কয়েক দিন আগে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি আমার বহুদিনের পরিচিত। আমেরিকায় তাঁর কূটনীতিক জীবনের সাফল্যের কথা জানি। সম্ভবত সেই সাফল্যের কথা জেনেই শেখ হাসিনা একধাপে তাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেছেন। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েও অল্প সময়ে তাঁর সাফল্য কম নয়। আমার নিজেরও ধারণা, আবদুস সামাদ আজাদের পর ড. মোমেন আমাদের একজন সফল পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সমমর্যাদা ও সমবন্ধুত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে সম্প্রতি যে টানাপড়েন চলছে এবং কেউ কেউ রটাচ্ছেন এটা সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে নতুন মোড়, এই ক্রান্তিলগ্নে ড. মোমেনের ওপর গুরুদায়িত্ব বর্তেছে ভারত ও চীনের সঙ্গে সমমৈত্রীর ভিত্তিতে সম্পর্ক রক্ষা ও উন্নয়নের।
ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের আসল সম্পর্কের কথাটা বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রীই প্রথম অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছেন। বলেছেন, ‘চীনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক; কিন্তু ভারতের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক।’ এরপর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশেই কোনো মহলের গুজবের ঘুড়ি ওড়ানোর অবকাশ নেই। তবু ঘুড়ি উড়ছে। বিশেষ করে সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনালাপ এবং ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার আকস্মিক ঢাকা সফর এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতের পর দুই দেশেই গুজবের ঘুড়িটা আরো বেশি উড়ছে। এবং তা দুই দেশেই সন্দেহ বাড়ানো ছাড়া সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হচ্ছে না।
একটা জুম (অনলাইন) আলোচনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হতেই আলোচনা শেষে ব্যক্তিগত আলাপের সময় তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে এত হৈচৈ কেন? শ্রিংলার ঢাকা সফর এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার নিয়েও জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। দুই দেশেরই কিছু সাংবাদিক কোমর বেঁধে নেমেছেন পানি ঘোলা করতে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ‘গাফ্ফার ভাই, আমার দুঃখটা কোথায় জানেন? দুই দেশেই কিছু সাংবাদিক আছেন, যাঁদের আমরা বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধু বলে জানি। পানি ঘোলা করছেন তাঁরাই বেশি। বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থীরা যদি এ কাজটি করেন, যা তাঁরা করে আসছেন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই, তাহলে বিস্মিত হতাম না। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ব্যাপারে এমন কিছু সাংবাদিক সন্দেহের বিষ ছড়াচ্ছেন, যা খুবই বেদনাদায়ক। এঁরা যা লেখেন, তা উদ্ধৃত করে ভারতেও কিছু সাংবাদিক আছেন, তাঁরা বাংলাদেশ চীনের কোলে চলে গেল বলে হৈচৈ করেন। যাতে আমাদের এত কষ্টার্জিত বন্ধুত্বের সম্পর্কে আঘাত পড়ে এবং তাতে উৎসাহিত হয় দেশের স্বাধীনতার শত্রুরাই।’
ড. মোমেন বাংলাদেশের একজন সম্পাদক এবং ভারতের দুজন কলামিস্টের নাম করে বললেন, এঁদের মধ্যে কেউ কেউ হচ্ছেন আওয়ামী লীগ সরকারের ‘বন্ধু’। কেউ কেউ হচ্ছেন প্রকাশ্যে ভারত-বন্ধু, আসলে তাঁরা কাদের বন্ধু তা আমি জানি না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে সম্পাদকের নাম বললেন, তাঁর নাম শুনে আমিও বিস্মিত হলাম। তিনি এমন একটি বাংলা দৈনিকের সম্পাদক, যার মালিকপক্ষ আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ। সম্পাদক নিজেও প্রধানমন্ত্রীর খুব ঘনিষ্ঠ বলে জানি। যদিও দৈনিকটির কোনো কাটতি নেই। কিন্তু সরকারের ঘনিষ্ঠজনের কাগজ বলে এই কাগজে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের বিষয়ে কিছু লেখা হলে তা বাংলাদেশে সরকারবিরোধী প্রচারণার কাজে এবং ভারতে বাংলাদেশবিদ্বেষী সাংবাদিকদের লেখায় খোরাক জোগায়।
