স্বাস্থ্য খাতের নেপথ্য নায়কদের সামনে আনতে হবে ।। আহমদ রফিক

আহমদ রফিক
আহমদ রফিক। ফাইল ছবি

করোনা বিশ্বের বহু দেশের মতো বাংলাদেশেও অনেক সংক্রমণ, অনেক মৃত্যু ঘটিয়েছে; অনেক পরিবারে শোকের কারণ হয়েছে। কিন্তু সম্ভবত একমাত্র বাংলাদেশেই করোনার দুর্যোগ-দুর্ভোগ কিছু অবাঞ্ছিত সামাজিক সত্যের ব্যাপক প্রকাশ ঘটিয়েছে। সেটা যেমন নীতিনৈতিকতার লঙ্ঘন, তেমনি বিস্ময়কর চিত্রপটে ‘সর্বাধিক চেহারার দুর্নীতি। সেটা শ্রেণি-নির্বিশেষ—গাড়িচালক থেকে উচ্চ পদে আসীন কর্মকর্তা। কেন জানি না, করোনার সবচেয়ে বড় টার্গেট স্বাস্থ্য খাত—যে খাত নিয়ে অভিযোগ অনেক। সম্প্রতি তার পচনরূপ প্রকাশ পেয়েছে করোনার কল্যাণে।

একজন সরকারি গাড়িচালক কোন শ্রেণির, কত তার মাইনে, সেসব হিসাবে লাগিয়েও একজন যুক্তিবাদী সাধারণ মানুষ এই সহজ-সরল সত্যটা বুঝতে পারে যে ওই চালকের ঢাকায় তিনটি বাড়ি থাকা খুব একটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়; যদি তার প্রচুর পৈতৃক সম্পত্তি ও অর্থবিত্ত না থাকে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর, সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালকের (আব্দুল মালেক) ঢাকায় তিনটি বহুতল ভবনের সন্ধান মিলেছে।

universel cardiac hospital

এ বিষয়ে বিশদ বিবরণে না গিয়ে দেখতে পাচ্ছি—‘স্বাস্থ্যে নিয়োগ, বদলি, পেনশন মানেই মালেক সিন্ডিকেট’ (কালের কণ্ঠ)। তার মানে, মালেক একা নয়, উল্লিখিত বিষয়ে একাধিক ব্যক্তিকে নিয়ে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির আখড়া ‘মালেক সিন্ডিকেট’। বলা বাহুল্য, এখানে রয়েছে উচ্চপদস্থ স্বাস্থ্য বিভাগীয় কর্মকর্তা, এমনকি এই প্রতিবেদন মতে মালেকের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে বিএমএ (বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন) এবং স্বাচিপের (স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ) কোনো কোনো চিকিৎসকের সম্পর্ক।

করোনা সমস্যাকালে স্বাস্থ্য খাতের নানা মাত্রিক দুর্নীতি নিয়ে সংবাদপত্র মহল ও সমাজে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। মাস্ক-পিপিই নিয়ে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি এবং সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতালের করোনাবিষয়ক দুর্নীতিতে নাম উঠে আসে স্বাস্থ্য খাতের সর্বোচ্চ দুই ব্যক্তির, যাঁরা ওই হাসপাতালের এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

সাহেদের মাত্রাহীন, বহুমাত্রিক কুর্কীতি ও দুর্নীতি ফাঁস হওয়ায় দুদকের কেঁচো খোঁড়া প্রচেষ্টায় বিষাক্ত সব সাপ বেরিয়ে আসে। শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি-ব্যবসা, যেমন—যন্ত্রপাতি, ওষুধ বা সরঞ্জাম কেনায়, তেমনি নিবন্ধনহীন বহুসংখ্যক হাসপাতালের অবৈধ পরিচালনায়। তাদের দুর্নীতি তথা নকল ও নিম্নমানের পিপিই সরবরাহে অবাঞ্ছিত মৃত্যু বেশ কিছুসংখ্যক চিকিৎসক, সেবিকা ও স্বাস্থ্যকর্মীর। প্রশ্ন উঠেছিল—এ করুণ মৃত্যুর দায়টা কার?

তবু স্বাস্থ্য খাত নড়েচড়ে বসেনি—সমন্বয়হীনতা, শিথিলতা ও দুর্নীতির কারণে কত অবাঞ্ছিত মৃত্যু! এ প্রসঙ্গে বিএমএ মহাসচিবের একাধিক বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (চিকিৎসক) বিরুদ্ধে। ক্রমাগত অভিযোগ প্রকাশ প্রধান দৈনিক পত্রিকাগুলোতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পূর্বোক্ত স্বাস্থ্য মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে। তাঁদের পদত্যাগের দাবিতেও পত্রিকায় খবর প্রকাশ পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত শেষোক্তজনের পদত্যাগ, প্রথমজন বহাল তবিয়তে আপন গদিতে।

দুই.

স্বাস্থ্য খাত ঘিরে সাহেদ কেলেঙ্কারি, সাবরিনা কেলেঙ্কারি (এগুলোর তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পথে) হয়ে হঠাৎ করেই ‘মালেক কেলেঙ্কারি’। ওই একই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধিদপ্তর ঘিরে। এর মধ্যেও মাঝে মাঝে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে—কেনাকাটা থেকে বহুতর বিষয়ে।

স্বভাবতই নখদন্তহীন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কিছুটা সক্রিয়। অবিশ্বাস্যই ঠেকে এদের কাজকর্ম—দুই বছর সাহেদকে নজরদারিতে রাখার অর্থটা কী দাঁড়ায়! সাহেদ এখন চার দেয়ালের অভ্যন্তরে। তাই এখন দুদক আরো মালেকের খোঁজে এবং যথারীতি তাদের কর্মধারায় ‘নজরদারিতে ২৭ মালেক’।

এই প্রতিবেদনে প্রকাশ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্তমান মহাপরিচালক বলেছেন, ‘দুর্নীতিবাজদের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। সে যত প্রভাবশালীই হোক না কেন।’ এ কথাগুলো এর আগেও আমরা অনেকবার শুনেছি। তা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন বিভাগে দুর্নীতি সচল থেকেছে কিভাবে? ‘ছাড়’ ঠিকই দেওয়া হয়েছে।

বছরের পর বছর নিবন্ধনহীন বেসরকারি হাসপাতালগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায় তাদের অবৈধ ব্যবসা, নিম্নমানের চিকিৎসাসেবার অমানবিক তত্পরতা চালিয়েছে কিভাবে? চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের মতো নানা শ্রেণির সদস্য নিয়ে দুর্নীতির বিশাল সিন্ডিকেট তৈরি হয় এবং সক্রিয় থাকে কিভাবে?

এত বড় কর্মকাণ্ড বড় একটা গোপন থাকার কথা নয়, বহুজন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার কথা নয়। তবু মন্ত্রণালয়, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, দুদক—কারো নজরেই কি এসব দুর্নীতি ধরা পড়েনি। মাঝেমধ্যে সংবাদপত্রে তো কোনো কোনো ঘটনার খবর প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু তাতে সুশাসন বা সুনীতির গায়ে আঁচড় পড়েনি। দুর্বোধ্য কারণে এখন এত দিন পর অনেক ‘মালেকের’ খোঁজখবরের তল্লাশি চলছে।

আমি ভেবে অবাক হই, উচ্চ শিক্ষিত চিকিৎসক, স্বাধীনতাযুদ্ধে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, নীতিনৈতিকতার আদর্শিক ঐতিহ্যবাহী বিএমএর কোনো চিকিৎসক এসব দুর্নীতির সঙ্গে পরোক্ষে হলেও সংশ্লিষ্ট থাকেন কিভাবে? শুধু রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে নয়, এর প্রসার মফস্বল অঞ্চলেও।

তাই একটি দৈনিকে চমকপ্রদ সংবাদ শিরোনাম—‘বাঘা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স : দরজা বন্ধ করে অফিস করেন প্রধান কর্মকর্তা’। দুর্নীতির নানা অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। কেন্দ্রের প্রভাব তাঁর বাইরের বলয়ে! অবিশ্বাস্য মনে হয় স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির এমন ধারার সংক্রমণ, তার দেহে পচনের সূচনা। না হলে কিভাবে সম্ভব একজন গাড়িচালকের এত প্রভাব, প্রতাপ, প্রতিপত্তি? একটি দৈনিকের শিরোনাম : ‘স্বাস্থ্য অধিদফতর যেন মালেকের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান’।

তিন.

ঘটনা কি শুধু গাড়িচালক মালেকেই সীমাবদ্ধ? এত বড় দুর্নীতির নেটওয়ার্কে তা হতে পারে না। মালেকের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের যোগাযোগেই সব শেষ হওয়ার কথা নয়। এখন তদন্তে ‘বেরিয়ে আসছে আরো নাম।’ আসবে আরো অনেক নাম! কিন্তু তাতেই সব শেষ নয়।

এমন ধারণা অর্বাচীন নয় যে এদের পেছনে থাকতে পারে আরো প্রভাবশালী, ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ, যাঁরা সাহিত্যের ভাষায় ‘নাটের গুরু’, মূল পরিচালক। তেমন সম্ভাবনার নিরিখেই পূর্বোক্ত শিরোনামের ছোট হরফে এমন উক্তি : ‘মালেক, আবজাল, সাহেদ বা সাবরিনাদের সামনে রেখে প্রভাবশালীরা আখের গুছিয়েছেন।’

কারা এই প্রভাবশালী ব্যক্তি? এদের মুখোশ উন্মোচন না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধ হবে না। এদের সামনে আনতে হবে। একই কথা বলেছেন বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামউল হক চৌধুরী। আখের গোছানোর কথাটা তাঁরই, প্রতিবেদকের নয়। তাঁর মতে, ‘আড়ালে থাকা নির্দেশদাতাদের খুঁজে বের করতে না পারলে অভিযানের সুফল পাওয়া যাবে না।’

প্রতিবেদকের ভাষ্যমাফিক—‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন এই চক্রকে সহযোগিতা দিয়েছেন।’ তিনি কি পূর্বকথিত নির্দেশদাতাদের কোনো একজন? এসব প্রশ্নের উত্তরও পেতে হবে পরিচালিত তদন্তে। তা না হলে ‘সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের রাশ টানার তাগিদ’-এ কোনো বাস্তব সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

আমরা আগেও বলেছি, আবারও বলি, স্বাস্থ্যসেবা খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে একে পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে হবে। না হলে একদিকে প্রকৃত জনস্বাস্থ্য সেবা যেমন সম্ভব হবে না, তেমনি সরকারি অর্থের বিপুল অপচয় বন্ধ হবে না। ওই প্রতিবেদনের ভাষ্যেও দেখা যায়, করোনা প্রতিরোধের ঘটনাক্রমেই স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতির বাস্তবতা বেরিয়ে এসেছে, কোথায় এর শেষ, কাদের পরিচয় উদঘাটনে শেষ হবে তা একমাত্র সময়ই বলতে পারবে।

যত দিন যাবে মালেক প্রসঙ্গে নিত্যনতুন খবরের চমক দেখা যাবে। যেমন একটি দৈনিকের প্রথম পাতার প্রধান খবর : ‘এক মৌজাতেই মালেকের ৭ প্লট’। কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো : নেপথ্য নায়করা কি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকবেন?

লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে