সংসদে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ

হারুন অর রশীদ রুমিন ফারহানা

বন্দুকযুদ্ধের নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রসফায়ারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপির দুজন সংসদ সদস্য। এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানান তারা।

আজ সোমবার স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে একাদশ জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সংসদ সদস্য হারুন অর রশীদ। এরপর তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই দাবি করেন বিএনপির আরেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা।

হারুন অর রশীদ তার নির্বাচনী এলাকা চাপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের বিভিন্ন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ টেনে বলেন, এসব হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সংবিধান লংঘন করা হচ্ছে। আমি গত বছর ২৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে এমপি হিসেবে শপথ নেয়ার মাত্র দুদিন পর ৩০ এপ্রিল আমার নির্বাচনী এলাকায় প্রকাশ্যে আরেকটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে। দিনের বেলায় অমানবিকভাবে হত্যাকাণ্ড হয়। একটি পেশাদারী প্রতিষ্ঠান দুপুর তিনটার সময় একজন সাধারণ নাগরিককে ধরে নিয়ে এসে তাকে গুলি করে হত্যা করে এবং পুলিশি এজাহার দাখিল করে এই ঘটনা ঘটে থানা থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে। সেই এজহারে বলা হয় পুলিশের ওপর বেপরোয়া আক্রমণ চালানো হয়েছে। কিন্তু অস্ত্র দেখানো হয়েছে হাতে তৈরি অস্ত্র।

স্পিকারের উদ্দেশ্য করে বলেন, এই বিষয়গুলো শিকার আমি, আপনার কাছে পাঠাব আপনি অবশ্যই মন্ত্রীকে ব্যবস্থা নিতে বলবেন। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই ঘটনায় ২ জন ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে তাদের একজন আমাদের এলাকার ভাইস চেয়ারম্যান ক্যান্ডিডেট ছিলেন। আর তার বড় ভাই। অথচ ঘটনার দিন তারা সংসদে এসে সংসদ গ্যালারি থেকে আমাদের অধিবেশন দেখেছেন। সংসদে ঢুকতে হলে সবার অনুমতি নিতে হয়। এই সংসদের কাছে এ ধরনের ডকুমেন্টস আছে। তাদের নামে আমি পাস ইস্যু করেছিলাম ৩০ তারিখ। তারা দর্শক গ্যালারি থেকে এই সংসদে উপস্থিত ছিল। তাদেরকে সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিল উল্লেখ করে মামলার আসামি করা হয়েছে।

হারুন বলেন, মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা হত্যাকাণ্ডের আজকে বিচার হচ্ছে। আদালত তাদের পরিবারের মামলা গ্রহণ করেছে তদন্ত কাজ চলছে। কিন্তু বাংলাদেশে আরও প্রায় তিন হাজারের অধিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। তারা কি বিচার পাবে না? তাদের পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াবে না? তাদেরকে কি রাষ্ট্র এই অধিকার দেবে না?

এরপর বিএনপির সহ আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা সংবিধানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আইন ব্যতীত কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার কারও নেই। সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন অনুযায়ী সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এই সরকার ২০১৩ একটি আইন করেছিল হেফাজতে নির্যাতন মৃত্যু নিবারণ আইন। দুর্ভাগ্যবশত ওই আইনটি করা হলেও চমৎকার সব ধারা থাকা সত্ত্বেও এই আইনে কিন্তু খুব বেশি মামলা হয়নি। গুটি কয়েক মামলা হয়েছে। সেই মামলাগুলো এখন কি অবস্থায় আছে, কতটুকু অগ্রগতি আছে, সেই ব্যাপারে কিন্তু আমরা বেশি কিছু জানি না।

তিনি বলেন, সম্প্রতি একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সবারই দৃষ্টি কেড়েছে। অথচ প্রতিদিনই একটির বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়। আমি যদি পরিসংখ্যান দিয়ে বলি ২০১৮ সালে ৪৬৬ জন ২০১৯ সালে ৩৮৮ জন আর ২০২০ সালে করোনাকালে প্রথম ছয় মাসে ১৫৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। আমরা যদি পাটিগণিতের হিসাব অনুযায়ী বলি তাহলে প্রতিদিন একজনের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।

তিনি বলেন, এই যে বারবার বলা হচ্ছে এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এগুলোর একটিও কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কারণ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে গত এক যুগে অর্থাৎ ১২ বছরে ৩ হাজারের বেশি মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এই যে টেকনাফে কুখ্যাত ওসি প্রদীপ ২০১৯ পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বিপিএম পাওয়ার ক্ষেত্রে যে ৬ টি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয় তার প্রত্যেকটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের পুরস্কারস্বরূপ কোনো পুলিশ অফিসার যদি সর্বোচ্চ পুলিশ পদক পান, তাহলে সেটি তো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহিত করবে সেটাই স্বাভাবিক। শুধু যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তাই নয়, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে অর্থ লেনদেন বিষয় জড়িত আছে। দেখা যায় সাধারণ পরিবার থেকে মানুষ ধরে নিয়ে যাওয়া হয় অর্থ দাবি করা হয় এবং অর্থ না পেলে ক্রসফায়ারে ভয় দেখানো হয়। অথচ আমরা শুনেছি আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ গুম বলে কোন শব্দ নাই। একই লাইন ধরে পুলিশের আইজি কিছুদিন আগে বলেছেন ক্রসফায়ার নামেও বলে কিছু নাই। এটি এনজিওগুলোর শব্দ।

তিনি বলেন, যে রাষ্ট্রে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা হয়। সেখানে ইঙ্গিত করে যে সেখানে বিচার বিভাগ ধ্বংস হয়েছে। সেখানে আইনের শাসন ধ্বংস হয়েছে। সেখানে মানুষ বিচারের প্রতি আস্থা হারিয়েছে এবং সেই রাষ্ট্র অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে