না ফেরার দেশে সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

আবু ওসমান চৌধুরী
সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী। ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত না ফেরার দেশে চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও চাঁদপুর জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক আবু ওসমান চৌধুরী। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। শনিবার সকাল ৮টার দিকে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল ইসলাম জেমস জানিয়েছেন, শনিবার বাদ আসর সেনানিবাসে সেনাকুঞ্জের পাশে সেন্ট্রাল মসজিদে আবু ওসমান চৌধুরীর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর বনানী সামরিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।

universel cardiac hospital

আবু ওসমান চৌধুরী (৮৫) মুক্তিযুদ্ধকালে ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সহসভাপতি। দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক নানা অসুস্থতায় ভুগছিলেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা।

শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে গত ৩০ আগস্ট দুপুরে তাকে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে পরীক্ষা শেষে তার শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়।

আবু ওসমান চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরও শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, আবু ওসমান চৌধুরী ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার মদনেরগাঁও গ্রামের চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন৷ তার বাবার নাম আব্দুল আজিজ চৌধুরী এবং মায়ের নাম মাজেদা খাতুন৷ নিজ গ্রাম মদনেরগাঁওয়ের ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন৷ ১৯৪৫ সালে পার্শবর্তী গ্রামে মানিকরাজ জুনিয়র হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন৷ চান্দ্রা ইমাম আলী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে ১৯৫১ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন৷ পরে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন তিনি৷ কিন্তু ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, শারীরিক অসুস্থতা ও পারিবারিক নানা সমস্যার কারণে ঢাকা কলেজে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করতে পারেন নি তিনি৷ পরে ১৯৫৪ সালে চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও ১৯৫৭ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে তিনি বিএ পাস করেন।

১৯৫৭ সালে আবু ওসমান চৌধুরী ঢাকা এয়ারপোর্টে ‘এয়ারপোর্ট অফিসার’ হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন৷ এই পদের প্রশিক্ষণে থাকাকালীনই তিনি সেনাবাহিনীতে কমিশনের জন্য প্রদত্ত পরীক্ষায় পাস করায় আন্তবাহিনী নির্বাচন বোর্ডে উপস্থিত হবার জন্য ডাক পান৷ ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি তত্‍কালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কোহাটে অবস্থিত অফিসার্স ট্রেনিং স্কুলে (ওটিএস) যোগ দেন৷ সেখানে ৯ মাসের কঠিন প্রশিক্ষণের পর ১৯৫৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন৷ ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি মেজর পদে পদন্নতি লাভ করেন৷ ১৯৬০ সালে কুমিল্লার মৌলভী পাড়ার মনসুর আহম্মেদের বড় মেয়ে নাজিয়া খানমের সঙ্গে আবু ওসমানের বিয়ে হয়। নাসিমা ওসমান ও ফাওজিয়া ওসমান তাদের দুই মেয়ে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আবু ওসমান চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর পদে কুষ্টিয়ায় কর্মরত ছিলেন। অপারেশন সার্চলাইট-এর সংবাদ পেয়ে ২৬শে মার্চ সকালে বেলা ১১টায় তিনি চুয়াডাঙার ঘাঁটিতে পৌঁছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সসৈন্য যোগ দেন। এর আগে ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ আবু ওসমান চৌধুরী পদ্মা মেঘনার ওপারে কুষ্টিয়া থেকে বরিশাল জেলা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাকে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গণ নামকরণ করে সে রণাঙ্গণের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন৷ পরে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার তাকে দক্ষিণ পশ্চিমাংসের আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করেন৷ ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হলে আবু ওসমান চৌধুরী এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে মন্ত্রিপরিষদকে গার্ড অব অনার দেন। মে মাসের শেষার্ধে প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনকে দুই ভাগ করে ৮নং ও ৯নং সেক্টরদ্বয় গঠন করেন এবং ৮ নং সেক্টরের দায়িত্বে আবু ওসমানকে নিয়োগ করা হয়৷

২০১৪ সালে আবু ওসমান চৌধুরীকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়। (ফাইল ছবি)

তার স্ত্রী নাজিয়া খানমও সে সময় রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে খাবার ও পানীয়, টাকাপয়সা পৌঁছে দেওয়া এবং প্রয়োজনে ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ পাহারা দেওয়ার মতো কাজ করেছেন সাহসিকতার সঙ্গে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবু ওসমান চৌধুরীকে লেফটেনেন্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়, বঙ্গবন্ধু তাকে আর্মি সার্ভিস কোরের (এএসসি) পরিচালকের দায়িত্ব দেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সেনা অভ্যুত্থানের সময় একদল সেনসদস্য আবু ওসমান চৌধুরীকে হত্যার জন্য তার গুলশানের বাড়িতে হামলা করে। বাড়িতে না থাকায় তিনি সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও নিহত হন তার স্ত্রী নাজিয়া খানম।

পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আবু ওসমান চৌধুরী। তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যানের পদেও ছিলেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে আবু ওসমান চৌধুরীকে বিজেএমসির চেয়ারম্যান করা হয়। পরে তাকে চাঁদপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১৪ সালে আবু ওসমান চৌধুরীকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে সরকার।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে