জাতিসংঘে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

“জনাব সভাপতি,
মানুষের অজয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতা এবং অজয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রেখে আমি আমার বক্তৃতা শেষ করতে চাই। আমাদের মত যেসব দেশ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে; এ বিশ্বাস তাদের দৃঢ়। আমরা দুঃখ ভাগ করতে পারি কিন্তু মরব না। টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি। আমাদের লক্ষ্য স্বনির্ভরতা, আমাদের পথ হচ্ছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যথ প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সম্পদ ও প্রযুক্তিবিদ্যার শরিকানা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা হ্রাস করব এবং আমাদের কর্মকাণ্ডকেও সহজতর করব এতে কোন সন্দেহ নেই। নতুন বিশ্বের অভ্যুদয় ঘটছে, আমাদর নিজেদের শক্তির ওপর আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে। আর লক্ষ্যপূরণ ও সুদূর ভাবীকালের জন্য আমাদর নিজেদের গড়ে তুলতে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে আমরা এগিয়ে যাবো।”

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যে অভিভাষণ প্রদান করেছিলেন তার শেষ প্যারার উদ্ধতি এখানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এ শেষ প্যারাটি পুরো বক্তৃতাটির সারাংশও বটে।

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর এ অভিভাষণটি অনেকগুলো কারণেই বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের দাবিদার। কারণগুলো সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করতে আমরা নিম্নরুপভাবে বিবৃত করছি :
১. স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রনায়ক যিনি জাতিসংঘে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে সাধারণ পরিষদে বক্তৃতা করার দুর্লভ সম্মান লাভ করেছেন;
২. তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বক্তৃতা করার সুযাগ নিয়ে বাংলা ভাষাকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে স্থাপন করেছেন তাঁর অভিভাষণের মাধ্যম হিসেবে বাংলা ব্যবহার করে;
৩. এ অভিভাষণে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার বহুমাত্রিকতাকে সুস্পষ্ট করে তুলেছে। জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ও মানুষের অজয় শক্তির প্রতি গভীর বিশ্বাসই ছিল তাঁর রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তার আধার( তা এ অভিভাষণের মাধ্যমে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে;
৪. একজন দেশপ্রেমিক, স্বাজাত্যবোধ গর্বিত অথচ আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাসী রাষ্ট্রনায়কের পরিচয় পাওয়া যায় তার এ আভিভাষণে। বাংলায় বক্তৃতা, জনগণের সংগ্রাম ও আত্মদানের কথা গর্বভরে উল্লেখ করেন যে দেশপ্রেমিক মুজিব, তিনিই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, মানুষের অজয় শক্তির কথা, প্রযুক্তি ও সম্পদের শরিকানার কথা দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করে অমর মানবতাবাদী। আর এখানেই আমরা খুঁজে পাই তাঁর মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা, মমত্ববোধ ও বিশ্বাসের কথা। বঙ্গবন্ধু কখনো মানুষের ওপর আস্থা হারাননি;
৫. বঙ্গবন্ধুর এ অভিভাষণ আমাদেরকে একজন বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক নেতার সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেয়। তিনি যখন বলেন মানুষের অসম্ভবকে জয় করার কথা, যখন তিনি বলেন প্রযুক্তির ব্যবহার ও শরিকানার কথা, তখন তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা ও আধুনিকতার প্রতি কারো দৃষ্টি নিবদ্ধ না হয়ে পারে না; এবং
৬. তাঁর এ অভিভাষণে তিনি লক্ষ্যপূরণ ও ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সম্মিলিত প্রয়াসের ওপর গুরুত্বারোপ করে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার গণতান্ত্রিকতা ও বিশ্বজনীনতার প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গেছেন।

বাংলাভাষার বিকাশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর এ অভিভাষণটি নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। বিশ্বের সাহিত্যের ইতিহাসে বাঙালির কবি সাহিত্যিকগণ, বিশষত কবিগুরু রবীদ্রনাথ ঠাকুর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন (এবং থাকবেনও), এবং তাঁর লেখনীর মাধ্যমেই বাংলা ভাষা বিশ্বদরবারে স্থান পেয়েছে এ কথা সত্য। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, বাংলাভাষা আপন রূপ নয়, ভাষারিত হয়েই বিশ্বসাহিত্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ বিচারকে সামনে রেখেই বলা প্রয়াজন যে, বাংলা ভাষা তার নিজস্ব রীপ প্রথম বিশ্ব ভাষাসমূহের কাতারে স্থান পেয়েছে বাঙালির রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের অভিভাষণের মধ্য দিয়ে। বাংলাভাষার আন্তর্জাতিকীকরণের ইতিহাসে, বিকাশের ইতিহাসে তাই এই অভিভাষণ এক অনন্যসাধারণ স্থান নিয়ে থাকবে।

জাতির জনকের এই অভিভাষণটি রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর ভাবনা, তাঁর দর্শন সম্পর্কেও একটি ঐতিহাসিক দলিল হয়ে আছে। মানুষের অজয় শক্তিতে বিশ্বাসী, মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে আস্থাশীল, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, সম্পদ ও প্রযুক্তিবিদ্যার শরিকানা, মানুষের সংগ্রাম ও আত্মদানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, স্বনির্ভরতার লক্ষ্যদর্শী টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনগণর দৃঢ়তার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে যে মুজিব বেরিয়ে এসেছেন, জাতিসংঘে প্রদত্ত তাঁর এ অভিভাষণে তিনি এক অনন্য মুজিব, অসাধারণ রাষ্ট্রনায়ক।

তাঁর দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, আধুনিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, আন্তর্জাতিকতা আজকের বাংলাদেশের জন্য পথ প্রদর্শন করবে, এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করা বিদ্যমান বাস্তবতার নিরিখে সঠিক পথানুসন্ধান বলেই আমরা মনে করি। তাঁর সমগ্র ভাষণে তিনি শান্তির প্রতি তাঁর দৃঢ় সমর্থনের কথা সুউচ্চ কণ্ঠেই উচ্চারণ করেছেন। সংঘাত নয়, বিরোধ মীমাংসায় আপোস ও আলোচনার প্রতি তাঁর সমর্থন এ অভিভাষণে পাওয়া যায়, তারই পথ ধরে উপমহাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা শান্তির অন্বেষণে ছুটে চলেন অবিরাম।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভবিষ্যত ছাত্ররা যখন রাষ্ট্রচিন্তায় বাঙালির অবদান নিয়ে গবেষণা করবেন, তখন তাদের গবেষণার অন্যতম উপাদান হিসেবে তারা বঙ্গবন্ধুর এ বক্তৃতাটিকে বেছে নিবেন(এ কথা নিঃসন্দেহ বলা চলে। বঙ্গবন্ধুর এ বক্তৃতাটি ভাষা-সকর্য, চিন্তার গভীরতা, একজন রাষ্ট্রনায়কের সংগ্রামশীল জীবনের নির্যাস হিসেবে আগামী দিনগুলাতে মননশীল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তাঁর এ অভিভাষণ যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করা হোক না কেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণের পরই এটি তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। বাংলাভাষা ও বাঙালির ইতিহাসে এ অভিভাষণ চিরদিন পথচলার দিকদর্শন হিসেবে কাজ করবে। সুদূর ভাবীকাল গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধু জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সম্মিলিত প্রয়াসের যে পথের প্রতি তাঁর দৃঢ় আস্থা ব্যক্ত করে গেছেন, সেই পথের কেনো বিকল্প নেই, জনগণের ঐক্যবদ্ধ অপরাজেয় শক্তি চিরজীবী হোক। জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখকঃ রাজনৈতিক কর্মী;
সম্পাদক, মত ও পথ।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে