লেখকের বিচিত্র মানস: নাইপলকে চেনা সহজ নয়

দুলাল আল মনসুর

ভি এস নাইপল
ভি এস নাইপল। ফাইল ছবি

ত্রিনিদাদের পটভূমিতে লেখা ভি এস নাইপলের প্রথম দিকের উপন্যাসগুলো তাঁর বৃহত্তর পরিচিতি তৈরি করে। বৃহত্তর জগতের পরিসরে লেখা বিচ্ছিন্নতাবিষয়ক উপন্যাস এবং জীবন ও ভ্রমণ সম্পর্কিত লেখার জন্য নাইপল পাঠকের কাছে প্রিয়, বিশেষ করে তাঁর চমৎকার গদ্যের জন্য। বুকার ও নোবেল পুরস্কার পাওয়া ত্রিনিদাদের লেখক নাইপল ৫০ বছরের মতো সময়ে ৩০টির বেশি ফিকশন, নন-ফিকশন বই লিখেছেন।

লেখক হয়ে ওঠার স্বপ্ন শুরু হয়েছিল তাঁর জন্মস্থান সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ ত্রিনিদাদে। বিভিন্ন জাতের ও সংস্কৃতির মানুষের সমাবেশস্থল ছিল তখনকার ত্রিনিদাদ। বড় হওয়ার পর উচ্চাভিলাষী নাইপল বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি এই দেশে থাকবেন না। তার পরও তিনি এই দেশের প্রতি ভালোবাসা মুছে ফেলতে পারেননি। এই দেশের আবহের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘লেখকের দৃষ্টি থেকে দেখলে, এই দেশটা হলো খাঁটি সোনা। সত্যিই খাঁটি সোনা।’ ত্রিনিদাদই তাঁর লেখক মানস তৈরি করে এবং আজীবন এই দেশের কথা মনে রাখেন তিনি। তার প্রমাণ অনেক বইয়ে আছে।

universel cardiac hospital

বাবা ত্রিনিদাদ গার্ডিয়ানের চাগুয়ানাস প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করেন ১৯২৯ সালে। মফস্বল চাগুয়ানাসেই জন্ম নাইপলের। এখানেই ভারতীয় ত্রিনিদাদবাসীদের বসবাস। পরিবার ও সন্তানদের জন্য এই মফস্বল উপযুক্ত নয় বলে মনে হতে থাকে নাইপলের বাবার। ১৯৩৮ সালে তিনি সুযোগ পেয়ে যান ত্রিনিদাদ গার্ডিয়ানে সার্বক্ষণিক কাজ করার এবং সেই উদ্দেশ্যে বাস গুটিয়ে পোর্ট অব স্পেনে চলে যান। ছয় বছরের বালক নাইপল চোখের সামনে দেখতে পান নগরজীবনের উন্মুক্ত আনন্দ। কিছুদিন পর ট্রাংকুইলিটি বয়েজ স্কুল পার হয়ে কুইন্স রয়াল কলেজে পড়ার সময় নাইপল বাবার লেখকসত্তার পরিচয় পান। ১৯৪৩ সালে নিজের চেষ্টায় বাবা গল্প সংকলন ‘গুরুদেব অ্যান্ড আদার ইন্ডিয়ান টেলস’ প্রকাশ করেন। গল্পগুলো তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া খুব কাছ থেকে দেখেন নাইপল। বাবার লেখা দেখে উপনিবেশে বাস করা বালক নাইপল বড় লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। ১৯৫০ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ অক্সফোর্ডে ইংরেজি পড়তে যান মূলত লেখক হওয়ার মানসে।

লেখক নাইপল অবশ্য খুব সহজ-সরল কিংবা সোজা ছিলেন না। শুরুর দিকের লেখার কারণে তাঁর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান লেখক বন্ধুরা খানিকটা বিপাকে পড়ে যান। তাঁর ব্যঙ্গাত্মক লেখা সম্পর্কে আপত্তি ওঠে চারপাশ থেকে। নন-ফিকশন বই ‘দ্য মিডল প্যাসেজ’-এ তিনি লিখে ফেলেন, ‘ইতিহাস তৈরি হয় অর্জন ও সৃষ্টিকে ঘিরে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে ইতিহাস তৈরি করার মতো কিছুই সৃষ্টি হয়নি।’ সবাই স্বাভাবিকভাবেই বুঝে যান, নাইপল ওয়েস্ট ইন্ডিয়াবিরোধী লেখক। আফ্রিকার বংশোদ্ভূত মানুষের প্রতি তাঁর সংকীর্ণ পরিচয় পেয়ে মানুষ তাঁকে অপছন্দ করা শুরু করে। তিনি বলেন, আফ্রিকার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। উপন্যাসের চেয়ে ভ্রমণবিষয়ক লেখার কারণেই নাইপল বেশি সমালোচিত। তিনি তৃতীয় বিশ্বের মানুষকে অবজ্ঞার চোখে দেখেন ওই সব লেখায়।