বঙ্গবন্ধুর আমলেও এই ষড়যন্ত্রটা ছিল। ভারতের বিখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার যেমন কংগ্রেস ও ইন্দিরা গান্ধীকে দেখতে পারতেন না, তেমনি বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব ছিলেন তাঁর চক্ষুশূল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুলদীপ নায়ারই প্রথম ভারতীয় সাংবাদিক ও কলামিস্ট, যিনি নিরপেক্ষতার আবরণে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে কোনো খুঁত না পেলেও খুঁত সৃষ্টি করে লিখতে শুরু করেন। এ ব্যাপারে তাঁর লেখার একমাত্র সোর্স ছিল এনায়েতুল্লাহ খান মিন্টুর সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ পত্রিকা।
পাকিস্তান আমল থেকেই এনায়েতুল্লাহ খানের আওয়ামী লীগবিদ্বেষ সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছুকাল চুপচাপ থেকে নানা কৌশলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করেন। তাঁর প্রতিটি লেখা উদ্ধৃত করে কুলদীপ নায়ার ভারত যাতে মুজিব সরকারকে বিশ্বাস না করে সে জন্য দিল্লি ও মুম্বাইয়ের বড় বড় ইংরেজি দৈনিকে কলাম লিখতেন। পরে আরো কিছু ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে অনুসরণ করা শুরু করেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গে দিল্লির পাকিস্তান দূতাবাসের যোগাযোগ ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। কুলদীপ নায়ারের সঙ্গে এই যোগাযোগ যে ছিল তার প্রমাণ মেলে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের (জিয়াউল হকের) আমন্ত্রণে তিনি যখন ভিআইপি ট্রিটমেন্ট নিয়ে পাকিস্তান সফরে যান। বিজেপির বাজপেয়ি সরকারের আমলে তিনি লন্ডনে ভারতের রাষ্ট্রদূত হন। তাঁর অসাম্প্রদায়িকতার মুখোশ তখন খসে পড়ে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মৈত্রী যদি দৃঢ় হয় তাহলে উপমহাদেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সরকার স্থায়ী হয়—এই সত্যটা জেনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুরা ডে ওয়ান থেকে চক্রান্ত করেছে এই মৈত্রী ভাঙার। এটা করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো দিল্লির মনে এই ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া যে আওয়ামী সরকার চীনের দিকে ঝুঁকছে। চীন-ভারত ভয়ানক শত্রুতা রয়েছে। সুতরাং ঢাকা চীনের দিকে ঝুঁকছে—এই রটনা করা গেলে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে, এটা বিশ্বাস করে ষড়যন্ত্রকারীরা আগে বঙ্গবন্ধুর আমলে যে গুজব ছড়িয়েছে, এখন তা আরো বড় করে ছড়াচ্ছে। এই প্রচারণা ছড়ানোর জন্য যেমন তারা কিছু সুযোগসন্ধানী ভারতীয় সাংবাদিককে ব্যবহার করছে, তেমনি বাংলাদেশের কিছু সাংবাদিককেও ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের এই সাংবাদিকদের কেউ কেউ আবার ‘সরকারের কাছের লোকের’ ছাপ গায়ে লাগিয়েছেন। এঁরা সরকারের কোনো কাজের সম্পর্কে কৌশলে সন্দেহ সৃষ্টি করলে সেটা সাধারণ মানুষের কাছে বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে—এই আশায় তাঁদের কাগজের বাজারে কাটতি না থাকলেও তাঁদের লেখা ভারতের এক শ্রেণির কাগজে বড় করে উদ্ধৃতি পায়। সেই উদ্ধৃতিযুক্ত লেখা আবার বাংলাদেশের একটি নিরপেক্ষ দৈনিক ফলাও করে প্রকাশ করে।
বঙ্গবন্ধুর আমলে এই খেলা সম্পর্কে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা জন্মে। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসের কথা। পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও লাহোরে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যাচ্ছেন। আমি তখন স্ত্রীর চিকিৎসা উপলক্ষে কলকাতায়। সারা দিন হাসপাতালে থাকি। বিকেলে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে গিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষ ঘোষ প্রমুখের সঙ্গে আড্ডা দিই। তখন আনন্দবাজারে সপ্তাহে একটি কলামও লিখি।
লক্ষ করলাম, বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান গমনে ভারতের কয়েকটি বিগ মিডিয়া খুশি নয়। একটি কাগজ তো লিখেই ফেলল, ‘ঢাকার শেখ কাশ্মীরের শেখের মতো আচরণ করছেন।’ এর কিছুদিনের মধ্যে ভারতের এক মন্ত্রী মোহাম্মদ আলী চাগলা লাহোরে ইসলামী সম্মেলনে ভারতের পর্যবেক্ষক হয়ে যান। সুতরাং বিতর্কটি চাপা পড়ে। কিন্তু মুজিব সরকার বিরোধী প্রচারণাটি ভারতে অন্য খাতে প্রবাহিত হয়। বলা হয়, শেখ মুজিব চীনের সঙ্গে তলে তলে মিতালি করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু প্রমাণ কোথায়?
