-ভাই বিড়ি হইব?
রাত্রি বেলা। পার্কের একটা চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছিল নাসির। আগুন্তুকের কথায় তার তন্দ্রা ভাঙল। পকেট থেকে সিগেরেটের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগেরেট বের করে দিল সে। লোকটাকে একবারে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল। মাথায় পুরনো একটা ব্রিটিশ স্টাইলের হ্যাট। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যরা এই ধরনের হ্যাট পড়ত। গায়ে একটা পুরনো ছেড়া শার্ট আর ক্ষয়ে যাওয়া কোর্ট। অথচ পায়ে জুতা নেই!
-এই দুনিয়া আর আগের দুনিয়া নাই ভাই।
আগুন্তুক লোকটা সিগেরেটে টান দিতে দিতে কথাটা বলে।
-ক্যান? (মারুফ)
-এই ধরেন আগের সেই পল্টনের ময়দান আছে? আরমেনিটোলার মাঠ, ঠাটারি বাজারের শিক কাবাব। ওহ আপনে তো আবার ওইসব চিনবেন না। পঁয়ষট্টির কথা কইতেছিলাম। আহ, স্টারক সিগ্রেটের কি ত্যাজ আছিল ভাই। বিড়িত যত জোড়ে টান দিতাম গুলিস্থানের ড্রেনে পেচ্ছাবের স্পীড তত বাড়ত।
-আপনাকে দেখে তো এত বয়সি মনে হচ্ছে না। বেশি হইলে পঞ্চাশ হইতে পারে। যুদ্ধের আগে আপনার জন্ম হইছে বলে মনে হয় না। (মারুফ)
কথাটা শুনে লোকটা হেসে উঠল। হাসিটা মারুফের চেনা। বিলেতি গলির পানের দোকানি মানু চাচা মুখে একসাথে দুইটা পান এক সাথে গলাদ্ধঃকরন করতে গিয়ে এমন করে হাসে। সে সময় সামনে যারা থাকে তারা মানু চাচার মুখের পানের বকি অর্ধেকে মাখামাখি হয়।
-ভূতের আবার বয়স!
বলেই লোকটা জিহ্বায় দাত লাগায়। গ্রামের মুরুব্বীদের হঠাৎ করে বেফাঁস কথা বলে ফেললে এমন করে।
- আপনে ভুত।
বলেই মারুফ বিপরীত প্রতিক্রিয়ার একটা হাসি দেয়।
-ওই মিয়া থামেন। ভুত বিসয়ডা কি হাসির? জানেন আপনারে আমি ভয় দ্যাখাবার পারি।
বলেই সেই ঘোর ঘোর শব্দ করতে লাগল। তার গায়ের রঙ লাল হয়ে যেতে লাগল। মারুফ বেশ কয়েক বার জিয়োগ্রাফি চ্যানেলে এই রকম বাঘের শব্দ শুনেছে। বিষয়টা তাকে ভাবনায় ফেলে দিল। সত্যই সে যদি ভুত হয় তাহলে ত সমস্যা। কিন্তু সব মিথ্যে প্রমান করে দিয়ে আগুন্তুক হর হরিয়ে বমি করা শুরু করে দিল। - অবশ্য সাইডে গিয়েই কাজটা সেরেছে তাই বাঁচা গেছে। ভাবল মারুফ।
-ত্যাতাল্লিসে বার্মার পতনের পর দ্যাশে দুর্ভিক্ষ শুরু হইল। দুইদিন ক্ষিধার ঠ্যালায় বাকেরগঞ্জের অভাবে পরা এক গেরস্থের ভাত চুরি করছিলাম। ওই সালার অভিশাপেই আর কাউরে ভয় দেখাইতে পারি না। বমি পায়।
লোকটা মুখ মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিল।
বেশ কয়েকটা চাকুরীর পরীক্ষায় ভাইভা ফেরতের পর আজ তার সাধের টিউশনিটাও গেল। তাই শোক কাটাতে পার্কে বসা। এই সালা পাগলের পাল্লায় পড়ে শোঁকটাও বোধ হয় আর করা হয়ে উঠল না।
-শ্যাসে আমারে পাগল ভাবতাসস। তোরে একটু চমকায়া দেই। বাড়িত যাহ। তোর চাকুরি হয়ে গেছে। তবে তর ছোট ভাইটা বোধহয় আর টিকব না।
মারুফ মাথা নিচু করে ভাবছিল। হঠাৎ আগুন্তুকের কথায় চমকে যায়। গ্রামে তার একটা অসুস্থ ছোট ভাই আছে সে জানল কিভাবে? মাথাটা তুলে সামনে তাকায়। না লোকটা নেই। পার্কে এখানে ওখনে তাকায়। নাহ কেউ নেই। তার বুকটা হঠাৎ কভয়ে কেপে ওঠে।
-ওই মিয়া এত রাইত্তে কার লগে কথা কন? দেইখা তো ভালা ঘরের মনে হয়। যান বাড়ি যান।
বাদামী কালারের ড্রেস পরা পার্কের চৌকিদার টর্চ হাতে মারুফের সামনে দাড়িয়ে।
মারুফ হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। সর্বনাশ রাত দেড়টা বাজে। মালিক তো আজ মেসেই ঢুকতে দেবে না। তাড়াতাড়ি মেসের পথে রওনা দেয়।
মেসে গিয়ে অবাক হয় সে। সবাই জেগে রান্না করছে। আজ স্পেশাল মেনু।
-মারুফ ঘরে ঢুকেই ডাবলুকে বলল নেটে চাকুরীর রেজাল্টটা দেখসস?
-আরে ভাই দেখসি মানে! দেইখাই তো এত আয়জন। সব তোমার সৌজন্যে। ট্যাকা ছাড়ো নাইলে রেজাল্ট কমুনা।
-কাইল নিস। আজ বেশি নাই।(মারুফ)
-আরে যাই আছে তাই দাও। এই মামুন, ভাইয়ের হাত দুটা ধর। আমি মানিব্যাগ চেক করি। ডাবলু মারুফের পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগ বের করে আনে।
খালি তিনশো। এটা দিয়েই চলাইতে হবে। এই নাও তোমার রেজাল্ট বলেই, বল্টু হাতে একটা প্রিন্টেড কাগজ ধরিয়ে দেয়। সেখানে অনেকগুলো নামের সাথে মারুফের নামের পাশে সিলেক্টেড লেখাটা চক চক করে ওঠে।
মারুফের ছোট ভাইয়ের কথাটা মনে পড়তেই সাইডে গিয়ে বাড়িতে কল দেয়। ‘তর ছোট ভাইটা বোধহয় আর টিকব না’ অচেনা সেই লোকটার কথা মনে হতেই ফের বুকে যেন হাতুড়ির বাড়ি পরতে লাগল।
-ধুর কল ধরছে না ক্যান বলেই আবার কল দেয়………।।
কিছু কিছু গল্প এই দশকের পর দশক চলতে থাকে নীরবে এ ঘরে ও ঘরে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি