জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখা আয়োজিত আলোচনাসভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুদিন পর আওয়ামী লীগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সামরিক শাসকদের দল যাঁরা করেছেন কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে যাঁরা সহচর ছিলেন, তাঁরা যেন কোনো দিন মুক্তিযুদ্ধের দল আওয়ামী লীগে যোগ দিতে না পারেন। সে জন্য দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা তাঁর এই ভাষণে তাঁর দলকে আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করার আহ্বান জানিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘মিলিটারি ডিক্টেটরদের দল আমাদের ভালো ভালো নেতাকর্মীদের হত্যা করে। বাইরে তাদের এক রূপ, ভেতরে আরেক রকম। ভালো মানুষ সেজে তারা আমাদের দলে এসে ঢোকে। তারা এখান থেকে, সেখান থেকে এসে আমাদের দলে জুড়ে বসেছে। তারা এই সময় এত ভদ্র সাজে যে আমাদের কেউ কেউ দল ভারী করার জন্য তাদের কাছে টেনে নিয়েছে। কিন্তু এদের দলে গ্রহণ করা আমাদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর।’
বহুদিন পর প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাসীন দলের নেতা হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘সামরিক শাসকদের দলের (যেমন—বিএনপি, জাতীয় পার্টি) সঙ্গে যারা যুক্ত হয়েছে বা যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের আওয়ামী লীগে নেওয়া যাবে না।’ সামরিক বাহিনীর কোনো কর্মকর্তা মিলিটারি ইউনিফর্ম ছেড়ে দিয়ে রাজনীতিতে আসতে চেয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিলে তাঁকে নেওয়া যাবে না, এমন কথা তিনি বলেননি। বললে গণতন্ত্রের আদর্শেরই বিরোধিতা করতে হতো। ফ্রান্সে জেনারেল দ্য গল সামরিক বাহিনী ছেড়ে দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। এমনকি তাঁর ইচ্ছায় ফ্রান্সের সংবিধান পর্যন্ত বদলে গিয়েছিল। আমেরিকায় জেনারেল আইসেন হাওয়ার ন্যাটোর অধিনায়কত্ব ছেড়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। এতে কেউ আপত্তি করেনি। কিন্তু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে জেনারেলরা ক্ষমতা দখল করেছেন মিলিটারি ইউনিফর্ম পরে বন্দুক হাতে। দেশের সংবিধান তাঁরা ভঙ্গ করেছেন। নাগরিক অধিকার হরণ করেছেন। অবৈধভাবে জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। এঁরা এবং এঁদের যেসব সিভিল ও মিলিটারি ব্যক্তি সহযোগিতা দিয়েছেন, তাঁদের জন্য যে আওয়ামী লীগের দরজা বন্ধ এ কথাটা বহু আগে ঘোষিত হলে ভালো হতো। জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ ও ভাইস অ্যাডমিরাল এ কে খন্দকার দুজনই অত্যন্ত ভালো মানুষ। কিন্তু দুজনই বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও জাতির পিতার হত্যার পর খুনিদের নির্দেশে রেডিও স্টেশনে উপস্থিত হয়ে ঘাতকদের অবৈধ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে রাষ্ট্রদূতের চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে যান। সেদিন সামরিক বাহিনীর এই দুই নেতা যদি ভীত না হয়ে, ঘাতকদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার না করে ফরাসি জেনারেল দ্য গলের নীতি গ্রহণ করতেন, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যভাবে তৈরি হতে পারত। পরে এঁরাই আবার আওয়ামী লীগে ফিরে এসেছেন এবং মন্ত্রিত্বও করেছেন।
সম্ভবত সে সময় এই দুজনকে দলে ঠাঁই না দিয়ে আওয়ামী লীগের উপায় ছিল না। বিএনপি গঠিত হয়েছিল একজন জেনারেলের দ্বারা এবং তাঁর দলে ভিড় করেছিল সামরিক বাহিনীর একদল শীর্ষস্থানীয় সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। এই দলের মোকাবেলায় আওয়ামী লীগকেও হয়তো দেখাতে হয়েছিল, ‘আম্মো’ (আমাদের) দলেও জেনারেল আছে। জেনারেল সফিউল্লাহ ও ভাইস অ্যাডমিরাল দুজনই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এবং জিয়ার ঘাতকচক্রের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবু দলে তাঁদের অন্তর্ভুক্তি দলের নিচের পর্যায়ে এই ইঙ্গিতই বহন করেছে যে সামরিক বাহিনীর সাবেক মেজর, কর্নেলরা দলে এলে বাধা দেওয়া নয়, সাদর সংবর্ধনা জানাতে হবে। এই সুযোগ নিয়ে গত তিন দশকে খোলা দরজা পেয়ে সামরিক বাহিনীর বহু সাবেক জুনিয়র অফিসার, যাঁরা জিয়ার ষড়যন্ত্র ও হত্যাকাণ্ডে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, তাঁরা পরবর্তীকালে গায়ের গন্ধ দূর করার জন্য আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের প্রকৃত নেতাকর্মীদের মাথায় ডাণ্ডা ঘোরাচ্ছেন। দলে একটি কঠোর শুদ্ধি অভিযান না চালালে এঁদের কবল থেকে আওয়ামী লীগকে মুক্ত করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা যে দেরিতে হলেও এঁদের সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন এবং দলের নেতাকর্মীদের সচেতন করতে চাইছেন, এটি আশার কথা।
আওয়ামী লীগ একটি প্রাচীন এবং বড় রাজনৈতিক দল। অনেকটা ব্রডচার্চের মতো। ব্রডচার্চে যেমন পাপীতাপী, পুণ্যবান লোক—সবাই আশ্রয় নিতে পারে, একটি বড় গণতান্ত্রিক দলেও চোর, বাটপাড়, ভালো লোক সবার যোগ দেওয়ার অধিকার আছে। এ ক্ষেত্রে যদি দলটি প্রত্যেক নতুন প্রজন্মের মানুষের কাছে আকর্ষণীয় দল হিসেবে বেঁচে থাকতে চায়, তাহলে তাকে ব্রিটিশ কনজারভেটিভ ও লেবার দলের মতো দলে নেতা বদল এবং নতুন রক্ত নিয়মিত সঞ্চালনে প্রস্তুত থাকতে হবে। আওয়ামী লীগে নিয়মিত নেতা বদল সম্ভব নয়। দেশটির সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক অবস্থায় এখনো একজন পিতৃতান্ত্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী নেতা দরকার। সেই নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের আছে। এই নেতা শেখ হাসিনা।
কিন্তু দলটির সাংগঠনিক পর্যায়েও নতুন রক্ত সঞ্চালিত হচ্ছে না। যে রক্ত আসছে, তা দূষিত রক্ত। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশের এই দুই বড় দলের দেহেই এখন এই দূষিত রক্তের প্রবাহ চলছে। ফলে দেশের রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্ব আসছে না। আদর্শবান কর্মীও তৈরি হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু দুর্নীতিবাজদের সম্পর্কে কঠোর ছিলেন। তিনি বহু এমপিকে দুর্নীতির দায়ে দল থেকে বহিষ্কার করেন, তাঁদের এমপি পদও ছিল না। মিজানুর রহমান চৌধুরীর মতো দলের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা ও মন্ত্রীকে তিনি পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে সামান্য নারীঘটিত অভিযোগের কারণে।
তখন দলের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বড় একটা অসুবিধা ছিল, দুর্নীতির অভিযোগে কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই তারা নবগঠিত জাসদ দলে যোগ দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বানোয়াট অভিযোগ তুলত এবং রাতারাতি বিপ্লবী সাজত। বঙ্গবন্ধু যখন বুঝলেন বহু ছিদ্রযুক্ত পশ্চিমা গণতন্ত্রের দ্বারা দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দমন করা যাবে না, জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটানো যাবে না, তখন তিনি বাকশাল পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন। ক্ষমতালিপ্সু কিছু জেনারেল এবং এই দুর্নীতিবাজরা মিলেই বঙ্গবন্ধু ও বাকশাল পদ্ধতিকে হত্যা করেছিল।
শেখ হাসিনার জন্য দুর্নীতি দমন আরো বেশি অসুবিধাজনক। কারণ বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদ দুর্নীতির দরজা খুলে দেন এবং দুর্নীতির দায়ে তাঁরা নিজেরাই যাঁদের জেলে দিয়েছিলেন, তাঁদের জেল থেকে বের করে এনে মন্ত্রী বানান। খালেদা জিয়া তো চোরাকারবারি, খুনি, সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের তাঁর মন্ত্রিসভায়ও স্থান দেন। তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমান মন্ত্র আওড়ান ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ এবং সরকারি ও বেসরকারি সব ব্যাংকের দরজা স্যুটকেসসর্বস্ব ব্যবসায়ীদের জন্য খুলে দেন। জনগণের অর্থ লুট করে রাতারাতি দেশে একটি প্রতাপশালী নব্য ধনিকশ্রেণি গড়ে ওঠে।
দীর্ঘ ২১ বছর পর দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম শেষে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন দেশের রাজনীতি কলুষিত। নব্য ধনীরা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী। সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ শ্রেণি পরাক্রমশালী, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। আওয়ামী লীগেও সামরিক শাসক দলের লোকসহ দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসের অনেক গডফাদার ঢুকে পড়েছে। রাতারাতি এদের দল থেকে বহিষ্কার করা সম্ভব নয়। ভারতে জওয়াহেরলাল নেহরুও তা পারেননি। কংগ্রেস দলকে পুনর্গঠনের জন্য কমিশন গঠন করে বহু প্রবীণ নেতাকে দল থেকে অবসরগ্রহণে বাধ্য করেছেন; কিন্তু দলকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারেননি। তাঁর পৌত্র প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল এবং দিল্লির রাস্তায় স্লোগান শোনা গিয়েছিল। ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়/রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়।’ কংগ্রেসের শেষ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং অত্যন্ত ভালো মানুষ বলে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর সরকারের বিরুদ্ধেও গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল।
লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তিন তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং এখনো এই পদে রয়েছেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে, তাঁর বোন রেহানা, পুত্র জয় এবং কন্যা পুতুলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তাঁর অতি বড় শত্রুরাও তুলতে পারেননি। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ও তাঁর পুত্র তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে এবং হাওয়া ভবনের কাহিনি তো এখন ইতিহাস।
তবে এটা সত্য, আওয়ামী লীগকে এখনো দুর্নীতিবাজমুক্ত করা যায়নি। তার বড় কারণ, দেশের বর্তমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক কলুষিত অবস্থা। সামরিক ও আধাসামরিক বিএনপির রাজত্বকালে দুর্নীতিবাজ নব্য ধনীরা এত শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে দেশের কোনো রাজনৈতিক দলই তাদের প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেনি। এই প্রভাব থেকে দেশের রাজনীতি মুক্ত করতে পারে একটি সামাজিক বিপ্লব। এই সামাজিক বিপ্লব ঘটানোর মতো পরিস্থিতি এখনো দেশে তৈরি হয়নি।
তথাপি দেশের এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও শেখ হাসিনা তাঁর দল আওয়ামী লীগকে গণমুখী রেখেছেন এবং দেশের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করেছেন, এটা তাঁর কৃতিত্ব। দলের ভেতরে ও বাইরে নানা বাধা, বর্তমানে বিশ্ব মহামারি করোনার প্রকোপ—তার মধ্যেও শেখ হাসিনা জাতিকে মনোবল হারাতে দেননি, অর্থনীতিতে বিপর্যয় ঘটতে দেননি, এটা তাঁর বড় সাফল্য। তিনি এত দিনে তাঁর দলে অতীতের সামরিক শাসনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের একাত্তরের ঘাতকদের সহচরদের দলে অনুপ্রবেশ সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকার এবং জনগণের সবচেয়ে বড় শত্রু দুর্নীতিবাজদের সম্পর্কে তিনি বহুবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন বটে; কিন্তু আওয়ামী লীগে তাদের অবস্থান এখনো দুর্বল হয়নি।
আমার আশা, আগামী নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমন একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন, যাতে দুর্নীতির রাঘব বোয়ালদের দল থেকে সরিয়ে দিয়ে জনগণের কাছে সৎ ও স্বচ্ছ চরিত্রের অধিকারী দলীয় প্রার্থীদের হাজির করা যায়।
সবচেয়ে বড় কথা, আগামী নির্বাচনেও শেখ হাসিনাকে জয়ী হতে হবে এবং ক্ষমতায় আসতে হবে। সে জন্য দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে লাল ঘোড়া দাবড়াতে হবে। শেখ হাসিনার বিকল্প নেতৃত্ব দেশে এখনো তৈরি হয়নি। তাঁকে তাই আরেক দফা ক্ষমতায় থাকতেই হবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধেও নেতৃত্ব দিতে হবে।
লন্ডন, সোমবার, ৩১ আগস্ট ২০২০