আমার নাতির বয়সী এক তরুণকে কদিন আগে বলেছিলাম, দ্যাখো ভাইয়া, এই করোনাকালে ঘরে বসে বসে শুধু ফেসবুক আর ইন্টারনেটে দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছ, বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাটিং করে মূল্যবান সময় নষ্ট করছ, তার চেয়ে একটু-আধটু গবেষণামূলক কাজ করলে ভালো হয় না? যেমন, এই ধরো, দেশে যে হঠাৎ করে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন মহামারির মতো বেড়ে গেল এর কারণ কী একটু অনুসন্ধান করে দেখতে পারো না?…আমার প্রস্তাবটি বোধ হয় সেই ধীমান যুবকটির কাছে ভালোই লেগেছিল। কদিন পর সে তার গবেষণালব্ধ যে অভিজ্ঞান আমার সঙ্গে শেয়ার করল তার সারকথা হচ্ছে, বাঙালি চরিত্রে নাকি এই অপকর্মটি সহজে সংক্রমিত হয় অন্য আরেকটি অনন্য ভাইরাসের উপস্থিতির কারণে, যা শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত, মার্জিত, রুচিশীল জাতিগুলোর মধ্যে কমই দেখা যায়। আমি বিপুল উৎসাহ ও বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলাম, তা সেই ভাইরাসটি কী ভাইয়া? জবাবে সে বলল, ওটি পরশ্রীকাতরতা। শুনে আমি মুখে বিদ্রূপের হাসি ফুটিয়ে বললাম, যাঃ, তাও কি হয়? কোথায় ধর্ষকামিতা, আর কোথায় পরশ্রীকাতরতা। কোথায় আলী আব্বাস, আর কোথায় গাবগাছ। কোথায় আগরতলা, আর কোথায় চৌকির তলা। সে তখন তার রিসার্চের বিস্তারিত বয়ান দিয়ে বলল, বাঙালির এই ইউনিক পরশ্রীকাতরতা ভাইরাসটি নাকি বইয়ে-পুস্তকে, পত্র-পত্রিকায় ছাপাখানার ভূতের দৌরাত্ম্যে কখনো কখনো হয়ে যায় পরস্ত্রীকাতরতা, যা যথাসময়ে প্রভূত পরিমাণ লাঠ্যৌষধি প্রয়োগের দ্বারা নিবারণ না করলে আক্রান্ত ব্যক্তি পরনারী (করোনারি নয়) থ্রম্বসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে পটল তুলতে পারে। নতুবা রোগটি করোনাভাইরাসের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পাঁচ বছরের শিশুকন্যা থেকে শুরু করে পঁচাশি বছরের বৃদ্ধাকেও আক্রমণ করতে পারে। এবং করছেও।
কদিন পর সেই আঁতেল যুবা আরো শুনিয়ে গেল, আমাদের আবহমানকালের বাঙালি সংস্কৃতি, আমাদের জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের সযত্নে লালিত ধর্মপরায়ণতা ও লাজ-লজ্জা-সম্ভ্রমবোধের দ্রুত অপসৃয়মাণতা, সেই সঙ্গে আকাশ-সংস্কৃতির (অ)কল্যাণে চিরায়ত বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে ঘুঁটে-কুড়ানি দুয়োরানির ভূমিকায় বসিয়ে দিয়ে নারীদেহনির্ভর অপসংস্কৃতির আগ্রাসনও নাকি এই নব্য মহামারির বিপুল বিস্তারের জন্য দায়ী। কথাগুলো শুনে কেমন ভাবিত হয়ে পড়লাম, এক ফুঁ দিয়ে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারলাম না তার কথা। একটা জিনিস লক্ষ করলাম : সে নিজের বুক পকেটে কোনো লেবেল লাগিয়ে বা কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর সমর্থক সেজে কথাগুলো বলেনি; সে আমাদের গৌরবদীপ্ত কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের কথা যেমন বলেছে, তেমনি বাঙালির আজন্মলালিত ধর্মীয় চেতনাবোধের কথাও সমান গুরুত্ব দিয়ে বলেছে। তাইতো। বাঙালির পরিচয় তো তার নিজস্ব ভাষা-সভ্যতা-কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ধর্মের ভেতরই নিহিত। বাইরের পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর, যা কিছু কল্যাণকর, তার জন্য উদারহৃদয় বাঙালি হৃদয়ের সকল দুয়ার, সকল বাতায়ন উন্মুক্ত রাখে ঠিকই; কিন্তু তার মানে এই নয় যে সেই খোলা পথ দিয়ে প্রবেশ করে অপসংস্কৃতির পূতিগন্ধময় দূষিত বাতাস বাঙালির জীবনধারণের বিশুদ্ধ অক্সিজেনটুকুকে গৃহছাড়া করে ছাড়বে।
২.
একথা বোধ হয় অস্বীকার করার উপায় নেই, টেলিভিশন ও মোবাইল ফোনের অবারিত ব্যবহার আমাদের শিশু-কিশোর-যুবাদের অনেককেই আলোকোজ্জ্বল পৃথিবীর পথ থেকে পাপপঙ্কিল অন্ধকার জগতে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সন্তানদের এরূপ বিপথচারিতা আমরা, মানে তাদের অভিভাবকেরা, যেন দেখেও দেখছি না। ফলে হঠাৎ একদিন যখন আমরা আমাদের ছেলেটিকে বা মেয়েটিকে কোথাও কোনো হোটেলে, ক্লাবে বা কারো বাসগৃহে অসামাজিক ক্রিয়াকলাপে আটক হয়ে ফাটকে যেতে দেখি তখন আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। অথচ এইসব মাদকসেবন আর অবৈধ মেলামেশার সবক যখন সে টিভিতে বা তার মোবাইল সেটে সাগ্রহে নিচ্ছিল, তখন আমরা ও আমাদের হঠাৎ বিশ্বসভায় কল্কে পাওয়া সমাজ সেটাকে তথাকথিত বয়োধর্ম বলে মেনে নিয়েছি। আমরা একবারও ভেবে দেখি না যে প্রকাশ্যে মদ্যপান, নৃত্যগীতের নামে পরস্পরের কোমর ধরে তরুণ-তরুণীর লৎকা-লিক বা নারী-পুরুষের আপত্তিকর মেলামেশা অন্য কোনো দেশের সংস্কৃতির অঙ্গ হলেও তা আমাদের সমাজে, আমাদের ধর্মে, কৃষ্টিতে নিষিদ্ধ ও সামাজিকভাবে বিগর্হিত। আমাদের বাপ-দাদারা বা তাঁদের পূর্বপুরুষেরা এমনকি সেই ব্রিটিশ আমলের দুশ বছরেও এগুলো ঘৃণাভরে পরিহার করেছেন। অবশ্য কেউ যদি সেই আমলের কোনো কর্তাভজা বিলাতফেরত হাফ সাহেব-হাফ বাঙালি অথবা নওয়াব সাহেব বা রায়বাহাদুরের উদাহরণ দিতে চান তাহলে আমি সবিনয়ে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইব, ওই বাদামি সাহেবরা-বাবুরা কোনোকালেই কোটি কোটি প্রকৃত বাঙালির প্রতিভূ ছিলেন না। যার ফলে ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে যখন এদেশ থেকে এক দরজা দিয়ে বের হয়ে গেছে, তখন আরেক দরজা দিয়ে ওই বাদামি সাহেবরাও তাদের ধড়া-চূড়া, গেলাস-গুলাস নিয়ে সটকে পড়েছেন। যা বুকের রক্তে অবগাহন করে টিকে রইল তা মাতৃভাষা বাংলার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়ে লেখা অনন্য ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত বাঙালি সভ্যতা-সংস্কৃতি, যা আমাদের সকল উন্নয়ন-উল্লম্ফন-আরোহণের ভিত্তি। একদা কুঁড়েঘরের বাসিন্দা কেউ হয়তো স্বীয় মেধা-শ্রম-নিষ্ঠার জোরে বিশতলা দালানের মালিক হয়েছেন, সুখে নিদ্রা যাচ্ছেন প্রাসাদোপম অট্টালিকায়। ভালো কথা, কিন্তু ওই বিশতলা হর্ম্যরাজি যদি ইস্পাতদৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপিত না হয়, তবে একদিন যে সেগুলো তাসের ঘরের মতো ধসে পড়বে সেটা জানতে হলে বড় স্থপতি বা প্রকৌশলী হতে হয় না, মহল্লার মনু মিয়া-ধনু মিয়া রাজমিস্ত্রি-জোগালেরাও তা জানে। আর জানে বলেই ভবননির্মাতা হুজুরকে পই পই করে বোঝায় ভিত্তি মজবুত করার খরচে কার্পণ্য না করতে। আমাদের সকল উন্নতি, ভূতভবিষ্যৎ দাঁড়িয়ে আছে, দাঁড়িয়ে থাকবে, এই ভিত্তি বা ‘ফাউন্ডেশনের’ ওপর। আর সেই ‘ফাউন্ডেশন’ হচ্ছে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি-সভ্যতা। এগুলোকে অবহেলা করে সীমান্তপারের, তথা সাগরপারের, তথাকথিত ‘ইস্মার্ট’ কৃষ্টি-সংস্কৃতির মোহে পড়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গেলে তা হবে কাঞ্চন ফেলে কাচে গেরো দেওয়ার মতো বেকুবি।
না, আমি কোনো সভ্যতা-সংস্কৃতির সবই খারাপ তা বলছি না, সবই বর্জনীয় তাও মনে করি না। কেন, পাশ্চাত্য জীবনধারা থেকে শ্রমের মর্যাদা, শৃঙ্খলাপরায়ণতা, সৌজন্যবোধ ও শিষ্টাচারের মতো অনেক কিছুই তো আমাদের শেখার আছে, যা আমাদের জীবনে দুঃখজনকভাবে অনেকটাই অনুপস্থিত। আর প্রতারণা, ভণ্ডামি, মিথ্যাচার, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেওয়া ইত্যাদি তো এখন আমাদের জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে গেছে। এগুলো যে হঠাৎ আসমানি বালা হয়ে করোনাভাইরাসের মতো ইদানীং নাজিল হয়েছে তা নয়—এগুলোর অস্তিত্ব আগেও ছিল, এখনো আছে। আজ থেকে ৫০ বছর, ১০০ বছর আগে এসব অপকর্ম, দুর্নীতি সমাজকে তখনো যেমন কলুষিত করেছে তেমনি আজও করছে। তবে এখনকার মতো কোনোকালেই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এগুলো ক্যান্সার বা করোনাভাইরাসের ন্যায় ছড়িয়ে পড়েনি। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এই ভাইরাসটির এমন আকস্মিক বিস্তারলাভের কারণ কী। এর সঠিক উত্তর হয়তো সমাজবিজ্ঞানীরা, যারা ছুরি-কাঁচি দিয়ে সমাজদেহ ব্যবচ্ছেদ করেন, তাঁরা দিতে পারবেন। তবে আমাদের মতো উম্মি লোকের ধারণা, বাংলাদেশের উর্বর মাটি এবং অনুকূল জল-হাওয়ায় এর প্রাদুর্ভাব ঘটে স্বাধীনতার পর থেকে, যখন পাকিস্তানিদের একচেটিয়া দুর্নীতির ফেলে যাওয়া ময়দানে তাদের দ্বারা প্রশিক্ষিত, তাদেরই কিছু কিছু শাগরেদ যারা আগে ছুরি দিয়ে কচু কাটত তারা গলা কাটতে শুরু করে। তারা কল-কারখানা, জমি-জিরাত, ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়ি-গাড়ি সবকিছু শুধু কুক্ষিগতই করল না, সবখানে তাদের স্বঘোষিত নিয়ম-কানুন চালু করল। ফলে অচিরেই তারা আঙুল ফুলে কলাগাছ, তারপর তালগাছ, বটগাছ হয়ে গেল। এই যে রকেটগতিতে ঊর্ধ্বগমন, রাতারাতি পদসেবক থেকে প্রভু বনে যাওয়ার সংস্কৃতি চালু করল সমাজের সব স্তরের কিছু কিছু মানুষ, তারা সঙ্গী হিসেবে পেল রাজনীতি ও প্রশাসনের কিছু ধুরন্ধর ব্যক্তিকে, যারা ন্যায়নীতি-নিয়মকানুন-হকইনসাফকে বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে ‘করাপশন আনলিমিটেড’ নামক কম্পানি প্রতিষ্ঠা করল। সেই কম্পানির শেয়ারহোল্ডার এখন পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে। দেশের প্রচলিত আইনকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে এরা যা খুশি তাই করতে পারে, যা খুশি তাই করছে। এদের অপকর্মের কোনো জবাবদিহিতা নেই, যেন সংবিধানে এদের এক ধরনের ‘ইনডেমনিটি’ দিয়ে রাখা হয়েছে।
এর ফলে যে সামাজিক অনাচার প্রশাসন, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, দ্রব্যমূল্য, শিক্ষাঙ্গন প্রভৃতি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে, তার কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। হ্যাঁ, সাধারণ মানুষ। কারণ সমাজের যারা উঁচুতলার বাসিন্দা তারা হাঁচি দিলেই ডাক্তার এসে হাজির হন, বাড়ির পাশে একটু সারমেয়ধ্বনি শোনা গেলে সঙ্গে সঙ্গে হাজির হয় থানা-পুলিশ। আর সাধারণ মানুষ, যেও ওই মগডালবাসীর মতো সাংবিধানিক বিচারে এদেশের একজন নাগরিক—আর শুধু নাগরিকই নয়, সমান অধিকারপ্রাপ্তও বটে—ক্ষুিপপাসায় ধুঁকে ধুঁকে কিংবা করোনাভাইরাসাক্রান্ত হয়ে বস্তির ঝুপড়িতে অথবা ফুটপাতে মরে পড়ে থাকলেও কেউ দেখে না। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম তার লাশের গতি করে অজ্ঞাতকুলশীল একজন হিসেবে। এভাবে সে ৫০ টাকা কেজির আলু, ১০০ টাকা কেজির পেঁয়াজ, ২০০ টাকা কেজির কাঁচা মরিচ এবং ছেঁচাগুঁতোর জীবন নামক জাঁতাকলের নিষ্পেষণ থেকে চিরতরে মুক্তি পেয়ে চিরশান্তির রাজ্যে চলে যায়।
৩.
১৭/১৮ কোটি মানুষের দেশে সামাজিক বৈষম্য যে কী ভয়াবহ তা জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রকট। সেই বৈষম্য যে রাতারাতি দূর হয়ে যাবে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। এমনটি কেউ দাবিও করছে না। তবে বৈষম্যের ‘গ্যাপ’ ধীরে ধীরে হলেও কমে না এসে যদি দিন দিন বাড়তে থাকে তবে সেটা অবশ্যই দুশ্চিন্তার কারণ। বৈষম্যের শিকার মানুষ আহার-বাসস্থান-স্বাস্থ্য-শিক্ষা অর্থাৎ জীবনধারণের সকল মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নানাভাবে বঞ্চিত হতে থাকে। মুখোমুখি হয় অসংখ্য চ্যালেঞ্জের, যার বেশির ভাগই অন্যায্য। অন্যায্য এই কারণে যে সমাজের সংখ্যালঘু সুবিধাভোগীরা নিজেদের জন্য গাছেরটা এবং তলারটার মাত্রাতিরিক্ত প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে গিয়ে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য তলানিটুকুও রাখে না। পাকিস্তানিরা এই কাজটি পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে খুব মনোযোগসহকারে করেছে দীর্ঘ ২৪ বছর। যে কারণে জীবনের সব ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় আমাদের সঙ্গে তাদের পর্বতপ্রমাণ ‘ডিসপ্যারিটি’ বা অসমতা, যা বাঙালিমানসে জন্ম দেয় অসন্তোষের অগ্নিগিরি। আর সেই অগ্নিগিরির অগ্ন্যুৎপাতে পাকিস্তান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বাঙালির জীবনে সিকি শতাব্দী জুড়ে ঘটে যাওয়া এই বৈষম্য-বঞ্চনার ইতিহাস কি আমরা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেছি? সেই ক্ষত হয়তো শুকিয়ে গেছে, কিন্তু কথায় আছে না ‘ঘা শুকালেও শুকায় না আঘাত’। তাহলে কেন আমরা আমাদেরই অনগ্রসর বঞ্চিত হতদরিদ্র বিশাল জনগোষ্ঠীকে টেনে তোলার চেষ্টা করব না? অতি সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের উন্নয়নের ওপর জোর দিতে বলেছেন। অর্থাৎ এখন থেকে ফোকাসটা যেন ‘এইসব মূঢ়-ম্লান-মূক’ মুখের ওপর বেশি হয়। কথাটি সংশ্লিষ্ট সকলকে অবশ্যই গুরুত্বসহকারে উপলব্ধি করতে হবে এবং তদনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে যদি ওই বিক্ষুব্ধ ক্ষুধার্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা কবি রফিক আজাদের সত্তরের দশকের গোড়ার দিকের আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতা ‘ভাত দে হারামজাদা’-র সেই ভয়ংকর পঙক্তি—‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাব’—আউড়াতে আউড়াতে রাজপথে নেমে আসে তখন? তখন আমরা হাল আমলের খুন-ধর্ষণ-গুম সামলাব, না দেশের অস্তিত্ব রক্ষায় নামব? আল্লাহ না করুন, ওরকম পরিস্থিতির যেন সৃষ্টি না হয়। আমরা বাঙালি হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজ থেকে এক শ দশ বছর আগে লেখা অমর সতর্কবাণী কী করে ভুলে যাই : …‘মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে,/সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,/অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান/…যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,/পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’… (অপমানিত, ২০ আষাঢ় ১৩১৭, গীতাঞ্জলি কাব্য)।
৪.
এ পর্যায়ে এই বলে সমাপ্তি টানব এই আলোচনার : আমাদের প্রবৃদ্ধির হার সামগ্রিকভাবে যতই ঈর্ষণীয় পর্যায়ে যাক, আমাদের সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে যেন থাকে আমাদের দেশের অগণিত হতদরিদ্র মানুষ। বিত্তশালীদের মুখের কান-এঁটো-করা বিস্তৃত হাসির চেয়ে দারিদ্র্যপ্রপীড়িত হাড় জিরজিরে চিরবঞ্চিত কৃষকের মুখের একচিলতে হাসির দাম হোক আমাদের কাছে এক মিলিয়ন ডলার। আমরা কী করে ভুলে যাব আমাদের ডবল ডিজিট প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে এই কৃষকই তার রক্ত পানি করা শ্রম দিয়ে ১৭/১৮ কোটি মানুষের মুখে অন্ন জোগাচ্ছে, ক্ষুধার নেকড়েটাকে চিরকাল এই কৃষকই আমাদের সদর দরজা থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। কী করে ভুলে যাব করোনার ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে আমাদের সোনার মেয়ে গার্মেন্টকর্মীরা আজও কাকভোরে হাতে টিফিন বাক্স দোলাতে দোলাতে ফ্যাক্টরিতে গিয়ে প্রাণমন সঁপে দেয় সেলাই মেশিনে। আখেরে তার ঘরে একটি ডলার বা সেন্টও আসে না, তবে আসে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার বাংলাদেশের খাজাঞ্চিখানায়। সেটাই তার তৃপ্তি, সেটাই তার আনন্দ। আর ভুলি কী করে আমাদের ডাকাবুকো লক্ষ লক্ষ ছেলেকে, যারা মধ্যপ্রাচ্যের গনগনে তাওয়ার মতো উত্তপ্ত কল-কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে, রাজপথ-জনপথে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নিজেকে সিদ্ধ করে করে নিজে না খেয়ে না পরে দুটো কাঁচা পয়সা পাঠাচ্ছে দেশে। এরা সবাই—আমার দেশের কৃষক, গার্মেন্টকর্মী, বিদেশে কর্মরত শ্রমিক ছেমলটি—এদেশের প্রাণ, ‘লাইফ ফোর্স’। তৃণমূলে এরা আছে, আরো আছে অগণিত বঞ্চিত মানুষ। একদিন যুদ্ধের ময়দানে এরা ‘ও মা তোমার বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি’ বলে খালি হাতে শুধু বুকের ভেতর মায়ের জন্য একবুক ভালোবাসা নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তখনো ছিল, এবং এখনো এরাই ‘দ্য রিয়েল হিরোজ’।
সব শেষে একটা কথা বলতে চাই। এই ছোট দেশটাতে আর কত কলহ, কত বাদ-বিসম্বাদ দেখব আমরা? কমরানা-পরবর্তীকালে পৃথিবীর যে নবজন্ম হতে চলেছে তাতে কি আমাদের এই এক শ বছরের পুরনো মডেলের রাজনীতি নিয়ে চলতে পারব আমরা? যদি মনে করি পারব না, তাহলে রাজনীতির খোলনলচে বদলাবার এই তো সময়। ঠিক না?
লেখক : সাবেক সচিব, কবি
mkarim06@yahoo.com