করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) মহামারি নির্মূলে একটি কার্যকর ভ্যাকসিন বা টিকার জন্য আশায় বুক বেঁধে আছে সারাবিশ্বের মানুষ। এরই মধ্যে ভ্যাকসিন পাওয়ার দৌড়ে বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশও কাজ শুরু করেছে। জনগণের মাথাপিছু আয় চার হাজার ডলারের কম হওয়ায় বিনামূল্যে টিকা পাওয়ার সুযোগ থাকলেও দ্রুত এটি পেতে ফ্রি’র পাশাপাশি নগদ অর্থ দিয়েও সংগ্রহের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
কোভিড-১৯ মহামারি প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশে প্রাধিকারভিত্তিতে সুলভে পাওয়া নিশ্চিতে গত ১০ আগস্ট সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এতে সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান। ওই সভার কার্যপত্রের একটি কপি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সভায় বিস্তারিত আলোচনা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে বেশকিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে-
১. কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাভি’র (টিকা বিষয়ক আন্তর্জাতিক জোট) মাধ্যমে দেশে নিয়ে আসার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২. গ্যাভি, কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির (ফ্রি’তে ভ্যাকসিন পাওয়া) পাশাপাশি নগদ অর্থে ভ্যাকসিন ক্রয়ের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩. গ্যাভি, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ ভ্যাকসিন তৈরির অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হবে।
৪. কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ফান্ড সংগ্রহের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৫. ভ্যাকসিন সংক্রান্ত (সহজে বাংলাদেশের প্রাপ্তির লক্ষ্যে) একটা রোডম্যাপ প্রস্তুত করতে হবে।
৬. বিদেশ থেকে করোনার ভ্যাকসিন আনার ব্যাপারে সম্পূর্ণ প্রসিডিউর সম্পর্কে আলোচনা করে অতিসত্তর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৭. স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে ভ্যাকসিন উৎপাদন বা আমদানি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
৮. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ভ্যাকসিন আমদানি ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
মঙ্গলবার (১৮ আগস্ট) এ সংক্রান্ত সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান গণমাধ্যমকে বলেন, করোনার ভ্যাকসিন তৈরির সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে এটি পাওয়া যায়, সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি। শিগগিরই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
এর আগে বুধবার (১২ আগস্ট) সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, করোনার টিকা সংগ্রহের জন্য একটি সোর্সের ওপর নির্ভর করলে সেটি পাওয়া কঠিন হবে। সেজন্য যদি একাধিক সোর্স থেকে এ ভ্যাকসিন আমরা সংগ্রহ করতে পারি…। আমি এরই মধ্যে দেখেছি, যেসব দেশ ভ্যাকসিন তৈরি করবে তাদের সঙ্গে অনেক দেশ চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, অগ্রীম টাকাও দিয়েছে। আমাদেরও এ ধরনের ব্যবস্থায় যেতে হবে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, এক্ষেত্রে আমাদের অর্থায়নে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ বাজেটে ভ্যাকসিন কেনা বাবদ আলাদা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এদিকে সভার কার্যপত্র থেকে জানা গেছে, সভায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমএনসিঅ্যান্ডএএইচ প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক কোভিড-১৯ মহামারি থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা কর্তৃক তৈরি করা ভ্যাকসিনের বর্তমান পর্যায় এবং ভ্যাকসিন তৈরির সব ধাপ শেষে সফলভাবে বাজারজাত হলে প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রাধিকারভিত্তিতে সুলভে প্রাপ্তি নিশ্চিতের বিষয়ে একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। লাইন ডিরেক্টর তার প্রেজেন্টেশনে উল্লেখ করেন যে, ছয়টি ভ্যাকসিন থার্ড ফেজে রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- মডার্না, ফাইজার, এস্ট্রোজেনেকা, সাইনোভ্যাক, সাইনোফার্ম-১ ও সাইনোফার্ম-২।
তিনি বলেন, এর মধ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও গ্যাভি’র মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ভ্যাকসিন আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে আর্থিক ও ভৌগোলিক এলাকাভেদে গ্যাভি’র কোনো সদস্য দেশ যেন ভ্যাকসিন সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি কর্তৃক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে গ্যাভি’র কাছে টিকার জন্য এক্সপ্রেস অব ইন্টারেস্ট প্রেরণ করা হয়েছে। গ্যাভি’র কাছে ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে ৯২ দেশের যোগ্য তালিকার লিস্টে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরে গ্যাভি’র বোর্ড মিটিংয়ে সদস্য দেশসমূহে ভ্যাকসিন বিতরণ এবং এর মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ গ্যাভি’র কো-ফাইন্যান্সিং হিসেবে ভ্যাকসিন পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।
সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভ্যাকসিন তৈরি হলে বাংলাদেশ কখন এবং কীভাবে সেটি পাবে সে বিষয়ে জানতে চান। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ২০০টি করোনা ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারীর মধ্যে যে ১০টি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে রয়েছে সেগুলোর মধ্যে আমরা কোনটি গ্রহণ করব এবং একসঙ্গে একাধিক প্রতিষ্ঠানের ভ্যাকসিন নেয়া যাবে কি-না?
মন্ত্রীর এমন প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যসেবা সচিব সভায় জানান যে, প্রধানমন্ত্ৰী কার্যালয়ের সঙ্গে ভ্যাকসিনের অর্থায়নের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ভ্যাকসিনপ্রাপ্তির বিষয়ে বিশ্বব্যাপী বর্তমান অবস্থা এবং বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় কম হওয়ার কারণে ভ্যাকসিনপ্রাপ্তিতে বাংলাদেশ কোনো সুযোগ পাবে কি-না, সে বিষয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, সভায় উপস্থিত বেশির ভাগ সদস্য বিশেষ করে আইসিডিডিআর,বি থেকে আগত সদস্যরা ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছেন। নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় ভ্যাকসিনপ্রাপ্তিতে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে না। এছাড়া তিনি গ্যাভি, কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি’র সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের যুক্ত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্য দেশ হিসেবে আবেদন করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। গ্যাভি’র মাধ্যম ব্যতীত সরাসরি নগদ অর্থায়নের মাধ্যমে ভ্যাকসিন ক্রয়ের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এখন থেকে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন সচিব।
ভ্যাকসিন প্রাপ্তির বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য
সভায় আইসিডিডিআর,বি (আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ) সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ডা. ফেরদৌসী কাদরি বলেন, আইসিডিডিআর,বি ভ্যাকসিন নিয়ে অনেক দিন ধরে কাজ করছে। আইসিডিডিআর,বি-এর ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অভিজ্ঞতা রয়েছে। একটি মাত্র ভ্যাকসিনের ওপর নির্ভর করা ঠিক হবে না। মান ও দাম বিবেচনা করে ভ্যাকসিন আনতে হবে। বাংলাদেশ যাতে ভ্যাকসিন পেতে পারে সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে। কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি’র মাধ্যমে ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে কভার করার চিন্তা মাথায় রেখে এগিয়ে যেতে হবে।
আইসিডিডিআর,বি-এর কনসালট্যান্ট ডা. তাজুল ইসলাম এ বারি সভাকে অবহিত করেন যে, ভ্যাকসিনপ্রাপ্তিতে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে না। আইসিডিডিআর,বি গভীর সাপোর্টে পূর্বের অন্যান্য ভ্যাকসিন নিয়ে এসেছে। বর্তমানে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন যেসব প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে এবং যেগুলো চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে সেগুলোর দাম, বাংলাদেশ কখন এবং কীভাবে পেতে পারে তার বিস্তারিত বর্ণনা দেন তিনি। গ্যাভি ব্যতীত বিকল্প চিন্তা করলে বাংলাদেশ গ্যাভি’র প্রাইরোটি কান্ট্রির তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারে বলেও জানান ডা. তাজুল ইসলাম।
সভায় ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ভ্যাকসিন গ্যাভি’র মাধ্যমে মার্চে আসতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসি প্রয়োজন। আমরা ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্ৰণালয়ের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পত্র দিয়েছি। আমাদের দেশের কোম্পানিগুলোর ম্যানুফেকচারিং কমিটি আছে। ভ্যাকসিন উৎপাদনে তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে।
সভায় করোনা ভ্যাকসিন তৈরির সঙ্গে সঙ্গে দেশে নিয়ে আসা নিশ্চিত করতে মন্ত্রী নির্দেশনা দেন। স্বাস্থ্য সচিব বলেন, কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির পাশাপাশি নগদ টাকায় ভ্যাকসিন ক্রয়ের বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এদিকে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি বাড়ছে। একই সঙ্গে চলছে রোগের টিকা আবিষ্কারের চেষ্টাও। ইতোমধ্যে রাশিয়া ও চীন সরকার তাদের ভ্যাকসিন সফল উল্লেখ করে উৎপাদনের ঘোষণা দিয়েছে। জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টিকা আবিষ্কারে ১৭৩টি উদ্যোগ চলছে। এর মধ্যে কয়েকটি মানবদেহে পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, করোনার টিকা আবিষ্কার হলে উন্নত দেশগুলোকে সেটা আবিষ্কারকদের কাছ থেকে কিনে নিতে হবে। যেমন- অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির টিকার জন্য ইতোমধ্যে এক কোটি ডোজের চাহিদা দিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার। চাহিদা দিয়েছে ব্রাজিলও।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, যেসব দেশের নাগরিকদের মাথাপিছু আয় চার হাজার ডলারের বেশি, তাদের টিকা কিনতে হবে। কিন্তু বাংলোদেশের নাগরিকদের মাথাপিছু আয় যেহেতু তারচেয়ে কম, ফলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো বিনামূল্যে টিকা পাবে। এমনকি বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও গ্যাভি’র (টিকা বিষয়ক আন্তর্জাতিক জোট) অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা পাওয়ার ৯২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে।