সিলেটে পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে মারা যাওয়া যুবক রায়হান আহমদের মা সালমা বেগম আমরণ অনশন ভেঙেছেন। সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর আশ্বাসে তিনি অনশন ভাঙেন।
আজ রোববার সকাল থেকে ছেলে হত্যার বিচার দাবিতে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁসির সামনে অনশনে বসেন রায়হানের মা ও স্বজনরা। বিকাল ৪টা ৪৫ মিনিটে অসুস্থ রায়হানের মায়ের অনশন ভাঙান সিলেট সিটি মেয়র।
এ সময় মেয়র রায়হানের মাকে আশ্বস্ত করে বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত দোষীদের গ্রেপ্তার ও বিচার না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সিলেটবাসী এই আন্দোলনে রায়হানের পরিবারের পাশে থাকবে।
মেয়র বলেন, রায়হান হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত এসআই আকবর ও অন্যান্য আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারের জন্য আমরা পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তকর্তাদের সঙ্গে কথা বলব।’
এ সময় উপস্থিত ছিলেন ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তৌফিক বক্স লিপন, কাউন্সিলর মখলিছুর রহমান কমরান প্রমুখ।
এর আগে বেলা ১১টা থেকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সামনে রায়হানের মা সালমা বেগমসহ আখালিয়া এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা এবং রায়হানের পরিবারের কয়েকজন সদস্য অনশন কর্মসূচি শুরু করেন।
রায়হানের মা উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আমার বুকের ধন একমাত্র ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে এই ফাঁড়ির সাবেক ইনচার্জ এসআই আকবর ও তার সহযোগীরা। বর্বরোচিতভাবে নির্যাতন করে আমার ছেলেকে হত্যা করেছেন তারা। আমি এ হত্যাকারীদের বিচার চাই। আর না হয়, আমার ছেলেকে মেরেছে, আমাকেও গুলি করে মারা হোক।
সালমা বেগম বলেন, আমার ছেলেকে এ ফাঁড়িতে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার আজ ১৫ দিন অতিবাহিত হলেও এসআই আকবরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। এ ছাড়া পুলিশ হেফাজতে থাকা আকবরের সহযোগীদেরও গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে না।
রায়হানের মা বলেন, আমার ছেলের হত্যাকারী এসআই আকবরকে না ধরা পর্যন্ত আমি এখানেই অবস্থান করব। এ কর্মসূচি কোনো দলীয় কর্মসূচি নয়। তাই দলমত নির্বিশেষে সবাইকে অংশ নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
অনশনে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের হাতে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তারের দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড ছিল।
উল্লেখ্য, ১১ অক্টোবর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতন করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে রায়হানের মৃত্যু হয়।
রায়হান সিলেট নগরের আখালিয়ার নেহারিপাড়ার বিডিআরের হাবিলদার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে। তিনি নগরের রিকাবিবাজার স্টেডিয়াম মার্কেটে এক চিকিৎসকের চেম্বারে চাকরি করতেন।
এ ঘটনায় ১২ অক্টোবর রাতে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু আইনে এসএমপির কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি।
১৪ অক্টোবর মামলাটি পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে পিবিআইতে স্থানান্তর হয়। তদন্তভার পাওয়ার পর পিবিআইর টিম ঘটনাস্থল বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি, নগরের কাস্টঘর, নিহতের বাড়ি পরিদর্শন করে। সর্বোপরি লাশ কবর থেকে তোলার পর পুনরায় ময়নাতদন্ত করা হয়।
নিহত রায়হানের মরদেহে ১১১ আঘাতের চিহ্ন উঠে এসেছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে। এসব আঘাতের ৯৭টি ফোলা আঘাত ও ১৪টি ছিল গুরুতর জখমের চিহ্ন। এসব আঘাতগুলো লাঠি দ্বারাই করা হয়েছে। অসংখ্য আঘাতের কারণে হাইপোভলিউমিক শক ও নিউরোজেনিক শকে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো কর্মক্ষমতা হারানোর কারণে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে বলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এ ঘটনায় গত ২০ অক্টোবর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান আহমদ হত্যা মামলায় ওই ফাঁড়ির পুলিশ কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাসকে ও ২৩ অক্টোবর পুলিশ কনস্টেবল হারুনুর রশিদকে গ্রেফতারের পর পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
ঘটনার দিন বিকেলে মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে রায়হানকে ফাঁড়িতে এনে নির্যাতনের প্রাথমিক প্রমাণ পায় কমিটি। এই তদন্ত কমিটির সুপারিশে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটুচন্দ্র দাসকে সাময়িক বরখাস্ত এবং এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেনকে প্রত্যাহার করে তাদের পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়।
এছাড়া গত ২১ অক্টোবর এ ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (সাময়িক বরখাস্তকৃত) উপ-পরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে ফাঁড়ি থেকে পালাতে সহায়তা করা ও তথ্য গোপনের অপরাধে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির টু আইসি এসআই হাসান উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।