প্রয়োজন ১৪ কোটি ভ্যাকসিন, বিকল্প উৎসের সন্ধানে সরকার

মত ও পথ প্রতিবেদক

করোনার ভ্যাকসিন
করোনার ভ্যাকসিন। ছবি : ইন্টারনেট

করোনা প্রতিরোধে দেশের জনগণের জন্য কমপক্ষে ১৪ কোটি ভ্যাকসিন  প্রয়োজন। বিশাল এই চাহিদা মেটাতে সরকার বিকল্প চারটি উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।

এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না, চীন, রাশিয়া, ভারত ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আধুনিক প্রযুক্তির টিকাগুলো মাইনাস ৮০ ডিগ্রিতে সংরক্ষণ করতে হবে।

ভ্যাকসিনের গুণগত মান নিশ্চিতে পরিবহনের ক্ষেত্রেও কঠোরভাবে মানতে হবে কোল্ড চেইন। দেশে এ ধরনের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। অর্থাৎ ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হলেও তা পরিবহন ও সংরক্ষণে জটিলতা সৃষ্টির শঙ্কা আছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, দেশে ভ্যাকসিন আনতে সরকারের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত সব শাখাই তৎপর রয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়ত খোঁজ নিচ্ছেন। বিশ্বে ভ্যাকসিন আবিষ্কার এখন অ্যাডভান্স লেভেলে আছে। যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, আমেরিকা, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চূড়ান্ত পর্যায়ে কাজ করছে। এই ভ্যাকসিনগুলোর গুণগত মান যাচাই-বাছাই করেই প্রধানমন্ত্রী সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তই গ্রহণ করবেন।

জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান বলেন, দেশের ২০ ভাগ মানুষের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়, তাহলে বাকি প্রায় ১৪ কোটি মানুষের জন্য টিকা প্রয়োজন হবে। এ জন্য একটা বেজলাইন সার্ভে করতে হবে। যাতে বোঝা যায় ঠিক কতসংখ্যক মানুষের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, কতজন মানুষের টিকা দরকার। কারণ, দেখা গেছে, যাদের মৃদু সংক্রমণ হয়েছে তাদের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়নি।

২০ ভাগ লোকের টিকার প্রয়োজন না হলে বাকি ৮০ ভাগের লাগবে। এই সংখ্যা কমপক্ষে ১৪ কোটি। এই বিপুল পরিমাণ টিকার জন্য ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশের মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নজরদারিতে বর্তমানে যে আটটি ভ্যাকসিন তৃতীয় ধাপে রয়েছে, এর অন্তত চারটির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ রাখছে বাংলাদেশ সরকার।

যার মধ্যে মানগত দিক থেকে সবার উপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না ও ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের ‘এমআরএনএ-১২৭৩’। দ্বিতীয় অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও অক্সফোর্ডের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন, তৃতীয় চীনের সিনোভেক বায়োটেকের ‘করোনাভেক’। এর বাইরে দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়ালে থাকা ভারতের ভারত বায়োটেক ও ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চের ‘কোভ্যাকসিন’ রয়েছে বিশেষ বিবেচনায়।

অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের বিষয়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ভারতের চুক্তি হয়েছে। তাই দুই দেশের (যুক্তরাজ্য ও ভারত) বিষয়টি একটি উৎস হিসেবে দেখা হচ্ছে। এছাড়া ভারতের টিকাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। এদিকে রাশিয়ার টিকার দিকেও নজর রাখা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

মডার্নার ভ্যাকসিনের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা জানান, গত ২৭ জুলাই থেকে মডার্না ৩০ হাজার মানুষের ওপর তাদের ভ্যাকসিনটির তৃতীয় ধাপের চূড়ান্ত পরীক্ষা করেছে। গত মার্চে পরীক্ষামূলকভাবে এই ভ্যাকসিন প্রথম মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হয়। এতে সাফল্যের পর দ্বিতীয় ধাপেও সাফল্য আসে তাদের।

প্রখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন ফর্মুলেশনে হিমায়ন প্রয়োজন। অর্থাৎ একটি শীতল শৃঙ্খলা কঠোরভাবে প্রতিপালনের মাধ্যমে এগুলো সংরক্ষণ, পরিবহন এবং বিতরণ করতে হবে। অন্যথায় এর যৌক্তিক প্রয়োগ বা ব্যবহার সম্ভব হবে না। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভ্যাকসিনগুলো কোল্ড চেইন মেনে পরিবহন নিশ্চিত করা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, এর আগে কোল্ড চেইন ব্যর্থতার কারণে পাঁচটি দেশে ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন নষ্ট হয়েছে।

বিশ্বের ১০ শতাংশেরও কম দেশ কার্যকরভাবে ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট অনুশীলনের ব্যবস্থা চালু আছে। তবে করোনা রোধে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এসব ভ্যাকসিনের মান নিয়ন্ত্রণে কঠোরভাবে কোল্ড চেইন মানতে হবে।

বাংলাদেশ ফার্মাকোলজি সোসাইটির সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান মত ও পথকে বলেন, কোম্পানিগুলো আধুনিক উন্নতপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। তারা চেষ্টা করছে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা কতটা কমিয়ে আনা যায় সেটা নিয়ে। ইতোমধ্যে তারা ৪০ ডিগ্রি কমিয়ে মাইনাস ১২০ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ৮০ ডিগ্রিতে নামাতে সক্ষম হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এসব ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করতে হলে মাইনাস ৮০ ডিগ্রি তাপমাত্রার ফ্রিজ প্রয়োজন হবে।

তিনি আরও বলেন, অন্যান্য ভ্যাকসিনের সঙ্গে ট্রায়ালের বিষয়টি জড়িত থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে সেটি দরকার হবে না। সরকার কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পাওয়ার পর ওই ভ্যাকসিন সরাসরি আমদানি করতে পারবে। দেশে আলাদা ট্রায়াল না করলেও সমস্যা হবে না। তবে মডার্না যদি চায় তারা এই দেশে আবার ট্রায়াল করবে কিংবা বাংলাদেশ সরকার যদি চায় ট্রায়াল না করে কোনো ভ্যাকসিন আনবে না, তবে ট্রায়াল হতে পারে।

পরিবহন ও সংরক্ষণের বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশিদ আলম মত ও পথকে বলেন, ভ্যাকসিন কবে পাওয়া যাবে, সেই বিষয়টি এখনও নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত হলে পরিবহন ও সংরক্ষণ নিয়ে যাতে কোনো ধরনের জটিলতা না হয়, সে জন্য ইতোমধ্যে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নে কাজ শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, যেহেতু আমরা কাজ শুরু করেছি, আশা করছি সমস্যা হবে না, সময়মতো সবকিছু সামলে নেয়া যাবে।

জানা গেছে, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্বে এ পর্যন্ত অন্তত ১৩৫টি ভ্যাকসিন উন্নয়নের কাজ বিভিন্ন ধাপে রয়েছে। এর মধ্যে ২১টি রয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে বা প্রথম ধাপে, ১৩টি দ্বিতীয় ধাপে আর আটটি রয়েছে তৃতীয় ধাপে।

দুটি ভ্যাকসিন ইতোমধ্যে অনুমোদন পেয়েছে নিজ দেশে। রাশিয়া ও চীনের একটি করে ভ্যাকসিন নিজ নিজ দেশে চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। তবে বাংলাদেশ এই দুটি ভ্যাকসিনের প্রতি তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেনি। ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা নিশ্চিতে বাংলাদেশের আলোচনায় রয়েছে চীনের সিনোভেক কোম্পানি ও অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন হওয়ার চুক্তি হয়েছে। এতে বাংলাদেশের এই টিকা প্রাপ্তিতে সুবিধা হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার বরাত দিয়ে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ মত ও পথকে বলেন, বিশ্বের সামগ্রিক প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করে ২০২১ সালের শেষ নাগাদ বছরে দুই বিলিয়ন ভ্যাকসিন তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। এমনকি দুই বিলিয়ন ডোজ তৈরি করতে হলে ভ্যাকসিন উৎপাদক কোম্পানিগুলোকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। ২০২১ সালজুড়ে যতগুলো ভ্যাকসিন তৈরির পরিকল্পনা, তা মূলত ইউরোপীয় দেশগুলোর নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্য লাগবে।

অর্থাৎ ২০২২-এর আগে পশ্চিমা বিশ্বের তৈরি ভ্যাকসিন ব্যাপক ভিত্তিতে আমাদের হাতের নাগালে আসার সম্ভাবনা কম। যদি অল্প-বিস্তর আসেও, সেটা সাধারণ জনগণের নাগালে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে