন অনেকেই দেশে-বিদেশে এখনো কর্মরত আছেন। অনুগ্রহ করে তাঁরাও যদি এ বিষয়ে স্মৃতি হাতড়ে কিছু সংযোগ করেন, তাহলে কামাল ভাইয়ের এ অধ্যায়টি বিস্মৃতিতে হারিয়ে যাবে না।
এখানে আমি আরো দু-একটা প্রসঙ্গ নিয়ে নিজস্ব মন্তব্য রাখতে চাই। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার গুণটি তিনি পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকে। ১৯৬৭ সালে মাধ্যমিক পাস করেছেন শাহীন স্কুল থেকে। ১৯৬৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে পাস করেছেন উচ্চ মাধ্যমিক। ভালো ছাত্র না হলে তা সম্ভব হতো না। আর এই দুটি জায়গায়ই খেলাতে তিনি ছিলেন চৌকস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র অবস্থায় তিনি শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ক্রিকেট ও বাস্কেটবলে ফার্স্ট ডিভিশন প্লেয়ার হিসেবে জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড় ছিলেন তা আগেই বলেছি।
তিনি শুধু নিজে খেলতেন তা-ই না, অন্যদেরকেও খুব উত্সাহ দিতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে আন্ত বিভাগীয় বা আন্ত বিশ্ববিদ্যালয় যেকোনো খেলায় তিনি দর্শক সারিতে বসে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করতেন কোন বিভাগের কে ভালো খেলছে। পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে কথা বলতেন, পরামর্শ দিতেন কিভাবে আরো ভালো খেলা যায়, সে থাকে কোথায় এবং কোন ক্লাবে তার সংযুক্ত হওয়া উচিত এসব বিষয়ে। একসময় নিজেই প্রতিষ্ঠা করলেন ‘আবাহনী ক্রীড়া চক্র’ নামের আজকের বিখ্যাত ক্লাবটি। সেখানে একে একে যোগ দিয়েছিলেন সেই সব খেলোয়াড়রা। কামাল ভাইয়ের জীবদ্দশায়ই আবাহনী বেশ কিছু বিখ্যাত শিরোপা জেতে, যার ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত আছে। কামাল ভাইকে হত্যার পর অনেকে খেলোয়াড়ই এর অন্য রকম প্রতিবাদ এবং সহমর্মিতার কারণে বিভিন্ন ক্লাব ছেড়ে আবাহনীতে এসে যোগ দেন।
তখনকার দিনে খেলাধুলায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল আজকের তুলনায় কম। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও মেয়েদের নানাভাবে উত্সাহ দিত। কামাল ভাইও তার ব্যত্যয় ছিলেন না। তখন আমাদেরই ব্যাচমেট সুলতানা খুকি খেলাধুলায় অত্যন্ত নাম করেছিলেন। সংগত কারণেই কামাল ভাই তাঁকেও উত্সাহ দিতেন। সুলতানা তাঁর যোগ্যতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে মেয়েদের মধ্যে প্রথম ব্লু পান। আমাদের ব্যাচের হওয়ায় আমরাও এ জন্য ছিলাম আনন্দিত, কামাল ভাইও। কিন্তু কামাল ভাইয়ের যে মেয়েটিকে একটু বেশিই ভালো লাগত, যা ধীরে ধীরে তার প্রতি মুগ্ধতা ও হার্দিক দুর্বলতায় রূপান্তরিত হয়েছে, তা আমরা কখনোই টের পাইনি। কেউ যেন টের না পায় সেদিকে সম্ভবত তিনিও সতর্ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি ব্যাপক জনযুদ্ধের নায়ক, জাতির জনক, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ছেলে; নিজে একজন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর সহকারী, তিনি একটি মেয়েকে মনে মনে ভালোবাসেন, খুব ভালোবাসেন, যে কারণে অন্য মেয়েদের দিকে কোনো দিন ফিরেও তাকাননি, কিন্তু মুখ ফুটে কোনো দিন মেয়েটিকে তা বলেননি, সংকোচে বলতে পারেননি। ভাবা যায়! আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম না, কিন্তু কেউ কেউ অবশ্যই ছিল। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও কেউ এ বিষয়ে জানত না, এমনই লাজুক বিনীত ছিলেন তিনি। মাস্টার ডিগ্রি পরীক্ষার শেষে বাবা যখন বিয়ের জন্য তাগাদা দিলেন, জিজ্ঞেস করলেন কাউকে পছন্দ করে কি না, তখনো নাকি তিনি সংকোচ করছিলেন। বন্ধুদের কাছে শুনেছি, শেষে নাকি কাঁচুমাচু হয়ে মাকে বলেছিলেন। মা বলেছিলেন বাবাকে।
বাবাও কম বিনয়ী নন। সুলতানার বাবা ছিলেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী। তিনিও খুব ভালো মানুষ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নাকি নিজে ফুল-মিষ্টি নিয়ে বাসায় গিয়ে তাঁর কাছে ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেন। কোনো আত্মীয় বা এডিসির মাধ্যমে নয়। আবারও বলছি, এমনটা ভাবা যায়! বলদর্পী-ক্ষমতাগর্বী অনেক নেতাকেই তো আমরা দেখেছি, এখনো দেখি। ব্যক্তিত্বের বিশাল মহীরুহ ও তখনকার পৃথিবীতে ইয়াসির আরাফাত, জোসেফ ব্রজ টিটো, ফিদেল কাস্ত্রো, নেলসন ম্যান্ডেলা, নিকোলাই ব্রেজনেভ, আলেক্সেই কোসিগিন, ইন্দিরা গান্ধীদের সঙ্গে অন্যতম বিশ্বনেতা হিসেবে যে রাষ্ট্রনায়কের নাম উচ্চারিত হতো, বিশ্বময় জনপ্রিয়তায় যিনি ছিলেন এঁদের অনেকের চেয়েও বেশি এগিয়ে, সেই বঙ্গবন্ধুর এই ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধ দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম। তাঁর সাফল্য যে তিনি ছেলের মধ্যেও এই শুভবোধটুকু আত্মস্থ করাতে পেরেছিলেন। সন্তানের বাবা হিসেবে আজ বুঝি, আদর্শকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রবাহিত ও আত্মস্থ করাতে পারলে বাবা হিসেবে কতটা আনন্দ আর তৃপ্তি পাওয়া যায়। তবে সেই সঙ্গে তা গ্রহণের জন্য সন্তানকেও উপযুক্ত হতে হয়। কামাল ভাই মহান বাবার আদর্শে গড়ে ওঠা সে রকম উপযুক্ত সন্তানই ছিলেন।
আমরা সবাই জানতাম যে বঙ্গবন্ধুর পরে বাংলাদেশকে যাঁরা পরিচালনা করবেন তাঁদের মধ্যে কামাল ভাইও থাকবেন। হয়তো কোনো গুরুদায়িত্বেই থাকবেন। কিন্তু তা নিয়ে আমরা কখনো কথা বলতে চাইলে তিনি পছন্দ করতেন না, থামিয়ে দিতেন। রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতি কোনো লোভ তাঁর ছিল বলে কখনো মনে হয়নি। তিনি বরং সাধারণের মাঝে সাধারণ হয়ে থাকাই পছন্দ করতেন। তাঁর পোশাকে মার্জিত ভাব ছিল, জৌলুস ছিল না। কোনো অনুষ্ঠানে গেলে কালো শেরওয়ানি পরতেন। তাঁর সঙ্গে কখনোই দু-একজনের বেশি লোকজন থাকত না, নিরাপত্তার কারণেও না, কারণ সবাইকে তিনি যার যার কাজে চলে যেতে বলতেন। সারাক্ষণ তাঁর পেছনে ‘ছোট ভাইদের’ মিছিল থাকত না। যাতায়াত করতেন একটি সাধারণ পুরনো মোটরসাইকেলে, দৈবাৎ কখনো পুরনো টয়োটা গাড়িতে। মধুর ক্যান্টিন বা শরীফের ক্যান্টিনে কখনো বাকি জমাতেন না। স্বল্পাহারী ছিলেন। সবার সঙ্গেই হাসি-খুশি ছিলেন, বিরোধী পক্ষের সঙ্গেও। কোনো বিরোধী ছাত্রনেতা বা কর্মী তাঁর সামনে বা জ্ঞাতসারে নিরাপত্তার অভাবে ভুগেছেন এমনটি কখনো শুনিনি। মেয়েদের ব্যাপারে কোনো আলাদা আগ্রহ কখনো দেখা যায়নি। স্যারদের সবাইকেই সমীহ করতেন, তরুণ শিক্ষকদেরও। হৈচৈ-আড্ডা পছন্দ করতেন। কলাভবনের বাইরে তাঁকে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যেত খেলার মাঠে, যা আগেই বলেছি। আর পাওয়া যেত টিএসসিতে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিশেষ করে নাটকের কারণে।
অথচ এই রকম একটি ছেলের বিষয়ে অপপ্রচার চালানো হলো যে তিনি নাকি খুব অত্যাচারী ছিলেন, ক্যাম্পাসে বিরোধী মতাবলম্বীদের সহ্য করতেন না, ক্লাস করতেন না, মেয়েরা নিরাপদ ছিল না, মাস্তান বাহিনী পুষতেন, এমনকি ব্যাংক থেকে টাকা লুট করতে গিয়ে নাকি পুলিশের গুলি খেয়েছিলেন ইত্যাদি। এগুলো এতটাই কুিসত ও নিম্নমানের ডাহা মিথ্যা যে এসব অপপ্রচারের প্রতিবাদ করতেও রুচিতে বাধে। সে সময় আমরা যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম তাঁদের বেশির ভাগই এখনো বেঁচে আছেন, তাঁদের জিজ্ঞেস করলেই এগুলো ঠিক না বেঠিক তা জানা যাবে।
তখনকার দিনে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি, পাকিস্তানপ্রেমী, ধর্ম ব্যবসায়ী, সমাজতন্ত্রের নামে অতিবিপ্লবী, বিভিন্ন চরমপন্থী গ্রুপ, এমনকি আওয়ামী লীগবিরোধী বামপন্থীদেরও একাংশ একত্র হয়ে সরকারের বিরোধিতায় নেমেছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল তখন অত্যস্ত নাজুক অবস্থায়। ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক ফসলহানির কারণে দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এটি দূর করতে বঙ্গবন্ধুর সরকার সাইলোগুলো থেকে খাদ্যশস্য দ্রুত বিতরণ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে। কারণ পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণের আগে সেতুগুলো ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল বিপর্যস্ত, যা তখনো সব মেরামত করা সম্ভব হয়নি। তদুপরি মার্কিন সরকারের ক্রমাগত বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানের ফলে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যও ছিল দুর্বল। তখন সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবার কাছে পাটের বস্তা রপ্তানির বিনিময়ে চিনি কেনার ‘শাস্তি’ হিসেবে মার্কিন সরকার চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর অভিমুখী খাদ্যশস্যবাহী জাহাজ পথেই থামিয়ে বিভিন্ন বন্দরে আটকে রাখে। অথচ এসব খাদ্যশস্য বাংলাদেশ সরকার কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়েই কিনেছিল। একে তো দেশে ফসলহানি। উপরন্তু মার্কিনি বাধার কারণে পয়সা দিয়ে কেনা খাদ্যশস্য নির্ধারিত সময়ে দেশে না পৌঁছার ফলে চরম খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এই খাদ্যাভাব এবং সেই সঙ্গে কিছু নেতা ও সরকারের এক শ্রেণির আমলাদের দুর্নীতির কারণে মানুষ ক্ষুব্ধ ছিল। প্রাগুক্ত সরকারবিরোধী রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সব গ্রুপই অপপ্রচার চালিয়ে মানুষের এই ক্ষোভকে পুঁজি করার চেষ্টা করে। এই অপপ্রচারণায় যারা অংশ নেয় তাদের মধ্যে ‘হক কথা’, ‘দেশবাংলা’, ‘বঙ্গবার্তা’ ইত্যাদি পত্রিকাগুলো অন্যতম ভূমিকা পালন করে। তারা ‘শোনা যায়’, ‘জানা গেছে’ ইত্যাদির বরাত দিয়ে ভুয়া সংবাদগুলো জোরেশোরে প্রচার করত। শেখ কামাল যেহেতু ছিলেন মানুষের ধারণায় বঙ্গবন্ধু-পরবর্তী সময়ের নেতৃত্বের অন্যতম, তাই তাঁর সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনগণের মাঝে বিভ্রান্তিকর ভাবমূর্তি সৃষ্টিই এসব অপতত্পরতার লক্ষ্য ছিল বলে তখন থেকেই আমাদের বিশ্বাস ছিল। শেখ কামাল তাঁর চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের বিপরীতে গিয়ে কাঞ্চন আর কামিনীর পেছনে ছুটবেন, মাস্তানদের ওপর নির্ভর করবেন, ব্যাংক লুট করবেন—এসবও কি আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? আমরা কি আমাদের ব্যাচমেট শেখ কামালকে দীর্ঘদিন ধরে দেখিনি? এসব কল্পকাহিনি যারা বানায় তাদের কি নিম্নতম সৌজন্যবোধটুকুও নেই? রাজনীতি করতে গিয়ে কি সাধারণ সেন্স অব প্রপোরশনটুকুও বিসর্জন দিতে হবে? আমাদের দেশের প্রচলিত সব ধর্মের গিবতকারীদের জন্য কঠিন শাস্তির কথা বলা হয়েছে। তাহলে এসব গিবতকারীর মধ্যে ধার্মিক বলে পরিচয়দানকারীরা অন্তর্ভুক্ত হয় কিভাবে? একজন জাতির জনক, ইতিহাসের মহানায়ক, দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তখন ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, তাঁর ছেলের যদি টাকার দরকার হয়, তাহলে তাঁকে কি ব্যাংক লুট করতে হবে? এ ছাড়া অন্য কোনোভাবে তিনি কি ইচ্ছা করলে এই টাকা রোজগার করতে পারতেন না?
তখন বাংলাদেশে পাটের গুদামে আগুন লাগানো ও ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা একের পর এক ঘটেই যাচ্ছিল। সম্ভবত দুর্বল গোয়েন্দা ব্যবস্থার কারণে পুলিশও এর কোনো কূলকিনারা করতে পারছিল না। অন্য অনেকের মতো আমরাও অনুমান করতাম যে এগুলো পূর্বোক্ত সরকারবিরোধীদের কাজ। পাট ছিল তখন আমাদের অন্যতম রপ্তানি পণ্য। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতে হতো এই পাটের ওপর। সেই পাট যখন রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করে গুদামে ভর্তি করে রাখা হতো, তখন রাতের আঁধারে হঠাত্ আগুন লাগত। এবং সেটা এমনই ভয়ংকর আগুন যে নেভাতে নেভাতে পুরো গুদামই নিঃশেষ হয়ে যেত। ব্যাংক ডাকাতির বেলায়ও তাই। কমান্ডো স্টাইলের এসব ডাকাতরা পুলিশ আসার আগেই হাওয়া হয়ে যেত। সদ্যোজাত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ ও গণমাধ্যমের বেশির ভাগ সোচ্চার থাকলেও পূর্বোক্ত পত্রিকাগুলো এমনভাবে খবরগুলো পরিবেশন করত যে মনে হতো তারা খুব পুলকিত। ব্যাংকগুলোতে দিন ও রাতের পাহারা বাড়ানো হলো। তীব্র শব্দের অ্যালার্ম লাগানো হলো। দারোয়ানদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা ও মান বাড়ল। সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে জনগণকেও আহ্বান জানানো হলো ব্যাংক ডাকাতির কোনো আগাম তথ্য পেলে তা ফোনে জানানোর জন্য। সেই সঙ্গে অ্যালার্ম বাজলে পুলিশে ফোন ও যে যেখানে আছে ছুটে এসে ব্যাংক ঘেরাও করার জন্য। এর ফলে কিছু ফল অবশ্য পাওয়া যায়। কয়েকটি ব্যাংক ডাকাতির অপচেষ্টা জনতা ও পুলিশ ব্যর্থ করে দেয়। পুলিশের গুলিতে ও গণপিটুনিতে বেশ কয়েকজন ডাকাত মারা যায়। ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাও কমতে থাকে।
সেই কথিত ব্যাংক লুটের বিষয়ে বাস্তবে যা ঘটেছিল তা আমরা পরদিনই শুনেছি। পুলিশ বা অন্য কোনো সূত্র থেকে কামাল ভাইয়ের বন্ধুরা খবর পান যে সেদিন গভীর রাতে মতিঝিলে একটি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটতে পারে। তখন মতিঝিল এলাকায় দিনের বেলায় ছাড়া রাতে খুব একটা মানুষজন থাকত না। ডাকাতরা বোধ হয় এ জন্যই এই এলাকাটা বাছাই করেছিল। শেখ কামাল ও বন্ধুরা ঠিক করলেন খবরটা যে তাঁরা জেনেছেন তা প্রকাশ করা যাবে না, কিন্তু এই ডাকাতি প্রতিহত করার পাশাপাশি ডাকাতদের দু-একটাকে জীবন্ত ধরতে হবে। তাহলে তাদের ও এই র্যাকেটের হোতাদের পরিচয় বের করা যাবে। শেখ কামাল ও তাঁর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু সেই রাতে গাড়ির বাতি নিভিয়ে ধীরে ধীরে যাচ্ছিলেন, যাতে সম্ভাব্য ডাকাতরা টের না পায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মোড়ের পশ্চিম-উত্তর কোনে পুলিশের একটি গাড়িও ডাকাতি প্রতিহত করতে পেট্রলে ছিল। তারা বাতি নেভানো গাড়িটা ডাকাতদের ভেবে গুলি চালায়। একটি গুলি শেখ কামালের পায়ের কিনারায় লাগে। গাড়ির আরো একজন আহত হয়। পরে পুলিশ ভুল বুঝতে পেরে তাঁদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তাঁরা সেখানে কয়েক দিন থেকে চিকিৎসা নেন।
এই ঘটনাটিকেই বিরোধীরা তাদের মনের মাধুরী মিশিয়ে ব্যাখ্যা করে যে ‘গভীর রাতে মতিঝিলে শেখ কামাল পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিলেন।’ কিন্তু বিবরণটা বিশদ না করে বরং বিকৃত করে এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশটি না বলায় তা সত্যের বদলে অর্ধসত্যে রূপান্তরিত হয়, যা মিথ্যার চেয়েও ভয়ংকর। অনেকটা মহাভারতের ‘অশ্বত্থামা হত’ গল্পের মতো, যেখানে ‘ইতি গজঃ’ কথাটি আর শোনা যায় না। ফলে পুরো অর্থটাই পাল্টে যায়।
তাঁর কীর্তিগুলোর পাশাপাশি দোষ থাকলে সেগুলোর সমালোচনা হোক। কিন্তু রাজনীতির কারণে অন্যায় অপবাদ আরোপের যে সংস্কৃতি বাংলাদেশে চালু করা হয়েছে তা কখনোই কোনো পক্ষের জন্য শুভ কিছু বয়ে আনবে না। এসব অর্ধসত্য আর অপপ্রচার বেষ্টিত কুহকজাল থেকে শেখ কামাল দ্রুত মুক্তি পাবেন, ইতিহাসের কাছে তাই প্রত্যাশা করি।
লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার; সাবেক চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ; সাবেক চেয়ারম্যান, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ; সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়