একদিন কী কাজে আনন্দবাজার অফিসে গেছি। দেখি নিউজ ডিপার্টমেন্টে দারুণ হৈচৈ। বার্তা সম্পাদক অমিতাভ চৌধুরীকে (তৎকালীন) জিজ্ঞাসা করলাম, ‘অমিতাভদা, ব্যাপার কী?’ অমিতাভ চৌধুরী বললেন, ‘তোমাদের শেখ তো কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছেন। তিনি তলে তলে চীনের সঙ্গে হাত মেলাবার চেষ্টা করছেন। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের কাছে গোপনে চিঠি পাঠিয়েছেন। পত্রবাহক চীনপন্থী সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ দুই দিন আগে বেইজিং চলে গেলেন।’
আমি একটু বিস্মিত হলাম, বললাম, ‘খবরটি কোথায় পেলেন?’ অমিতাভদা বললেন, ‘কেন, ঢাকায় আনন্দবাজার ব্যুরোর (ঢাকায় তখন আনন্দবাজারের একটি অফিস ছিল) হেড তুষার গতকাল ঢাকা থেকে এসেছে। সব খবর জেনে নিশ্চিত হয়ে কলকাতায় এসেছে। আগামীকাল আমরা আনন্দবাজারে এবং হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডে (আনন্দবাজার গ্রুপের তখনকার ইংরেজি দৈনিক) বড় করে ছাপব এ খবর।’
দেখি তাঁর টেবিলে বড় বড় হরফে পরের দিনের কাগজের খবরের হেডিংয়ের প্রুফ কপি বিছানো। তাতে লেখা, ‘মুজিব, ভারতের কাছ থেকে মুখ ফেরালেন : চীনের দিকে হাত বাড়ালেন’। আমি শঙ্কিত হলাম। খবরটা যদি সত্য না হয় এবং পরের দিন ভারতের কাগজে বেরোয়, তাহলে তার পরিণতি কী? বাংলাদেশ-ভারতের মৈত্রী সম্পর্কের অবসান! আমি অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবেই অমিতাভ চৌধুরীকে বললাম, ‘এ খবর সত্য নয়। তুষার পণ্ডিত ভুল খবর জেনে এসেছেন। আপনি প্রমাণ চান? বলেই আমি গণভবনে টেলিফোন করলাম। সৌভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধুকে পেলাম। তাঁকে সংক্ষেপে ঘটনাটা বলতেই তিনি গর্জে উঠলেন, এত বড় মিথ্যা খবর আনন্দবাজার ছাপবে? দাও, সম্পাদককে ফোনটা দাও, আমি কথা বলব।’ সম্পাদক সন্তোষ ঘোষ টেলিফোন ধরলেন। বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে বললেন, ‘চৌ এন লাই আমার ব্যক্তিগত বন্ধু। তাঁকে আমি ইচ্ছা হলে এক শটা চিঠি লিখতে পারি। তাই বলে এক চীনপন্থী সাংবাদিকের মারফত গোপন চিঠি লিখতে যাব কেন? ভারতের মতো বন্ধুত্ব চাইতে যাব কেন?’
বঙ্গবন্ধু রিসিভার রাখার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঢাকায় ফয়েজ আহমদের বাসায় টেলিফোন করি। সৌভাগ্যবশত তাঁকেও বাসায় পাই। ফয়েজ আহমদ খবর শুনে হতবাক। বললেন, ‘আমি তো বেইজিংয়ে নই, ঢাকায় আছি। বঙ্গবন্ধু আমাকে কোনো চিঠি দেননি।’ সব শুনে তুষার পণ্ডিতের মুখ শুকনো। পরদিন আনন্দবাজার আর খবরটা ছাপেনি। অতীতে এ রকম চক্রান্তের আরো অনেক তথ্য দিতে পারি। যা আমার জানা। কিন্তু লেখাটি লম্বা করতে চাই না।
যাঁরা আশা করেছিলেন, বিজেপির নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এলেই অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগবেন, তাঁদের আশা পূর্ণ হয়নি। বরং হাসিনা-মোদি মৈত্রী আরো দৃঢ় হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতে যে চক্রান্তকারীদের এটা সহ্য হয়নি, তাঁরা নতুন করে বৃহত্তর পরিসরে এ চক্রান্ত শুরু করেছেন। এটা তো এখন গোপন নেই, এই চক্রান্তে বিপুলভাবে অর্থায়নে নেমেছে পাকিস্তানের ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় তারেক রহমানের মাধ্যমে বিপুল অর্থ ছড়িয়ে তারা এক শ্রেণির ব্রিটিশ সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও আইনজীবীকে কিনে ফেলে যুদ্ধাপরাধীদের নিরপরাধ প্রমাণের চেষ্টা করেছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশে গণহত্যা চালায়নি—এত বড় মিথ্যাটাকে সত্যে পরিণত করার জন্য সুভাষচন্দ্র বসুর মতো সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতার ভাইঝিকে দিয়ে বই লেখাতে সক্ষম হয়েছিল। এখন বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বে ফাটল ধরানোর জন্য বাংলাদেশের মতো ভারতেও তারা কিছু সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী কিনে ফেলবেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?
এবারের গুজব ছড়ানো শুরু হয়েছে দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। একটি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সম্প্রতি টেলিফোনে কথা বলেছেন। আরেকটি ঘটনা, ভারতের পররাষ্ট্রসচিব অকস্মাৎ ঢাকা সফর করে শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্তে কথা বলে গেছেন। কী বলেছেন, তা জানা যায়নি। আর যায় কোথা? এসব আলাপে স্বচ্ছতা নেই, ভারত বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য দিচ্ছে না, ইমরান কাশ্মীর প্রশ্নে বাংলাদেশকে দলে টানতে চান ইত্যাদি গুজবে বাজার ভরিয়ে তোলা হয়েছে। আর এই গুজব নিয়ে সিরিয়াস প্রবন্ধ লিখে চলেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু দায়িত্বশীল সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী; যাঁদের কুলদীপ নায়ারের উত্তরসূরি বলা যেতে পারে। এই গুজবগুলো নিয়ে আলোচনা করে এগুলো যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার তা প্রমাণ করা যেতে পারে। আর একটি নিবন্ধে তা আলোচনার আশা করি।
কলকাতার একটি কাগজে দেখলাম মজার একটি প্রতিবেদন। তারা লিখেছে, ‘বাংলাদেশ তার দুমুখো পররাষ্ট্রনীতির জন্য ভারতের মতো চীনেরও আস্থা ও মৈত্রী হারাতে বসেছে।’ বাংলাদেশে এটা বিএনপির প্রচারণা। গত ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে ঢাকার চীনা দূতাবাস খালেদা জিয়াকে তাঁর বিতর্কিত জন্মদিবসে উপহার পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। তাতে বিএনপির মরা গাঙে বান ডেকেছিল। তারা আনন্দে গদগদ হয়ে প্রচার করতে শুরু করেছিল, চীন এখন আওয়ামী লীগ সরকারকে ত্যাগ করে তাদের দিকে।
বিএনপির এই রঙিন বেলুন ফাটতেও দেরি হয়নি। ঢাকার চীনা দূতাবাস থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আন্তরিক ক্ষমা প্রার্থনা করে জানানো হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন করা এবং এর রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার বিষয় জানতেন না। তাই ভুলক্রমে খালেদা জিয়াকে জন্মদিনের উপহার পাঠানো হয়েছে। ভবিষ্যতে এমন ভুল আর হবে না। সহৃদয় পাঠক, ঘটনা এখন কোন দিকে গড়াচ্ছে তা কি বুঝতে পাচ্ছেন? শেখ হাসিনাকে ইমরান খানের টেলিফোন কল এবং ভারতের পররাষ্ট্রসচিব শ্রিংলার হাসিনার সঙ্গে একান্ত বৈঠক সম্পর্কে যে সন্দেহ ও অস্বচ্ছতা ঢাকা ও কলকাতার এক শ্রেণির সাংবাদিক বন্ধু তৈরি করেছেন, সেই অস্বচ্ছতা শিগগিরই কেটে যাবে এবং দেখা যাবে শেখ হাসিনার সমদর্শী রাজনীতির জয় হয়েছে। ভারত ও চীন দুটি বড় প্রতিবেশীরই মৈত্রী ও সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ একটি নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
লন্ডন, সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০