করোনা মহামারির কারণে প্রায় ছয় মাসের বেশি সময় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গতি ছিল না। তবে সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে। বিশেষ করে মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্র চীন ও ভারত ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) বেশ তৎপর ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে চীনকে আশ্বস্ত করেছে মিয়ানমার। এ বিষয়ে মিয়ানমারের নির্বাচনের পর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনের বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছে চীন। শুধু তাই নয়, বৈঠকের জন্য ঢাকাকে প্রস্তুতির তাগিদ দিয়েছে মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্রটি।
এদিকে ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি রোববার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে জানান, সম্প্রতি তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করেছেন। জাপানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে মিয়ানমারকে তাগিদ দিয়েছেন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের অনুরোধের জবাবে জাপানি রাষ্ট্রদূত বলেন, মিয়ানমারকে তার সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে চাপ দেবে।
একই দিন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) নেতৃত্বস্থানীয় দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা বিষয়ে গাম্বিয়াকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে মিসরের প্রতি আহ্বান জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
জবাবে মিসরের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ওয়ালিদ আহমেদ সামসেলদিন রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে মিসরের সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন।
ব্রিটেনও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে প্রস্তুত বলে জানান হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন। তিনি রবিবার টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার বাড়ির পূজাম-পসহ কয়েকটি পূজাম-প পরিদর্শন করেন। এ সময় হাইকমিশনার সাংবাদিকদের জানান, যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে প্রস্তুত।
আজ রোহিঙ্গাদের জন্য চলতি বছরে ৯৬ মিলিয়ন ইউরো সহায়তার ঘোষণা দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ইইউর ঢাকা অফিস জানায়, সংকট ব্যবস্থাপনা বিষয়ক ইউরোপীয় কমিশনার জ্যানেন লেনার্সিক এ অর্থ সহায়তার ঘোষণা দেন।
রোহিঙ্গাদের জন্য স্বেচ্ছামূলক, নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে টেকসই সমাধানে পৌঁছাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আরও জোরদার করা আবশ্যক বলে মত দেন সংকট ব্যবস্থাপনা বিষয়ক ইউরোপীয় এই কমিশনার।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন ই বিগান। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের গুরত্বপূর্ণ এই রাজনীতিক নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পক্ষে ভূমিকা না রেখে মিয়ানমারকে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে সহায়তা প্রদানকারী দেশগুলোর সমালোচনা করেন।
সফর শেষে দেশে ফিরে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিগান। তিনি বলেন, চীন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে খুব কম কাজ করেছে।
এর প্রতিবাদে শনিবার রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য ‘অসংগত’ ও ‘গঠনমূলক’ নয় বলে জবাব দেয় বেইজিং।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সঙ্গে টেলিফোন আলাপ করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। ফোনালাপের মূল বিষয় ছিল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্রুত আলোচনা শুরু করার বিষয়টি উল্লেখ করেছে।
মিয়ানমারের নির্বাচনের পর প্রথমে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের মন্ত্রীপর্যায়ের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে এ কে মোমেনকে আশ্বস্ত করেন ওয়াং ই।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ঢাকায় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পর্যায়ের প্রস্তুতিমূলক ত্রিপক্ষীয় বৈঠক দ্রুত শুরু করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
আব্দুল মোমেনের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপের সময় ওয়াং ই বলেন, চীন রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে রোহিঙ্গাদের যাতে ফেরত নেওয়া যায় সে জন্য মিয়ানমার কাজ করবে বলে চীনকে আশ্বস্ত করেছে।
গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওয়ের উদ্যোগে রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা বিষয়ক দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর এক বৈঠকে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আরও ৩৫ কোটি ডলার অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ২০ কোটি, ইইউ ৯ কোটি ৬০ লাখ ও বৃটেন দেবে ৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলার।
দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর এই বৈঠকে বাংলাদেশের তরফে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম অংশ নেন। বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গাকে দীর্ঘদিন ধরে রাখার মতো পরিস্থিতি নেই উল্লেখ করে যত দ্রুত সম্ভব তাদের মিয়ানমারের রাখাইনের নিজভূমে ফেরাতে সবাইকে সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ কনসাল্টেটিভ কমিশনের (জেসিসি) বৈঠকের পর দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে ঢাকার পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওপর প্রভাব খাটানোর জন্য অনুরোধ জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুুল মোমেন।
এরপরই এক ঝটিকা সফরে মিয়ানমার যান ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ও সেনাপ্রধান জেনারেল এম এম নারাভানে। সেই সফরে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি এবং সে দেশের সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ অং মিন লেইং-র সঙ্গে বৈঠক করেন।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ও সেনাপ্রধান তাদের মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে আহ্বান জানান। আগামী নভেম্বরে মিয়ানমারে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনের আগেই অন্তত কিছু রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে ভারত মিয়ানমারকে প্রস্তাব দেয় বলে দেশটির গণমাধ্যমে খবর আসে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।
আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি।
গত বছর দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হয়নি রোহিঙ্গারা।