করোনাকালে একদল মানুষকে খামোকা ‘বলির পাঁঠা’ করা হয়েছে। দিল্লির নিজামউদ্দিন মারকাজে তাবলিগি জামাত সদস্যদের নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে এমনই মন্তব্য করল ভারতের বম্বে হাইকোর্ট।
পর্যটন ভিসায় এসে ধর্মপ্রচার, করোনাসংক্রান্ত নিয়মবিধি লঙ্ঘনের মতো একাধিক অভিযোগে কয়েক মাস আগে ৪০টি দেশের দুই হাজার ৫৫০ তবলিগি জামাত সদস্যকে কালো তালিকাভুক্ত করে কেন্দ্র। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়। ২৯ জন বিদেশি তবিলিগি জামাত সদস্য এবং সাতজন ভারতীয় জামাত সদস্যের বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্রে দায়ের হওয়া এফআইআর বাতিল করে শুক্রবার বম্বে হাইকোর্ট জানিয়ে দেয়, করোনা-কালে খামোকা তাদের ‘বলির পাঁঠা’ করা হয়েছিল। কোভিড-১৯ ছড়ানোর জন্য দায়ী করা হয়েছিল ওই সমস্ত জামাত সদস্যদের। রাজনৈতিকভাবে চাপের মুখে পড়ে সেই সময় তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করে মহারাষ্ট্র সরকার। খবর আনন্দবাজারের।
নিজামউদ্দিন মারকাজে যোগ দেয়ায় ওই ২৯ জন বিদেশি নাগরিকের বিরুদ্ধে জাতীয় মহামারি, বিপর্যয় মোকাবিলা এবং বিদেশি নাগরিক আইনে এফআইআর দায়ের হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে বম্বে হাইকোর্টে একটি পিটিশন জমা পড়ে। বিচারপতি এমডি সেওলিকর এবং টিভি নালাওয়াড়ের ডিভিশন বেঞ্চে শুক্রবার সেটির শুনানি চলছিল। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘গোটা ঘটনায় যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো কাজ করেছে মহারাষ্ট্র পুলিশ। রাজনৈতিক চাপে পড়ে জামাত সদস্যদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করে রাজ্য সরকার। নিজামউদ্দিন মারকাজে যারা গিয়েছিলেন, তাদের নিয়ে বড় ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছিল। দেশজুড়ে বিপর্যয় নেমে এলে, মহামারি পরিস্থিতি দেখা দিলে সরকার বলির পাঁঠা খোঁজার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে ওই বিদেশিদের বলির পাঁঠা করা হয়।’
বিগত ৫০ বছরেরও বেশি সসময় ধরে দিল্লির ওই মারকাজে তবলিগি জামাতের সমাবেশ চলে আসছে। তা নিয়ে অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা অযৌক্তিক বলেও মন্তব্য করে আদালত। বলা হয়, ‘সরকারের দেয়া ভিসা নিয়েই ভারতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং আতিথেয়তার টানে ছুটে এসেছিলেন ওই বিদেশি নাগরিকরা। বিমানবন্দরে সমস্ত প্রক্রিয়া মিটিয়ে তবেই এ দেশে পা রেখেছিলেন তারা। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে নয় বরং ইসলামের রীতিনীতির সাক্ষী হতেই যে মসজিদে থাকছেন তা স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েওছিলেন। তারপরেও মারকাজে যোগ দেয়া বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চালানো হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপ করা হয়েছে, তা নিয়ে অনুশোচনার সময় এসেছে। সরকারের পদক্ষেপে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, অবিলম্বে তাতে প্রলেপ দেয়া দরকার।’
মসজিদে এতসংখ্যক মানুষের একসঙ্গে থাকা নিয়ে শুরু থেকেই নানা প্রশ্ন উঠছে। সে প্রসঙ্গে আদালত বলে, ‘নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ মার্চের মধ্যে ওই সমস্ত বিদেশি নাগরিকরা ভারতে এসেছিলেন। সেই সময় দেশে লকডাউন জারি হয়নি। তাই লকডাউন জারি হওয়ার পর হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো যখন বন্ধ হয়ে যায়, সেই সময় মসজিদে কিছু মানুষকে আশ্রয় দেয়া অপরাধ নয়। তাতে আইন অমান্য করাও হয় না। লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর একইভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছিল একাধিক গুরুদ্বার। এখানে বিতর্কের কেন্দ্র যে মসজিদ, জেলা প্রশাসনের নির্দেশে সেখানে সাধারণ মানুষের জমায়েত আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ ওই সময়ে মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছেন, এমনটাও দেখা যায়নি। তাই নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ খাটে না।’
নিজামউদ্দিন মারকাজে যোগ দেয়া জামাত সদস্যদের বিরুদ্ধে সংক্রমণ ছড়ানোর অভিযোগ নিয়ে আদালত বলে, ‘মসজিদে আশ্রয় নেয়া ওই বিদেশি নাগরিক এবং ভারতীয় মুসলিমরা কোনো উপদ্রবই করেননি। তাদের বিরুদ্ধে একটা অসন্তোষের আবহ তৈরি করার চেষ্টা চলছিল। এই ঘটনায় এখনো পর্যন্ত যে যে নথিপত্র জমা পড়েছে, তাতে দেখা গিয়েছে, দিল্লির মারকাজে আসা মুসলিমদের বিরুদ্ধেই শুধু পদক্ষেপ করেছে কেন্দ্র। অথচ অন্য ধর্মের বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ করা হয়নি।’
আদালতের দাবি, নিজামউদ্দিনে আসা বিদেশিদের নিয়ে সংবাদমাধ্যমেও অপপ্রচার চালানো হয়। একটা ছবি তৈরির চেষ্টা চলছিল, যাতে মনে হয় তাদের জন্যই ভারতে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়েছে। করোনার প্রকোপে এই মুহূর্তে দেশে যে অতিমারি দেখা দিয়েছে, তাতে পরস্পরের প্রতি আরও সহিষ্ণু এবং সংবেদনশীল হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করে আদালত।