অর্থনীতি টেকসই করতে চাই সমন্বিত পদক্ষেপ

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ফাইল ছবি

কভিড-১৯ মহামারির কারণে আরোপিত বাধা-নিষেধ প্রত্যাহারের পর থেকে দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে পুনর্জাগরিত হচ্ছে। এখন এই শাটডাউন-পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিকে সামনের দিকে দ্রুত এগিয়ে নেওয়া দরকার। সেটাই প্রধান কাজ। সেই চেষ্টাও চলছে। তবে এ কাজটি যাতে টেকসই হয়, সে জন্য একটি সমন্বিত দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।

কভিডের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দেশীয় মন্দার পাশাপাশি বৈদেশিক মন্দার প্রভাব পড়ছে। এখন পর্যন্ত স্পষ্ট হচ্ছে যে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি মন্থর থেকে যাবে। কারণ বৈশ্বিক মন্দা কাটিয়ে অর্থনীতি শিগগিরই ঘুরে দাঁড়াবে সেটা বলা যাবে না। এর মধ্যেই বিভিন্ন দেশে কডিভ-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ চলে আসছে। বাংলাদেশেও শীতকালে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। ফলে মোটামুটিভাবে আমাদের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জটা মোকাবেলা করে এগোতে হবে—এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তাই অর্থনীতিকে পুনর্জাগরিত করা খুব কঠিন হবে। একই সঙ্গে বহির্বিশ্বের মন্দা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে এর প্রভাবটা আমাদের এখানে নিশ্চিতভাবেই পড়বে। কারণ আমাদের আমদানি-রপ্তানিসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এর যোগসূত্র রয়েছে।

universel cardiac hospital

আগে থেকেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কিছু চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবেলা করতে হয়। আমাদের সংকটগুলো বহুমুখী। এর মধ্যে ব্যাংকিং সংকট, স্বাস্থ্য সংকট, সুশাসন, জন-অংশগ্রহণের অভাব, ব্যবস্থাপনাগত অদক্ষতা ইত্যাদি রয়েছে। এসবের বিপরীতে আমাদের আশার হলো বাংলাদেশিদের উদ্যম। ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে বেঁচে থাকার নিজস্ব তাগিদেই তারা অর্থনৈতিক কাজ করে। এর কিছুটা ইতিবাচক চিহ্ন আমরা দেখতে পাচ্ছি গার্মেন্ট খাতে। হয়তো শ্রমিকদের স্বার্থ বা দেশের বৃহত্তর স্বার্থের বিষয় নয়, নিজেদের স্বার্থে তারা মুনাফা করার চেষ্টা করছে। এটা ঠিক আছে। তাতে দেশেরই লাভ হচ্ছে। আরেকটা আপত স্বস্তির খবর হচ্ছে রেমিট্যান্সের ভালো প্রবাহ। এখন চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে মানুষের উদ্যম, গার্মেন্ট খাতের মুনাফা এবং রেমিট্যান্সের প্রবাহ কতটা ধরে রাখতে পারব। কারণ কভিডের প্রভাবের পাশাপাশি এর সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও যুক্ত আছে। এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স আসা কমে যাচ্ছে। এ জায়গাটা নিয়েছে এখন কিছু পশ্চিমা দেশ। তাই আমরা স্বস্তি পাচ্ছি। কিন্তু এগুলো যে দীর্ঘস্থায়ী বা টেকসই হবে সেটা তো বলা যাচ্ছে না।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অর্থনীতিকে সামনের দিকে চালিয়ে নিতে কতগুলো বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমত, পরিসংখ্যানের দিকে বেশি দৃষ্টি না দিয়ে আমাদের বাস্তবতার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এই যে বলা হচ্ছে, আমাদের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, এডিবিসহ বিভিন্ন সংস্থা প্রবৃদ্ধি বাড়ার আভাস দিচ্ছে, মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে—এসব তথ্য-উপাত্তে বাংলাদেশের মানুষের সত্যিকারের জীবন যাপন প্রতিফলিত হয় না। কারণ সামষ্টিক সূচকের যে ইতিবাচক দিক—সেই মাইক্রো লেভেলে ততটা প্রভাব পড়েনি। এ কারণে চট করে বলতে পারব না যে আমাদের লোকজন ভালো আছে। আজকে যদি দেশের প্রত্যেকটা মানুষের জীবন যাপন আলাদা করে দেখেন, তাদের সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালানোর বিষয়টা দেখেন, তাদের নিত্য সংগ্রাম দেখেন, তাহলে মানুষ ভালো আছে বলা প্রশ্নবিদ্ধ ব্যাপার হবে। অর্থাৎ ওই সব সূচকে এটা বোঝাই না যে আমরা ভালো আছি। বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে এটাই সত্য। উচ্চ মধ্যবিত্তের বিষয়টা এখানে আসে না। কারণ আমার মনে হয়েছে তাদের জীবনে করোনার প্রভাব ছিটেফোঁটা পড়েছে। হয়তো তাদের বিলাস ও শখের অনেক জিনিস বন্ধ হয়ে গেছে।

অনেকে যুক্তি দেন যে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, অতিদ্রুত আগের অবস্থায় চলে যাচ্ছে, এসব আশাবাদ ভালো। কিন্তু আশাবাদ আবার ভুল বার্তা দেয়। অর্থনীতি ভালো থাকার আসল কারণগুলো কর্মসংস্থান, আয়সংস্থান, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকা সেটা কিন্তু হচ্ছে না। মানুষের আয় কমেছে; কিন্তু দ্রব্যমূল্য, বাড়িভাড়া কিছুই কমেনি। তারপর পানি, গ্যাস ও ইলেকট্রিসিটি চার্জ এগুলো কমেনি। যদিও পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন এসব খাতে রেয়াত দেওয়া হচ্ছে। অর্থনীতি পুনর্জাগরিত করতে হলে মানুষের ভালো থাকা নিশ্চিত করতে হবে, অর্থনীতিকে মাইক্রো লেভেলে উন্নীত করতে হবে।

এই অবস্থায় আমরা যেসব চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে, তাতে যদি একটি সমন্বিত পদক্ষেপ না নিই, তাহলে মারাত্মক ভুল করব। সমন্বিত পদক্ষেপের অর্থ হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ প্রচেষ্টা। তাই সমন্বিত পদক্ষেপের অংশ হিসেবে প্রথমেই দরকার আমাদের যে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দূর করা। আমাদের স্বাস্থ্য খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে নজর দেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দিকে দৃষ্টি দেন, পুঁজিবাজার দেখেন, অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো দেখেন—সবখানেই দেখা যায়, সুন্দর সুন্দর আদর্শ এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কথা বলা আছে। কিন্তু পদে পদে তাদের কাজে দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে। তাই যতই একঘেয়ে শোনাক, এই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করতেই হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার, পিডিবি, ওয়াসা, পৌর প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। কথা হচ্ছে, এই পরিস্থিতির মধ্যেও কেউ আমলাতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে না। সবাই এখনো নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে, কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু কথাগুলো অ্যাকশনে রূপান্তর কোনো রকম চেষ্টা দেখা যায় না।

দ্বিতীয়ত হলো জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানো। প্রকৃতপক্ষে যেকোনো স্তরের মানুষকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে তারা ভালো আছে কি না। হয়তো কিছু ঠিকাদার, রাজনৈতিক নেতা ও কিছু আমলা ভালো আছেন। তাই দুর্ভোগে পড়া মানুষকে কিভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আরো বেশি করে সম্পৃক্ত করা যায়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

আরেকটা বিষয় হলো অর্থনীতি ও সামাজিক খাত মূল্যায়নে যেসব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোরও পুনর্মূল্যায়ন দরকার। কারণ শুধু তথ্য দিয়ে, পরিসংখ্যান দিয়ে বলা যাবে না মানুষ ভালো আছে। তেমনি তথ্যগুলোর কোয়ালিটির বিষয়টি দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে তথ্য-উপাত্ত ম্যানুফ্যাকচারডও হতে পারে। আমরা অনেক সময় বলে থাকি যে দারিদ্র্য, প্রকট দারিদ্র্য এবং মানুষের দুর্ভোগ জানার জন্য মেজারমেন্টের দরকার হয় না। মানুষের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।

সমন্বিত পদক্ষেপের অংশ হিসেবে আমাদের জনগণের পুষ্টির দিকেও নজর দিতে হবে। দেশে এই মুহূর্তে পুষ্টিহীনতা বেড়েছে, বিশেষ করে বাচ্চাদের পুষ্টিহীনতার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, পুষ্টিহীনতা বাড়লে জনস্বাস্থ্যের যে অবনতি হবে, তার প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে।

অর্থনীতিকে পুনর্জাগরণকে টেকসই করতে হলে সরকারি অর্থের অপচয় রোধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এটি টেকসই উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য। গণমাধ্যমে দুর্নীতি নিয়ে বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিবেদন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সার্বিকভাবে ভেতরে ভেতরে সরকারি অপচয় হচ্ছে, তা রোধ করতে কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। যেমন পদ্মা সেতু রেললাইনের ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়েছে। ডিজাইন পরিবর্তন করতে গিয়ে পদ্মা সেতুর খরচ তিন গুণ বেড়ে গেছে। মেট্রো রেলেও একই অবস্থা হয়েছে। এভাবে সরকারের অর্থের অপচয় হচ্ছে, সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে না। অথচ অর্থ সংস্থানের জন্য টার্গেট হচ্ছে জনগণ। মানুষ ট্যাক্স দিচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের ফি দিচ্ছে। মানুষের আপত্তি নেই যদি জোর করে ট্যাক্স আদায় ও ফি আদায় করে নেওয়া অর্থের সুফলটা তারা পায় ।

পদক্ষেপটা সরকার থেকে নেওয়া হলেও তার জন্য নাগরিকদের সোচ্চার হওয়ার বিষয়ও রয়েছে। আমাদের যাঁরা বুদ্ধিজীবী আছেন, শিক্ষক, গবেষক আছেন, তাঁরা কেন সজোরে, সোচ্চার হয়ে কিছু বলছেন না, সেটা হতাশাজনক। দেখা গেছে যারা আজকে সুবিধাভোগী, তারাও কিন্তু কোনো না কোনোভাবে অব্যবস্থাপনাগত দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। দুঃখজনক বিষয় হলো আমরা ভবিষ্যতের দিকে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকে দৃষ্টিপাত করছি না।

সুতরাং বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা অনুযায়ী একটা কল্যাণকামী রাষ্ট্র গড়ে তুলতে আমাদের অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। কথাবার্তা যথেষ্ট হয়েছে, এখন অ্যাকশনে যেতে হবে। দেখলাম প্রেক্ষিত পরিকল্পনার শেষ বর্ষে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে ৩ শতাংশে নিয়ে আসবে। এতে পরিকল্পনা নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলা আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সুন্দর কথা আগেও ছিল; কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তাই প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় যে টার্গেটগুলো রাখা হয়েছে, দারিদ্র্য বিমোচন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, টেকসই উন্নয়ন, পুষ্টি, মাতৃস্বাস্থ্য, পরিবহন—এসব লক্ষ্য যথাসম্ভব অর্জন করার জন্য এখন থেকেই যথেষ্ট কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

অনুলিখন : আফছার আহমেদ

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে