প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আবারও নিজের বয়সের কথা উল্লেখ করে অবসরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে কবে কখন অবসরে যাবেন সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু বলেননি তিনি। আজ বুধবার আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের সুদূরপ্রসারী বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে জানান, আগামীতে যারাই নেতৃত্বে আসুক তারা যেন এর ওপর ভিত্তি করে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সে চেষ্টা তিনি করছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কারণ আমাদের তো বয়স হয়ে গেছে। আমি তো ৭৪ বছর বয়সের। কাজেই সেটাও মাথায় রাখতে হবে। আর কতদিন!’
সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘদিন নির্বাসনে থেকে ১৯৮১ সাল থেকে দলীয়প্রধানের পদে আছেন শেখ হাসিনা। বিভিন্ন সময় অবসরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিলেও দলীয় নেতাকর্মীরা তাকে কোনোক্রমেই ছাড়তে নারাজ। ইতিমধ্যে চার মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। অবসর গ্রহণের পর গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় চলে যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন তিনি।
বুধবার সকাল দশটার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সভা অনুষ্ঠিত হয়। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যে দলের সংসদীয় বোর্ডের সভার পর এই প্রথম দলের নীতিনির্ধারণী সর্বোচ্চ ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সভা অনুষ্ঠিত হলো। সভায় সভাপতিমণ্ডলীর অন্যান্য সদস্য উপস্থিত ছিলেন। প্রয়াত দুই প্রেসিডিয়াম সদস্যদের মৃত্যুতে সভার শুরুতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, দীর্ঘদিন পরে আমাদের এই সভা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই বিশ্বব্যাপী একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এবং শুধু আমাদের দেশ বলে না সারা বিশ্বব্যাপী যেহেতু এই অবস্থার সৃষ্টি, তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, এই করোনাকে মোকাবেলা করে আমরা কীভাবে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক গতিটা অব্যাহত রাখতে পারি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, যারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তাদের পাশে দাঁড়ানো। আর আমাদের বাংলাদেশের এমনি একটা অবস্থা, আমাদের তো শুধু করোনার জন্য সর্বনাশ হচ্ছে সেটা তো না, সাথে সাথে প্রাকৃতিক দুর্যোগকেও আমাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এবং সেটাও আমরা বলবো যে, অত্যন্ত সমযোপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে আমরা সেগুলো মোকাবেলা করতে পেরেছি। আশঙ্কা ছিল যে, বিশাল একটা বন্যা বা দীর্ঘস্থায়ী একটা বন্যা দেখা দিতে পারে। এখনো পানি আছে কিছু কিছু নদীতে। কিছু ভাঙনও হচ্ছে। এবার নদী ভাঙনটা ব্যাপক হয়েছে। নদী ভাঙনে কিছু কিছু এলাকা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক মানুষ একেবারে ঘরবাড়ি হারা হয়েছে। তারপরও এই অবস্থা মোকাবেলায় আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছি। কারণ আমাদের প্রচেষ্টা হচ্ছে যে, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষকে সেবা করা। এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা যদি অন্য দলগুলো দেখি যারা হয়ত শুধু লিপ সার্ভিস অর্থ্যাৎ ওই মুখে মুখে কথা বলেছে, কিন্তু প্রকৃত মানুষের কাছে গিয়ে মানুষকে সাহায্য করা, সেটা কিন্তু আমরা অন্য দল বা অন্য সংস্থা; তাদের উপস্থিতিটা ওভাবে দেখিনি, এনজিও-টেনজিও অনেকেই আছে। কিন্তু তাদেরকে আমরা ওভাবে দেখিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, কিন্তু আমাদের আওয়ামী লীগ এবং আমাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে। সেই সাথে আমি প্রশংসা করি, আমাদের প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তারা সবাই আন্তরিকতার সাথে কাজ করেছে। অর্থনৈতিকভাবে আমরা একটা মোটামুটি ভালো অবস্থানে আছি। বাজেটের ডেফিসিটি এবার আমরা ৬শতাংশ ধরেছিলাম। এখানে আমার সিদ্ধান্ত ছিল দরকার হলে ১০ শতাংশ ধরবো। কিন্তু সেটা আমাদের লাগেনি। কাজেই তার মধ্যে রেখেই আমরা আমাদের অর্থনীতির চাকাটাকে সচল রাখতে পেরেছি। কারণ রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ একমাত্র রাজনৈতিক দল যার একটা ইকোনমিক পলিসি আছে, সেটাকে মাথায় রেখেই আমরা কিন্তু কাজ করে যাই। এর ফলে আমরা যেকোনো পদক্ষেপ নিচ্ছি খুব হিসাব করে। সেটা আমরা পার্টির যে পলিসি সেটাকে মেনেই কিন্তু আমাদের সব পদক্ষেপ নিচ্ছি।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ২০০৮ সালে সরকার গঠন করে ২০১০ সালে আমরা প্রেক্ষিত পরিকল্পনা নিয়েছিলাম ২০১০ থেকে ২০২০। সেখানে এখন আমরা ২০২১ থেকে ২০৪১ সেই প্রেক্ষিত পরিকল্পনাও প্রণয়ন করে সেটাও আমরা গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশ হচ্ছে একটা ডেল্টা। আমাদের বদ্বীপ; এই বদ্বীপের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। কারণ আপনারা জানেন যে, এই নদী ড্রেজিংয়ের কথা সব সময় বলে আসছি। একটা সময় ছিল, আমি আর বোধহয় মতিয়া আপা ছাড়া আর কেউ ড্রেজিংয়ের কথা বলতই না। অনেক বিশেষজ্ঞরাও এটা নিয়ে তখন প্রশ্ন তুলত। আমরা কিন্তু সেই আগের দিনে যেটা বলে ভাঙা রেকর্ডের মতো এই ড্রেজিং ড্রেজিং বলেই যেতাম। তো এখন আবার প্রত্যেকে আমাদের পথে আসছে। এখন সেই বিশেষজ্ঞরাও এখন বলে যে ড্রেজিংটা একমাত্র উপায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের নদীগুলোর ভাঙন হচ্ছে, নদীগুলোর ক্ষতি হচ্ছে। নদীগুলোকে বাঁচানোর জন্য এটা দরকার। আমরা ডেল্টা প্ল্যান যেটা করেছি। ডেল্টা প্ল্যানের এইটাই লক্ষ্য, আমাদের যতগুলো বড় নদী এবং যা আছে, আমরা নদী ড্রেজিং করে নদীর নাব্য বজায় রেখে এই বদ্বীপটা রক্ষা করা, সুরক্ষিত করা এবং আমাদের দেশের মানুষকে কীভাবে সুন্দরভাবে একটা জীবন দেয়া, অর্থনৈতিক উন্নয়নটা ত্বরান্বিত করা সেটাই আমাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য নিয়ে আমরা ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ প্রণয়ন করেছি, বাস্তবায়ন করছি। অর্থ্যাৎ আওয়ামী লীগ যেহেতু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই সংগঠনই এদেশের স্বাধীনতা এনেছে কাজেই আমরা যখন সরকারে আছি, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে যে দেশটা শুধু বর্তমানেই না, আগামী দিনের নতুন প্রজন্মের জন্য কীভাবে এই দেশটা এগিয়ে যাবে, কীভাবে চলবে, সেটাই এখন থেকে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখবো বা আমরা নির্দেশনা দিয়ে রাখবো।
শেখ হাসিনা বলেন, হ্যাঁ, এটা ঠিক আমরা যা করছি, সময়ের বিবর্তনে সেটা কিন্তু সংশোধন করতে হবে। পরিবর্তন করতে হবে, পরিশোধন করতে হবে। এটা করতে হবে, এটা নিয়ম। সেটাও আমরা জানি কিন্তু তারপরও একটা ফ্রেমওয়ার্ক একটা ধারণাপত্র অথবা একটা দিকনির্দেশনা; সেটা যদি সামনে থাকে তাহলে যেকোনো কাজ খুব সহজে যারাই আসুক ভবিষ্যতে তারাই করতে পারবে। কারণ আমাদের তো বয়স হয়ে গেছে। আমি তো ৭৪ বছর বয়সের। কাজেই সেটাও মাথায় রাখতে হবে। আর কতদিন!
তিনি বলেন, কাজেই তারপরে যারা আসবে তারা যেন দিকহারা না হয়ে যায়, তারা যেন একটা দিকনির্দেশনা থাকে, একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে, না আমাদের এখানে যেতে হবে। সেজন্য আমরা প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা করলাম। এরপর দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা করে দিলাম। ২০৪১ সাল পর্যন্ত কী হবে। আবার জাতিসংঘ ঘোষণা দিয়েছে-এসডিজি-২০৩০। সাসটেইনবেল ডেভলপমেন্ট গোল অর্থ্যাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নটা একটা স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। সেখানে যে ধারাগুলো আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য সেগুলো আমরা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। আমরা এমডিজি বাস্তবায়নে সাফল্য অর্জন করেছিলাম। এসডিজি বাস্তবায়নেও আমাদের সাফল্য আসবে, এইজন্য আমরা ঠিক আমাদের দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ধারাগুলো সেগুলো নিয়ে আমরা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি।
সরকারপ্রধান বলেন, ২০২০ সাল জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি। ২০২১ সাল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবো। ২০২০ থেকে ২০২১ এটাই আমরা মুজিববর্ষ ঘোষণা দিয়েছি। কাজেই ২০২১ সালের মধ্যে আমাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার আমরা কমিয়ে ১৬-১৭’র মধ্যে নামিয়ে নিয়ে আসবো। ইতিমধ্যে ২০ ভাগ নামিয়ে এনেছি, যেখানে ৪০ ভাগ ছিল। সেটা আমরা ২০ দশমিক ৫ ভাগে নামিয়ে এনেছিলাম।
তিনি বলেন, করোনার কারণে আমাদের এসব কাজ একটু শ্লথ হয়ে গেছে এটা ঠিক, কিন্তু আমরা মনে করি যে, এই দারিদ্র্য যেন আবার মানুষকে গ্রাস করতে না পারে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা প্রণোদনা প্যাকেজ দিচ্ছি। পাশাপাশি একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত আর্থিকভাবে মানুষ চলতে পারে তার ব্যবস্থাও আমরা করে দিচ্ছি। এই কারণে কোনোভাবে সাধারণ মানুষের যেন কষ্টটা না হয়।