শিশু-কিশোর, মূলত কিশোর শিক্ষার্থী—পিঠে স্কুলব্যাগ, কলকল কথায় মুখর পথ, দু-চারজন মেধাবী চুপচাপ, বোধ হয় মনে মনে হোমটাস্ক আওড়াচ্ছে—সাধারণ ছাত্রদের সরবে পথচলা—স্কুল প্রাঙ্গণেও তাই কিংবা খেলার মাঠে তৎপরতা—কিছু ব্যতিক্রমী তৎপরতা—বেশ কিছুকাল আগে কিশোর শিক্ষার্থীদের ঘিরে দৃশ্যপট মোটামুটি এ রকমই ছিল।
রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবর্তনের পথ ধরে কখন যে তাদের হাতে প্রথম লাঠি, পরে ধারালো ক্ষুর এবং সেই ধারাবাহিকতায় আগ্নেয়াস্ত্র, বড় ভাইয়াদের মদদে, তাদেরও নেপথ্যে আরো বড়রা—ওই সব কাহিনি ভয়ংকর। আপাতত আমরা ‘কিশোর গ্যাং’ নিয়েই কথা বলব—এরা বয়সের তুলনায় সন্ত্রাসী তৎপরতায় কম ভয়ংকর নয়।
ভাবা যায় না শিক্ষা পরিবেশের ঘটনা কোথা থেকে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। বহু কথিত ‘কোমলমতি’ কিশোর শিক্ষার্থীদের হাতে ক্ষুর ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, সহপাঠী খুন, মাদকাসক্তি এবং বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী অপরাধী অপতৎপরতা। বেশ কিছুদিন আগে কুমিল্লায় এজাতীয় একটি ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশ যথেষ্ট চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। সেই ধারাবাহিকতা চলেছিল বেশ কিছুদিন ধরে নানা সন্ত্রাসী তৎপরতায়। তখন থেকেই সংবাদমাধ্যমে কিশোর গ্যাং শব্দগুলোর প্রচলন। ঘটনা শুধু সংবাদ পাঠকই নয়, সমাজে সবার কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল।
অল্প কয়েক বছরের মধ্যে মহামারির মতোই কিশোর সন্ত্রাসীপনার অভাবিত বিস্তার, রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে। শুরুতে কেন্দ্রীভূত ছিল স্কুল শিক্ষার্থীদের অংশবিশেষের মধ্যে—এখন এর বিস্তার ঘটেছে অশিক্ষার্থী কিশোরদের মধ্যে, এমনকি বস্তিবাসীর মধ্যেও। বলাবাহুল্য, এর তাৎপর্য ভয়ানক।
কয়েক দিন আগে দৈনিক পত্রিকায় একটি খবর ছাপা হয়েছিল, এক টোকাইয়ের নেতৃত্বে এজাতীয় গ্যাং—এর মধ্যে রয়েছে অভিজাত পরিবারের কিশোর সক্রিয় সদস্য—কাজ করছে ওই টোকাই নেতার নেতৃত্বে। এমন সব বিচিত্র ঘটনার খবর প্রকাশ পাচ্ছে সংবাদপত্রের পাতায়।
দুই.
এ উপলক্ষে যেসব ঘটনা ঘটছে, সংবাদপত্রে যা প্রকাশ পাচ্ছে ‘কিশোর গ্যাং’, ‘গ্যাং কালচার’ ইত্যাদি শিরোনামে তার ভয়ংকরতা শুধু ঘটনাতে সীমাবদ্ধ নয়, এর পরিণাম সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিচারে আরো ভয়ংকর। এরই মধ্যে দেশের একাধিক শহরে এজাতীয় ঘটনার অনেক খবর দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর সর্বনাশা রূপ সমাজের বিশিষ্ট স্তরে কিংবা রাজনৈতিক অঙ্গনে বা প্রশাসনে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে, তা অন্তত সুস্পষ্টভাবে বলা কঠিন।
এ সময়কার একটি ছোট খবরই উল্লেখ করি—শিরোনাম : ‘নারায়ণগঞ্জে বেপরোয়া কিশোর গ্যাং’। প্রতিবেদনের বিশদ বিবরণে না গিয়ে শুধু এটুকু উল্লেখ করি, ‘গত ১০ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের ইস্পাহানি ঘাট এলাকায় দুটি কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষের সময় পানিতে ডুবে মারা যায় দুই কিশোর ছাত্র, একজন দ্বাদশ শ্রেণির, অন্যজন নবম শ্রেণির।’
প্রতিবেদনে এ ছাড়া রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসীপনায় সংঘটিত একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনার উল্লেখ। এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে দুই ধরনের সামাজিক চেতনার প্রকাশ। একদিকে অভিভাবকসহ সুধীজনদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অন্যদিকে স্বল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে হলেও প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, ‘পারিবারিক আশকারা’। বলা বাহুল্য, শেষোক্ত কারণটি অর্থনৈতিক প্রাপ্তিযোগ, যা সামাজিক অবক্ষয়ের চমকপ্রদ উদাহরণ।
নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের বিপুল প্রভাব, দুই ভিন্ন দিক থেকে। তারা কি এই কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না? যা হোক, ওই প্রতিবেদন মতে পুলিশের অভিমত, বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জের উল্লিখিত সন্ত্রাসী ভয়ংকরতা প্রতিরোধ করতে দরকার স্থানীয় অভিভাবক, সুধীসমাজ, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের অন্তর্ভুক্ত সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনগুলোর সহযোগিতা।
সন্দেহ নেই, পুলিশের অভিমত বাস্তবভিত্তিক। এ কাজে নাগরিকদের সম্মিলিত সহযোগিতা অপরিহার্য। পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে মূল করণীয় ও দায়িত্ব পুলিশ প্রশাসনের এবং রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধিদের। কারণ তাঁরাই সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ প্রশাসনের হাতে বিস্তর ক্ষমতা। সে ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগে অনেক অর্জন সম্ভব।
তিন.
কিশোর গ্যাং শুধু সন্ত্রাসীপনায় সীমাবদ্ধ নয়, এর তৎপরতা ও কার্যকর বিস্তার অনেক ব্যাপক এবং সামাজিক বিচারে তাৎপর্যপূর্ণ। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য মাদকাসক্তি, মাদক কারবার ও নারী ধর্ষণের মতো জঘন্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। সমাজে গড়ে তুলছে বিরাট এক অপরাধীচক্র, তথা চক্রের অংশ।
উদাহরণ, ফতুল্লার পাগলায় পোশাক শ্রমিক ধর্ষণে সংশ্লিষ্ট পাঁচ কিশোরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ (১৯ আগস্ট, ২০২০)। নারায়ণগঞ্জের সুধীসমাজের এক বিশিষ্ট নাগরিক বলেন, ‘ইভ টিজিং এদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এদের রুখতে প্রশাসনকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।’ তাঁর অভিমত, ‘তা না হলে এরা বড় হয়ে ভবিষ্যতে বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলবে।’
আমরা নারায়ণগঞ্জের কথা একটু বিশদভাবে বললাম গোটা দেশের প্রতীক হিসেবে ঘটনার গুরুত্ব বিচারে। কারণ ঘটনা সর্বত্র একই চরিত্রের। আর অবাক হচ্ছি আমরা লক্ষ করে যে সারা দেশ যখন করোনা মহামারির দুর্যোগে ভুগছে তখনো থেমে নেই সমাজে নানামাত্রিক দুর্নীতি, থেমে নেই কিশোরদের অপরাধমূলক ঘটনার দৌরাত্ম্য। এমনকি নারী ধর্ষণ।
আরো অভাবিত ঘটনা হলো, এসব কিশোর অপরাধ ঘটছে শ্রেণি-নির্বিশেষে। দিনমজুর বস্তিবাসী সন্তান থেকে অভিজাত পরিবারের কিশোরও এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। আগেই বলেছি মাদকের কথা। সুস্পষ্ট কথায়—দল বেঁধে মাদক সেবন থেকে মারামারি, এমনকি হত্যাকাণ্ড; আর পাড়ায় বা মহল্লায় কিশোরী ও তরুণীদের উত্ত্যক্ত করা তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ফলে কখনো দেখা যায় প্রতিক্রিয়ায় উত্ত্যক্ত কিশোরীর আত্মহত্যা।
কালের কণ্ঠ’র একটি ভাষ্যে জানা যায়, ‘গত বছর ঢাকায় র্যাব-পুলিশের ব্যাপক অভিযানে অন্তত ৩০টি কিশোর গ্যাংয়ের দুই শতাধিক সদস্য গ্রেপ্তার হয়। তখন শনাক্ত হওয়া ৬২টি গ্রুপের মধ্যে অন্তত ৪২টি এখনো সক্রিয়। হামলা, সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই কিশোরদের একটি অংশ জড়িয়ে পড়ছে অপরাধীচক্রের সঙ্গে। ঘটাচ্ছে ভয়ংকর সব অপরাধ।’ প্রশ্ন উঠতে পারে, হঠাৎ করেই কয়েক বছরের মধ্যে সমাজে এমন অঘটন ঘটতে গেল কেন, কী কারণে?
বলা বাহুল্য, কারণ বহুবিধ এবং তা সমাজের নানা স্তরে বিস্তৃত। আমরা সাধারণ বিচারে এর কারণ হিসেবে বলে থাকি সামাজিক অবক্ষয়ের কথা, মূল্যবোধ ও আদর্শগত অভাবের কথা। সুস্পষ্ট ভাষায় দায়ভার নির্ধারণ করতে চাইলে প্রথম অভিযোগের দণ্ডটা নেমে আসে পরিবারের ওপর। পারিবারিক শিক্ষার অভাব, শৈশব থেকে সন্তানদের আদর্শনিষ্ঠ, সৎপথে পরিচালনায় অভিভাবকদের উদাসীনতা একটি প্রধান কারণ।
বিত্তবান বা মধ্যবিত্ত ও অনুরূপ পরিবারে অভিভাবকরা ব্যস্ত নিজ নিজ কাজে বা অবসর-বিনোদনে। তাঁরা ভুলে থাকেন যে সন্তানদের, প্রচলিত ভাষায় ‘মানুষ’ করে গড়ে তোলার দায় তাঁদের কাজ ও কর্তব্যের অংশ। সে দায় পালিত না হলে আদর্শহীন শিশু-কিশোর শিক্ষায়তনে বা বাইরে সঙ্গীদের কুপ্রভাবে পথভ্রষ্ট হয়, নিষিদ্ধ পথের টানে অপরাধজগতের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। ক্রমে তা বাড়তেই থাকে নানা মাত্রায়।
দ্বিতীয় দায়িত্ব শিক্ষায়তনের অভিভাবক তথা শিক্ষকদের, যদিও সেটা সময় বিচারে আংশিক, তবু গুরুত্বপূর্ণ নজরদারির বিচারে। শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষার্থীরা কী করছে সেদিকে লক্ষ রাখার দায় অবশ্যই শিক্ষকদের। প্রহার নয়, শাস্তি নয়, সন্তানতুল্য মায়া-মমতা ও দরদ দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়েই পথভ্রষ্টদের সঠিক পথে নিয়ে আসার দায়িত্ব শিক্ষকদের। সে দায়িত্ব কি তাঁরা পালন করে থাকেন? এককথায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে করেন না। ফল যথারীতি নেতিবাচক।
এর ফলে এই যে সন্ত্রাসী কিশোর গ্রুপ গড়ে উঠছে, তা পুরোপুরি বন্ধ করার দায়িত্ব তো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তাদের উল্লিখিত তথ্যে যে ৪২টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে তাদের গ্রেপ্তার ও কার্যকলাপ বন্ধ করা কি একান্তই অসম্ভব? ব্যবস্থা না নিলে কথিত ৪২টি গ্রুপ বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে পরিস্থিতি আরো বেসামাল করে তুলবে। কাজেই এ কাজটি এখনই নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করা দরকার।
জাতীয় স্বার্থ বিবেচনাতেই কষ্টসাধ্য হলেও এ দায় পালন করতে হবে। এরপর তাদের সংশোধনাগারে প্রেরণ স্বাভাবিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য। সেখানেও যে কত ভুলভ্রান্তি, কত অযোগ্যতা, তা ইদানীং প্রকাশিত কয়েকটি ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিশোর গ্যাং বিষয়ক এদিকটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আগামীতে তা আলোচনার ইচ্ছা রইল।
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী