বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে আওয়ামী লীগের অর্জন মানেই বাংলাদেশের অর্জন। মোটকথা বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে অদ্যাবধি বাঙালির প্রায় সব মহৎ অর্জনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী-শেখ মুজিবদের হাতে ধরে এ দলের যাত্রা শুরু। চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে দলের হাল এখন মুজিব তনয়া শেখ হাসিনার হাতে। গণতন্ত্রের পাশাপাশি বাঙালির স্বার্থের পক্ষে আওয়ামী লীগ যে দুর্বার লড়াই গড়ে তুলেছিল অবিভক্ত পাকিস্তানের পটভূমিতে সে লড়াই পরিণতি লাভ করে বাঙালির স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার পথ ধরে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এবং এরই পাশাপাশি বাঙালির ভাষা বাঙলা লাভ করে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা, যা এখন বিশ্ব পরিসরেও একটি পরিশীলিত ভাষা রূপে বিবেচিত। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এবং ভাষা হিসেবে বাঙলা আজ বিশ্ব পরিসরে উল্লেখযোগ্য অবস্থান নিয়ে বিরাজ করছে। বাংলাদেশ ও বাঙলা ভাষার এই অর্জনে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের অবদান সর্ব প্রধান এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আওয়ামী লীগের এই বিশাল অর্জনগুলির স্তরে স্তরে সংগ্রাম করে নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায়ে উঠে এসেছেন প্রতিষ্ঠার লগ্নের তরুণ যুব নেতা শেখ মুজিব। মুজিব ভাই, শেখ সাহেব এবং একদিন বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন তিনি। তিনি আওয়ামী লীগকে লড়াইয়ের উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছেন এবং আওয়ামী লীগ তাঁকে একক নেতৃপদে তুলে এনেছে ১৯৪৯-১৯৫২-১৯৫৪-১৯৫৫-১৯৫৮-১৯৬২-১৯৬৫-১৯৬৬-১৯৬৯-১৯৭০ আওয়ামী লীগের ইতিহাসে এক একটি মাইল ফলক। অবশেষে ১৯৭১। আওয়ামী লীগ ও এর নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শ্রেষ্ঠ অর্জনের বছর। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। লড়াই সংগ্রামের বন্ধুর পথে পথে মুজিব এগিয়েছেন দৃঢ় পদক্ষেপে। সাথে নিয়েছেন তাজউদ্দিন, নজরুল, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান হেনা, এমএআজিজ, শেখ আজিজ, জহুর আহমেদ চৌধুরী, মোল্লা জালাল, সামসুদ্দিন মোল্লা, শেখ মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক আর তোফায়েল আহমেদ প্রমুখকে।
তারপর এক সময় ইতিহাসের দুঃস্বপ্ন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট। আওয়ামী লীগ এবং বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ইতিহাসের পাতা থেকে চির নির্বাসন দেওয়ার মানসে চরমতম ষড়যন্ত্রের এক ঘৃণ্য ইতিহাস রচনা। এই অন্ধকার থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মন্ত্রে দীক্ষিত ছাত্র-তরুণ-যুবাদের বিদ্রোহের পতাকা উড্ডীন। আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদের দুদোল্যমানতা আর ষড়যন্ত্রের পথ চলা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় তরুণ যুব ছাত্রদের দৃঢ় ভূমিকার কারণে।
১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত নানা ষড়যন্ত্রে ক্ষত-বিক্ষত আওয়ামী লীগ। কিন্তু দেশব্যাপী নেতা-কর্মীদের সুদৃঢ় মনোভাবের কারণে ১৯৮১ এর ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে জাতির জনকের জ্যেষ্ঠা কন্যা শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচন করা হয় এবং সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন জনাব আব্দুর রাজ্জাক। শেখ হাসিনা তখন নির্বাসনে এবং এক সময় ছাত্র রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত থাকলেও সুদীর্ঘ সময় রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছেন। কিন্তু জাতির জনকের নেতৃত্বে বাঙালির আন্দোলন সংগ্রাম আর রাষ্ট্র পরিচালনা দেখেছেন তিনি কাছে থেকে। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ের নির্বাসিত জীবনও তাঁকে রাজনীতির গভীর পর্যবেক্ষণের সুযোগ করে দেয়। তিনি, অতএব, রাজনীতিতে একেবারেই আনকোড়া ছিলেন না। তাই সভাপতি পদে বৃত হওয়ার পর পরই তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৮১ সনের ১৭ মে এক বর্ষণমুখর দিনে তিনি স্বদেশের মাটিতে পা রাখেন। যেন দেশমাতৃকা তাঁর প্রিয় সন্তানকে কোলে ফিরে পেয়ে আনন্দাশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন এবং একই সাথে প্রকৃতি যেন এই দুঃখী পিতৃমাতৃহীন কন্যার সমব্যাথী হয়ে কান্নার জলে তাঁকে বরণ করে নিচ্ছে।
স্বদেশে ফিরে আসার পর শুরু হয় আওয়ামী লীগের এই নতুন নেতার সংগ্রামের নতুন বন্ধুর পথের অভিযাত্রা। একদিকে পিতার হন্থারক সামরিক স্বৈরতন্ত্রের দোসরদের পদচারণা অন্যদিকে দলের অভ্যন্তরের নেতৃত্বাভিলাষী নানা নেতা ও গোষ্ঠির ষড়যন্ত্র চক্রান্ত। পিতৃমাতৃ স্বজনহারা হাসিনা পাড়ি দিচ্ছেন এক অজানার উদ্দেশ্যে যাঁর সঙ্গী সাথীদের অনেকেই বিশ্বস্ত নন। কঠিন কঠোর বন্ধুর এ পথ যাত্রা। কিন্তু অবিচল দৃঢ় প্রত্যয়ী হাসিনা বিভ্রান্তির বেড়াজালে পা দেন নি।
দেশে ফিরেই এক অভিনব পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হল তাঁকে। ৩০ মে ৮১ তে স্বৈরশাসক জিয়া নিহত হলেন সেনা বিদ্রোহীদের হাতে। দেশের মাটিতে ফিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ পাওয়ার পূর্বেই এই অভিনব ঘটনা , যা তাঁর নেতৃত্বকে শুরুতেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করায়। এ সময়টা আমি তাঁকে খুবই কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই। দৃঢ়চেতা, নির্ভীক চিত্ত তাঁকে পিতার মতোই সাহসী পায়ে দাঁড়াতে দেখতে পাই। পরিস্থিতি মোকাবেলা করলেন অবিচলিত থেকে। এ সময়টাই আমি তাঁর নেতৃত্বের সূচনাটা দেখলাম গভীর উৎকন্ঠায়। সকল দুঃচিন্তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে তিনি উৎড়ে গেলেন এই কঠিন পরিস্থিতি।
১৯৮১, ১৯৮২ প্রথমে গণতান্ত্রিক শাসনের ছদ্মাবরণে বিচারপতি সাত্তারের নৈরাজ্যের শাসন এবং পরে নেপথ্যের কুশিলব জেনারেল এরশাদের স্বমূর্তিতে আবির্ভাব। পরিপূর্ণ স্বৈরতান্ত্রিক সামরিক শাসন। পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরে নানা মত ও পথের উপদলীয় কোন্দল। ক্ষত বিক্ষত দল। ১৯৮৩ তে এসে শেখ হাসিনা দলের অভ্যন্তরের চক্রান্তে একটি বড় ধরনের সাংগঠনিক ধাক্কা খেলেন। জনাব আব্দুর রাজ্জাক ও জনাব মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে দলের অভ্যন্তরের একটি বড় অংশ দল ছেড়ে চলে যান এবং বাকশাল নাম দিয়ে নতুন একটি দল গঠন করেন। তাঁরও আগে এই উপদলের নেতৃবৃন্দ ছাত্রলীগকে দ্বিধাবিভক্ত করেন এবং জাতীয় ছাত্রলীগ নাম দিয়ে একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলেন। রাজ্জাক মহিউদ্দিনের এই ভাঙ্গন দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বেশ দুর্বল করে দেয়। এ সময়টাতে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। শেখ হাসিনা অত্যন্ত ধৈর্য্য ধরে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেন। বলতে দ্বিধা নেই যে দলের ভাঙ্গন রোধে শেখ হাসিনা সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। এর স্বাক্ষী জনাব ওবায়দুল কাদের আর আমি। কিন্তু দলের অভ্যন্তরস্থ কট্টর ডানপন্থীদের কূটকৌশল এবং রাজ্জাকপন্থীদের অনমনীয় অবস্থান তাঁর সকল প্রকার প্রয়াসকে ভেস্তে দেয়। দল ভেঙ্গে যায়। তিনি এ সময়ে খুবই ধৈর্য্য, সহনশীলতা ও দৃঢ়তার সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেন। সারা দেশে বাকশালপন্থীরা তাঁকে আদর্শিক দিক থেকে এবং ব্যক্তিগতভাবে আক্রমন করলেও তিনি ধৈর্যহারা হন নি। সারা দেশের নেতা-কর্মীদের