ভিন্ন জগতে বিচরণকারী লেখকের যথার্থ জীবনী ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ হোয়াট ইট ইজ’। তাঁর দর্শনে তিনি নিজে ছাড়া জগতের আর সবই তুচ্ছ। তিনি মনে করেন, বাইরের জগৎ সম্পর্কে যা লিখেছেন যথার্থতার সঙ্গেই লিখেছেন। আসলে তাঁকে চেনা খুব সোজা নয়।

ব্যক্তিগত জীবনেও নাইপল খুব সহজ মানুষ ছিলেন না। তাঁর লেখার প্রথম পাঠক, সমালোচক এবং খানিকটা সম্পাদকের মতো ছিলেন প্রথম স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া অ্যান হেইল। ১৯৫৫ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। ১৯৯৬ সালে প্যাট্রিসিয়া ক্যান্সারে মারা যান। ৪১ বছরের দাম্পত্যজীবনে নাইপল স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুরতম আচরণ করেছেন। বিয়ের প্রায় শুরু থেকেই প্যাট্রিসিয়া জেনে যান, তাঁর স্বামীর রক্ষিতা আছেন একজন। মার্গারেট গুডিং ও নাইপলের মাঝখানে প্যাট্রিসিয়া কাবাবের ভেতর হাড্ডির মতো জীবন কাটাতে থাকেন। মানসিক আঘাত সহ্য করতে না পেরেই তিনি আরো দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। নাইপলের নিষ্ঠুরতার মধ্যে বিবেকের বড় অভাবও ছিল। আবার এটাও বলেন, তাঁর লেখালেখির কাজে সাহায্যের জন্য তাঁর স্ত্রীকেও দরকার। আবার প্যাট্রিসিয়াকেই তিনি বলেছেন, তাঁর আচরণ নাকি লেখকের স্ত্রীর আচরণের মতো নয়। তাঁর আচরণ নাকি কেরানির বউয়ের আচরণের মতো। নাইপলের সঙ্গে বিয়ের সূত্রে প্যাট্রিসিয়া নাকি তাঁর নিজের যোগ্যতার চেয়ে বেশি উঁচু মর্যাদায় উন্নীত হয়েছেন। স্ত্রীকে নির্যাতনের আরেক পর্যায়ে নাইপল প্যাট্রিসিয়াকে বলেছিলেন, ১৯৬৭ সাল থেকে তাঁর সঙ্গে শারীরিক মিলনে সুখ পাচ্ছেন না। প্রথম থেকেই প্যাট্রিসিয়া নাইপলকে পূজা করার মতো ভক্তিসহকারে ভালোবাসতেন। তারই সুযোগ নিতে থাকেন বিবেকহীন নাইপল। ব্যক্তিগত ডায়েরিতে প্যাট্রিসিয়া লিখে গেছেন, কেমন করে তিনি ক্রমান্বয়ে নাইপলের রাঁধুনির মতো হয়ে গেলেন, পরিচর্যাকারীর মতো হয়ে গেলেন। নিজের নিষ্ঠুরতার কথা নাইপল ঠিকই বুঝতেন। তবু স্ত্রীর অসুস্থতার কথায় তাঁর কষ্টের কোনো অনুভূতিই ছিল না। এমনকি ওই সময়ে, যখন প্যাট্রিসিয়ার ক্যান্সার ধরা পড়ে তখনো নাইপল স্ত্রীর প্রতি কোনো রকম সমবেদনা জানাননি।

প্যাট্রিসিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর রক্ষিতা মার্গারেটকে নাইপল বিয়ে করতে পারতেন। কিন্তু স্বার্থপর নাইপলের সেই সময়কার যুক্তি হলো, ‘মার্গারেটের জন্য আমার করার কিছু নেই। সে মাঝবয়সে আসা পর্যন্ত তার সঙ্গে আমি ছিলাম। এখন সে তো প্রায় বুড়ি।’ প্যাট্রিসিয়ার মৃত্যুর মাত্র ছয় দিন পর পাকিস্তানের সাংবাদিক তালাকপ্রাপ্তা নাদিরাকে তাঁর কাছে আসার ব্যবস্থা করেন নাইপল। দুই মাস পরই নাইপল ও নাদিরা বিয়ে করেন। ব্যক্তিগত জীবনে নাইপল অনেকের কাছেই ছিলেন নিষ্ঠুর, দুর্বিনীত, ইতর ও স্বার্থপর। উগ্র স্বভাবের জন্য তিনি সাহিত্যজগতের অনেক বন্ধুর সমর্থনও হারিয়েছেন।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে