১৬ বছর কাঁদছি শুধু বিচারের আশায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি। চূড়ান্ত বিচার না পাওয়ার কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের অনেক দিয়েছেন।
চিকিৎসা থেকে শুরু করে বেঁচে থাকার জন্য সবই দিচ্ছেন এখনও। কিন্তু কিছুতেই যেন মন ভরছে না। আশায় বুক বেঁধে আছি, খুনিদের ফাঁসি হবে, চূড়ান্ত বিচার হবে।
গণমাধ্যমকে কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন পুরান ঢাকার ইয়াসমিন হোসেন। তার এক পায়ে পচন ধরেছে। ২০০৪ সালের আজকের এই দিনেই বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সভায় জঘন্যতম গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। রক্তে ভেসে যায় রাজপথ। অল্পের জন্য বেঁচে যান তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ঘটনার ১৬ বছর পার হলেও আহতের অনেকের শরীরে এখনও দগদগে হয়ে আছে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার। প্রতিমুহূর্তে অসম্ভব শারীরিক কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন আহতরা।
শেখ বজলুর রহমান : তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাইলে দ্রুত বিচার আদালতের আশ্রয় নিয়ে এ বিচার করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই নৃশংস এই ঘটনার বিচার চেয়েছি। রায় হয়েছে; কিন্তু এখনও কার্যকর হয়নি। আমরা চাই, এ রায় দ্রুত কার্যকর হোক। শুধু তা-ই নয়, ২১ আগস্ট যারা ঘৃণিত এই হামলা চালিয়েছে, প্রত্যক্ষভাবে যারা জড়িত ছিল, তাদের পাশাপাশি যারা এ হামলার সহযোগিতা করেছে, মদদ জুগিয়েছে তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। শেখ বজলুর রহমানের মতো কষ্ট-যন্ত্রণায় ভুগছেন আহত প্রায় সবাই।
নাসিমা ফেরদৌসী : জীবদ্দশায় খুনিদের চূড়ান্ত বিচার দেখে যেতে চান। প্রার্থনা করেন খুনিদের বিচার না দেখা পর্যন্ত তার যেন মৃত্যু না হয়। তিনি বলেন, ২১ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যা করাই খুনিদের উদ্দেশ্য ছিল। ওই হামলায় ২৪ জন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন প্রায় ৫০০ নেতাকর্মী। আমি বিশ্বাস করি, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হবে।
আমরা যারা আহত- এটাই একমাত্র চাওয়া। দুটি পা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না। প্রায় ১৫’শ স্প্লিন্টার শরীরে।
অঞ্জলী সরকার : ভালো নেই। দিন যত যাচ্ছে, স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা বাড়ছে। ১ হাজারেরও বেশি স্প্লিন্টার শরীরে বিদ্ধ রয়েছে। পুরান ঢাকার শাখারিবাজারে থাকেন তিনি। তিনি জানান, কতদিন বেঁচে থাকবেন জানেন না, তবে খুনিদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত ঈশ্বর যেন তাকে বাঁচিয়ে রাখেন।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের যে কোনো সভা-মিছিল হলেই তিনি সেখানে হাজির হতেন। এখনও শরীরের শত যন্ত্রণা নিয়েও সভা-মিছিলে হাজির হতে চেষ্টা করেন। সংগ্রামী এ দল তাকে সংগ্রাম করে বাঁচতে শিখিয়েছে। তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে আহত বিউটি মিজান মারা গেছেন। একেক করে যদি আহতরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন, তাহলে মরেও তারা শান্তি পাবেন না। চূড়ান্ত বিচারের রায় সম্পূর্ণ হয়েছে- এমনটা দেখে মরতে চান তারা।
রাশেদা আক্তার রুমা : তার শরীরেও ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে। ২১ আগস্ট শেখ হাসিনা যে ট্রাকে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, এর পেছনেই ছিলেন তিনি। শরীরের অসংখ্য স্প্লিন্টার বিদ্ধ। ওইদিন স্প্লিন্টারের আঘাতে তার ১৮টি দাঁত পড়ে যায়। ভেঙে যায় মাড়ি।
তিনি বলেন, এখনও বেঁচে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতা-ভালোবাসায়। এখন একমাত্র চাওয়া-পাওয়া বিচার সম্পূর্ণ করা। খুনিদের বিচার সম্পূর্ণ না হলে তাদের সঙ্গীয়রা-জামায়াত-বিএনপির হুকুমদাতারা আরও ২১ আগস্ট, ১৫ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে। তারেক জিয়াকে দেশে এনে সাজা কার্যকরের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, দ্রুত রায় বাস্তবায়ন হলে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। আমরা মরেও শান্তি পাব।
ডা. লুৎফুননেছা সোনালী : শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্যান্সার। স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায় প্রায়ই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। হামলার পর ২৭ দিন পর তার জ্ঞান ফিরে। ২১ আগস্টের খুনিদের বিচার দেখে মরতে চান। এদিকে রফিকুল ইসলাম ওরফে ‘আদা চাচার’ ছেলে মাজাহারুল ইসলাম ওরফে ‘আদা মামুনের’ বক্তব্য, তার বাবা (আদা চাচা) ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত হন। তাদের একটাই চাওয়া- বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর হোক।
কাজী শাহানারা ইয়াসমিন : গ্রেনেড হামলার শিকার হয়েছিলেন আইনজীবী শাহানারা ইয়াসমিন। বর্তমানে তার দুই ছেলেকে নিয়ে রাজারবাগে থাকেন। তিনি বলেন, বয়স হচ্ছে আর শারীরিক সমস্যাগুলো বাড়ছে। ভারত গিয়ে চিকিৎসা নিতে হয় বছরে কয়েকবার। ৪৮ ঘণ্টাও কোনো ওষুধ বন্ধ রাখা যায় না। শরীরে একধরনের চুলকানি শুরু হয়। তবে অনেকেই খবর না নিলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই খবর নিয়েছেন। তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ১৮ লাখ টাকা দিয়েছেন। ১৬টি বছর কেটে গেছে। জীবদ্দশায় এই বিচার কার্যকর হওয়া দেখে যেতে চাই।
মাহবুবা পারভীন : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন সাভারের মাহবুবা পারভীন। যিনি বর্তমানে ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি। সেদিনের কথা স্মরণ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, শরীরে স্প্লিন্টারে ভরা। এক অসম্ভব যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি। আমার নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দু’বারে ২০ লাখ টাকা দিয়েছেন। তিনি সব সময় খোঁজখবর রাখেন।
পারভীন বলেন, খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান ২১ আগস্ট শুধু আওয়ামী লীগকেই ধ্বংস করতে চায়নি, তারা চেয়েছে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশের স্বপ্নকে নষ্ট করতে। কিন্তু তারা সফলকাম হতে পারেনি। সব ষড়যন্ত্র, কুচক্রের জাল ছিন্ন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে তার মধ্য দিয়ে জাতির পিতার সোনার বাংলাদেশ গঠিত হবেই। আর সেই বাংলাদেশেই আমরা এই বর্বর হত্যাযজ্ঞের বিচারও দেখে যেতে চাই।
লিটন মোল্লা : গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য লিটন মোল্লা। শরীরের অসংখ্য স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। অসহ্য যন্ত্রণা হয়। চিকিৎসকরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার সামর্থ্য তার নেই। প্রধানমন্ত্রীর সহায্য কামনা করেছেন লিটন মোল্লা। বিদেশে সুচিকিৎসার পাশাপাশি একটু স্থায়ী আবাসনের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
লিটন মোল্লার বাবা মরহুম আক্তার হোসেন চুন্নু মোল্লা টানা ২৫ বছর মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সাহেবরামপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এই ত্যাগী নেতা ২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ক্যান্সারে মারা যান।