সাথে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দলকে আঘাতের ঘা থেকে সারিয়ে তুলতে বিরামহীন পরিশ্রম করতে থাকেন। স্বজনদের ভালমন্দের খোঁজ খবর বা নিজের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা না করে উদয়াস্ত পরিশ্রমের এক কঠিন সংগ্রামের পথ বেছে নেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বৈরতান্ত্রিক দুঃশাসন আর সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতা তাঁকে ব্যাতিব্যস্ত করে তুললেও বিচলিত ও বিভ্রান্ত করতে পারে নি। অবিচল ও অভ্রান্ত পথের দিশা ধরে তিনি পিতার আদর্শকে বুকে ধারণ করে এগুতে থাকেন দৃঢ় পদ চারণায়।
আমরা যারা তরুণ যুবা তাঁরা তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলাম তাঁকে নেতৃপদে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে। যদিও এ সময়টা আমি রাজনীতির বাইরে ছিলাম, তথাপি তাঁর পাশে থেকে তাঁকে সহায়তা করার দায়িত্বকে কর্তব্য জ্ঞান করেছি। ওবায়দুল কাদের, মমতাজ হোসেন, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসেন, আব্দুল মান্নান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, শাহে আলম, অসীম কুমার উকিল, সুলতান মনসুর আহমেদ, আব্দুর রহমান প্রমুখ এ সময়টাতে ছায়ার মতো তাঁর সাথে থেকে সহায়তা করেছেন সাংগঠানিক কাজে। জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে সর্বজনাব আব্দুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোস্তফা মহসিন মন্টু, ড. কামাল হোসেন, আব্দুল জলিল, মোঃ নাসিম, আইভী রহমান, মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ নেত্রীকে শক্তি সাহস যুগিয়েছেন নিরন্তর। অন্যদের মাঝে টাঙ্গাইলের মান্নান সাহেব, নেত্রকোনার মমিন সাহেবের নামও উল্লেখ করা যেতে পারে। একটা সময় পর্যন্ত শ্রী ফনিভূষণ মজুমদারও তাঁকে সহায়তা করেছেন। মিজান চৌধুরী, দেওয়ান ফরিদ গাজী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু তখন অন্য সংগঠন ও দল করেন আওয়ামী লীগ নামে। সবকিছু মিলিয়ে শেখ হাসিনাকে কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়েই অগ্রসর হতে হচ্ছিল এ সময়টা।
আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে অনেক কঠিন সময় ও বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। ক্ষুদ্র পরিসরে তা লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। শুধু আমি বলতে পারি যে, রাষ্ট্রীক ও দলীয় উভয় ক্ষেত্রেই তাঁকে হাঁটতে হয়েছে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে, কিন্তু, দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধুর লক্ষ কোটি আদর্শিক কর্মী যেমনি তাঁকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছেন এবং জনগণের মধ্য থেকে তিনি যে সমর্থন ও ভালবাসা পেয়েছেন তাও কম প্রাপ্তি নয়। কর্মীদের প্রতি স্নেহ মমতায় তিনি যেমন মাতৃসমা তেমনি সহকর্মীদের প্রতিও তাঁর সহমর্মিতা ও সহযোগিতা অতুলনীয়। নেতা-কর্মীদের আনন্দ বেদনায় তাঁর অংশগ্রহণ যে কোন রাজনৈতিক নেতার জন্যই ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশে তিনি এসেছিলেন একজন নিঃস্ব ব্যক্তি হিসেবে, অভিভাবকহীন আর আজ তিনিই লক্ষ কোটি নিঃস্ব মানুষের ভরসাস্থল এবং কোটি অসহায় মানুষের অভিভাবক। আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়া সত্বেও তিনি সেদিন ছিলেন একজন কর্মী মাত্র আর আজ তিনি একজন নেতাই শুধু নন, একজন রাষ্ট্র নায়কও বটে। কর্মী থেকে রাষ্ট্রনায়কে উত্তরণের এই পথ পরিক্রমায় স্নেহময়ী এই জননী একজন দৃঢ় চেতা সাহসী সেনাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে। পিতার যোগ্য উত্তরসূরি এই পুত্রী এক অনন্য ব্যক্তি হিসেবে এবং আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন।
লেখকঃ রাজনৈতিক কর্মী;
সম্পাদক, মত ও পথ।