বিনা দোষে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় ভুল আসামি হয়ে ২৬ মামলায় প্রায় তিন বছর কারাভোগ করা পাটকল শ্রমিক জাহালমকে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য ব্র্যাক ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট।
ব্র্যাক ব্যাংককে বলা হয়েছে, রায়ের কপি হাতে পাওয়ার এক মাসের মধ্যে জাহালমকে ওই ১৫ লাখ টাকা দিতে হবে। আর টাকা দেয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে তা লিখিতভাবে জানাতে হবে।
সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১২ সালের এপ্রিলে মোট ৩৩টি মামলা করে দুদক। দুদক তদন্ত করে জানায়, জালিয়াত চক্র সোনালী ব্যাংকের ক্যান্টনমেন্ট শাখায় আবু সালেকসহ তিনজনের হিসাব থেকে ১০৬টি চেক ইস্যু করে। চেকগুলো ১৮টি ব্যাংকের ১৩টি হিসাবে ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে জমা করে ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ওই ১৮টি ব্যাংকের মধ্যে একটি হলো ব্র্যাক ব্যাংক।
দুদকের নবীন অনভিজ্ঞ তদন্ত কর্মকর্তাদের ভুলে সালেকের বদলে গ্রেফতার করা হয় টাঙ্গাইলের জাহালমকে। তাকে ‘আবু সালেক’ হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন ব্র্যাক ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা। সে কারণে ব্র্যাক ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে এই জরিমানা দিতে বলা হয়েছে।
আদালত রায়ে বলেছেন, এ ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের কোনো ভুল না পাওয়ায় তাদের জরিমানা করা হয়নি। তবে, দুদককে হাইকোর্ট সতর্ক করে দিয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
ব্যাংক ঋণ সংক্রান্ত ঘটনায় ৩৩ মামলায় জাহালমকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল। পুনরায় এসব মামলার চলমান তদন্ত শেষ করে তা দ্রুত নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
একই সঙ্গে, হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, জাহালমের মতো আর কোনো নিরীহ লোক যেন ভবিষ্যতে দুদকের মামলায় জেল না খাটে। দুদককে যথাযথভাবে তদন্ত করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রায় ঘোষণার জন্য নির্ধারিত দিন বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় দেন।
আদালতে আজ দুদকের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। ব্র্যাক ব্যাংকের পক্ষে মামলার শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী আসাদুজ্জামান ও আনিসুল হাসান। সোনালী ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শেখ জাকির হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুল আলম। আদালতে জাহালমের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী অমিত দাসগুপ্ত ও সুভাষ চন্দ্র দাস এবং শাহিনুর রহমান।
এর আগে গত বুধবার (২৩ সেপ্টেম্বর) হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর রায়ের জন্য দিন ঠিক করেন। আজ সেটি রায়ের জন্য সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কজলিস্টের (১ নম্বর) রাখা হয়।
এর আগে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি জাহালমের ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে রুলের শুনানি শেষে যেকোনো দিন রায় ঘোষণা করবেন বলে অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন আদালত।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একটি জাতীয় দৈনিকে ৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামি জেলে ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না…’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশগুপ্ত।
এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা, মামলার বাদীসহ চারজনকে তলব করেন হাইকোর্ট বেঞ্চ। এছাড়া রুলও জারি করেন আদালত।
পরে একই বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্টরা হাজিরের পর হাইকোর্ট জাহালমকে মুক্তির নির্দেশ দেন এবং দুদকের কাছে ঘটনার বিষয়ে হলফনামা আকারে জানতে চেয়েছেন। সে আদেশ অনুসারে দুদক হলফনামা আকারে তা উপস্থাপন করেন।
পরে জাহালম প্রশ্নে ব্যাংক ঋণ জালিয়াতির ৩৩ মামলার এফআইআর, চার্জশিট, সম্পূরক চার্জশিট ও সব ব্যাংকের এ সংক্রান্ত নথিপত্র দাখিল করতে দুদককে নির্দেশ দেন।
এর ধারাবাহিকতায় হাইকোর্ট গত ১৭ এপ্রিল জাহালমকাণ্ডে কে বা কারা দায়ী তা দেখার জন্য এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতিবেদন চেয়েছিলেন। পরে এসব মামলায় দুদক, ব্র্যাক ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়।
জাহালম নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘স্যার, আমি জাহালম। আমি আবু সালেক না “আমি নির্দোষ।’ আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো লোকটির বয়স ৩০-৩২ বছরের বেশি নয়। পরনে লুঙ্গি আর শার্ট। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এ বিচারকের উদ্দেশ্যে তাকে বারবার বলতে দেখা যায়, ‘আমি আবু সালেক না। ’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবু সালেকের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলা হয়েছে। কিন্তু আবু সালেকের বদলে জেল খাটেন, আদালতে অনবরত হাজিরা দিয়ে যান এই জাহালম। তিনি পেশায় পাটকল শ্রমিক।
আবু সালেকের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ২৬টি মামলা হয়। কিন্তু আবু সালেকের বদলে জেলে নেয়া হয় জাহালমকে। যিনি পেশায় পাটকল শ্রমিক। যে ঘটনার তদন্ত করে দুদক জানায়, জাহালম নিরপরাধ। একই মত দেয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও।