রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর লোকসানি শাখা কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নির্দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক। ফাইল ছবি

নানা অনিয়ম অব্যবস্থাপনায় চলছে সরকারি ব্যাংকগুলো। যাচাই-বাছাই ছাড়াই দিচ্ছে ঋণ, যা আদায় হচ্ছে না। চলছে জাল-জালিয়াতি, অর্থপাচার এবং আত্মসাতের ঘটনাও। ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ, কমছে না লোকসানি শাখা। এতে করে ক্রমশই নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক।

বর্তমানে এসব ব্যাংকে লোকসানি শাখার সংখ্যা ২২৩টি। বছরের পর বছর লোকসানের বোঝা টানতে থাকা এ শাখাগুলো কমানোর কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ, মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতি কমাতেও বিশেষ নজর দিতে বলেছে ব্যাংক খাতের এই নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের সঙ্গে বাৎসরিক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরকালে এসব নির্দেশ দেন গভর্নর ফজলে কবির।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মনিরুজ্জামান ও আহমেদ জামাল। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান, রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়দুল্লাহ আল মাসুদ, জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুছ ছালাম আজাদ এবং অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস-উল ইসলামসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাসুদ বিশ্বাস, হুমায়ুন কবির, আবু ফরাহ মো. নাসের, লিলা রশিদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের লোকসানি শাখা মোট ৫০টি, জনতা ব্যাংকের ৭৯টি, অগ্রণী ব্যাংকের ৭৮টি ও রূপালী ব্যাংকের ১৬টি। সব মিলিয়ে চার ব্যাংকের মোট লোকসানি শাখা ২২৩টি। দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে থাকা এসব শাখাকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন গভর্নর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া ঋণ আদায়ের অব্যাহতি সময় শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলাপি আদায়ের প্রক্রিয়া জোরদার এবং নতুন ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকে। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ২২৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। এছাড়া সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৯ হাজার ৮৮ কোটি টাকা, অগ্রণীর ৫ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা এবং রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৪৪ কোটি টাকা। সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ২১ দশমিক ১১ শতাংশ। কিন্তু অনেক আগেই তা কমে ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসার চুক্তি ছিল।

খেলাপির চাপ সামলাতে গত বছরের ডিসেম্বরে ২১ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা প্রভিশন ছাড় নিয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলো। এই ছাড় নেয়ার ফলে ব্যাংকগুলোর মুনাফা বেড়েছে। ঘাটতি মূলধনকে উদ্বৃত্ত দেখিয়েছে সোনালী ব্যাংক। মার্চে ৫ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি থাকলেও জুনে ৩ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত দেখিয়েছে সোনালী ব্যাংক। এছাড়া ছাড় নিয়েও জুন শেষে অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ১৯৫ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ১ হাজার ৪২ কোটি, জনতা ব্যাংকের ৩ হাজার ৫৬৯ কোটি ও রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১৫৯ কোটি টাকা।

শীর্ষ খেলাপিসহ অন্য খেলাপিদের কাছ থেকে নগদ আদায় করতে না পারলেও খাতা-কলমে বিদ্যমান ঋণের বিপরীতে আয় দেখিয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলো। এতে লোকসানে থাকা ব্যাংকগুলোও এ বছরের জুনে মুনাফা দেখিয়েছে।

সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে গত বছর ৯২২ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা হলেও নিট হিসাবে লোকসান হয় ১ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। এ বছর পরিচালন মুনাফা ১ হাজার ৬৩৬ কোটি এবং নিট মুনাফা দেখিয়েছে ৮৪ কোটি টাকা। গত বছরের জুনে সরকারি খাতের জনতা ব্যাংকের নিট লোকসান ছিল ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকটি এ বছরের জুনে ১৬৪ কোটি টাকা নিট মুনাফা দেখাচ্ছে। অগ্রণী ব্যাংক ১৪১ কোটি টাকা লোকসান থেকে এ বছর নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১৫ কোটি টাকা।

এছাড়া সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলো যথা নিয়মে এবং দ্রুততার সাথে শতভাগ বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে। কারণ করোনাভাইরাসের আঘাতে অর্থনীতি ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার, যার সিংহভাগই ব্যাংকঋণ নির্ভর। সেই স্বচ্ছতার সঙ্গে প্যাকেজগুলো বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই বলেও জানিয়েছেন গভর্নর। পাশাপাশি শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া আরও জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায়ের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার তাগিদ দেয়া হয়।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে