তাঁরা সবাই বলছেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার খুব খারাপ। বিএনপি, জামায়াত, সিপিবি, সিপিডি সবার কণ্ঠে একই সুর—দেশটিতে মানবাধিকার নেই, আইনের শাসন নেই, ভোট চুরি হয়। কথা বলার অধিকার নেই আরো কত কী? আর এই সব কথা প্রমাণ করার জন্য তাঁরা পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে আমেরিকার পত্রপত্রিকা, সরকারি-বেসরকারি মহলের মন্তব্য উল্লেখ করেন। এমনকি তাঁরা এমন দাবিও করেন, আমেরিকার বর্তমান ট্রাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেশনও হাসিনা সরকারের ওপর বিরক্ত। সুযোগ পেলে তারা এমন কথাও প্রচার করে, ভারতের মোদি সরকারের সঙ্গেও হাসিনা সরকারের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভেঙে গেছে। এই প্রচার দ্বারা বাংলাদেশের এই ডান ও বামের মিলিত চক্র দেশবাসীকে বোঝাতে চায় হাসিনা সরকারের দিন শেষ হয়ে এসেছে।
এই ‘কালেক্টিভ লাইজ’ বা সম্মিলিত মিথ্যা কখনো সত্য বলে প্রমাণ করা যায়নি। মোদি সরকারের সঙ্গে হাসিনা সরকারের সম্পর্ক ভেঙে গেছে, এই প্রচারটা যে সময় করা হয়েছে, সে সময়েই দেখা গেছে নরেন্দ্র মোদি হাসিখুশি মুখে দিল্লি থেকে ঢাকায় টেলিফোনে শেখ হাসিনার সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন। একটি ভারতীয় কাগজে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির দায়ে জেলে পাঠানোর সময় লন্ডন থেকে তারেক রহমান এ ব্যাপারে ভারতকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষার নামে হস্তক্ষেপের আবেদন জানিয়েছিলেন। খবর কতটা সঠিক জানি না। কিন্তু ওই খবরে আরো বলা হয়েছিল, তারেকের এই আরজি প্রধানমন্ত্রী মোদি আমলে নেননি।
বাংলাদেশ সম্পর্কে ট্রাম্পের আমেরিকারও কি একই আগের নীতি? ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে প্রেসিডেন্ট’ (বলেছেন গার্ডিয়ানের কলামিস্ট জনাথন ফ্রিডল্যান্ড) তাতে সন্দেহ নেই। ট্রাম্প বাংলাদেশ সম্পর্কে আমেরিকার ট্র্যাডিশনাল নীতি পরিবর্তন করেননি, এ কথাও সত্য। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করার জন্য সিআইএকে উসকে দেননি। এটা হয়তো করতেন হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট হতে পারলে। প্রেসিডেন্ট ওবামা সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে হিলারি তাঁর বন্ধু গ্রামীণ ব্যাংকের ড. ইউনূসের স্বার্থে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছিলেন। এ সময় বাংলাদেশের একটি সুধীসমাজ এই ভেবে উল্লসিত হয়েছিল যে হিলারি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন এবং তিনি হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করবেন। তাদের এ আশা যে পূর্ণ হয়নি সে কথা আমি অতি সম্প্রতিও আমার এক কলামে লিখেছি।
ট্রাম্প প্রশাসন উত্তর কোরিয়া, ইরান এবং পরবর্তীকালে চীনকে নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন মাথা ঘামাবার সময় হয়তো পায়নি। দক্ষিণ এশিয়ায় যত দিন ভারত তাদের পাশে থাকবে, তত দিন অন্যান্য দেশ সম্পর্কে ট্রাম্প প্রশাসন তেমন মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করে না। তবে এসব দেশে আধিপত্য ও প্রভাব বাড়াতে এই প্রশাসন নানা উপায়ে চেষ্টা করেনি তা বলা যাবে না। এই প্রচেষ্টা তার ধারাবাহিকতা এখনো অক্ষুণ্ন রেখেছে।
সপ্তাহখানেক আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি সেক্রেটারি স্টিফেন বিগান আমেরিকা থেকে এক টেলিকনফারেন্সে বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন। তাঁর মন্তব্য থেকেও হাসিনা সরকারের গণতান্ত্রিক ভূমিকা ও অন্যান্য কার্যকলাপ সম্পর্কে ওয়াশিংটন যে অবহিত রয়েছে এবং হাসিনা সরকারের ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখে এই সরকারের সঙ্গে সহযোগিতামূলক কাজ করতে মার্কিন সরকার আগ্রহী, তা স্পষ্ট হয়েছে।
স্টিফেন বিগান সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারত সফর করে গেছেন। সুতরাং বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব এবং ভারত ও চীনের বৈরিতায় এশিয়ায় যে নতুন স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে, সে সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য কী এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবে জড়িত কি না সে সম্পর্কেও টেলিকনফারেন্সে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়েছে কি না জানি না। কারণ প্রকাশিত খবরে তা বলা হয়নি, কিন্তু আমেরিকায় বিএনপির প্রথম সারির অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে পরিচিত এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছেন (আমাদের সুধীসমাজের শিখিয়ে দেওয়া কি না জানি না), ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আইনের শাসন নেই, ভোটও চুরি হয়ে গেছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব কী এবং বাংলাদেশের কী করণীয় সে সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র কী বলবে? এই সাংবাদিক সম্ভবত আশা করেছিলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নেই বলে যে কথা আগেভাগেই তিনি বলেছেন, বিগান তাতে সায় দেবেন এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য হাসিনা সরকারের ওপর তার সরকারের চাপ দেওয়ার কথা বলবেন। যদি বিগান সাবেক কোনো কোনো মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মতো সে কথা বলতেন, তাহলে তা ঢাকার কোনো ‘নিরপেক্ষ’ ইংরেজি, বাংলা দৈনিকে ব্যানার হেডিংয়ে খবর হতো এবং বিগানকে উদ্ধৃত করে সুধীসমাজের কলামিস্টরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ডজন ডজন কলাম লিখতেন, টেলিভিশনের টক শো গরম করে ফেলতেন।
তাঁদের দুর্ভাগ্যক্রমে বিগান এমন কোনো কথাই বলেননি। বরং হাসিনা সরকারের প্রশংসা করে ভবিষ্যতে এই সরকারের সঙ্গে আরো যুক্তভাবে কাজ করতে তাঁর সরকার আগ্রহী বলে জানিয়েছেন। গণতন্ত্র সম্পর্কে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আমরা পুরোপুরি অবগত যে বাংলাদেশের এমন একটি অঞ্চলে অবস্থান, যে অঞ্চলে গণতন্ত্রের চর্চা, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চার পরিবেশ সব সময় সহায়ক নয়। তবু এই অঞ্চলে অবস্থান করেও বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। তিনি আরো বলেন, ‘বিভিন্ন নির্বাচনে গণতন্ত্রের আদর্শ ধরে রাখা প্রতিটি দেশের জন্যই চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশও এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করছে। তাই এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো উপসংহারে পৌঁছতে চাই না। আপনারা আশ্বস্ত থাকতে পারেন যে রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সম্ভাব্য ভালো রূপ অর্জনে আমরা বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের সঙ্গে কাজ করা অব্যাহত রাখব।’
স্টিফেন বিগানের এই কথাগুলো নিশ্চয়ই বাংলাদেশ থেকে যে সাংবাদিক ওপরের প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন তাঁর কানে মধুবর্ষণ করে এবং তাঁর অভিভাবক সুধীসমাজ খুশি হতে পারেনি। হাসিনা সরকারের পররাষ্ট্রনীতির একটা বড় সাফল্য এই যে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি আমেরিকার চিরাচরিত বৈরিতার নীতি দূর করে একটা পারস্পরিক সমঝোতায় পৌঁছতে পেরেছে। ড. ইউনূস যে এখন লম্বা লম্বা কথা বলতে পারছেন না, সেটাও তার একটা কারণ।
রোহিঙ্গা সমস্যায় বাংলাদেশের নীতির প্রতি আমেরিকার সমর্থন আদায়ে হাসিনা সরকার সক্ষম হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি সেক্রেটারি স্টিফেন বিগান বলেছেন, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর যে নৃশংস নিপীড়ন চালানো হচ্ছে, এই সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তারা সহমত পোষণ করে। এই নৃশংসতার নিন্দা আমেরিকা জানায়। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও আশ্রয় দান করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের তিনি প্রশংসা করে বলেন, এই নিরাপত্তা বিধান ও আশ্রয় দান অবশ্যই মিয়ানমারের দায়িত্ব। তবে এই নৃশংসতাকে জেনোসাইড বলা যাবে কি না তা আইনি বিষয় বলে প্রসঙ্গটি তিনি এড়িয়ে যান। অন্যদিকে এ ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর চীন কেন চাপ সৃষ্টি করছে না, এই বলে চীনের ওপর রোহিঙ্গা সমস্যাটি সমাধানের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার চিরাচরিত মার্কিন কূটনীতির অনুসরণ করেছেন।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকার দেশগুলোকে আরো কাজ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে চীনের ভূমিকাকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন বিগান। বলেছেন, রোহিঙ্গাদের যে ধরনের নৃশংসতার শিকার হতে হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রতি এ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ দমনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের দায়িত্ব কী তা বলার ব্যাপারে নীরব রয়েছেন। তবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দানের ব্যাপারে শেখ হাসিনার ‘মহানুভবতা’কে ঢাকা সফরকালে ধন্যবাদ জানানোর সুযোগ পেয়ে আনন্দিত হওয়ার কথা বলেছেন।
বাংলাদেশ ও ভারত—দুই দেশকেই আমেরিকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করে, বিশেষ করে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিগান বলেছেন, তিনি বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, নিরাপত্তাসহ অনেক ইস্যুতে ঢাকা সফরের সময় আলোচনা করেছেন। কোয়াড (ভারত, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের জোট) সম্প্রসারণ এবং তাতে দক্ষিণ কোরিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে কি না এই প্রশ্নের জবাবে বিগান খোলাখুলি বলেছেন, তিনি ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় বাংলাদেশসহ আরো কয়েকটি দেশকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। সম্ভবত এ কথা দ্বারা তিনি ‘কোয়াডে’ বাংলাদেশসহ আরো কয়েকটি দেশকে যে তারা অন্তর্ভুক্ত করতে চায়, সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন।
আমি এ সম্পর্কে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ওপর আমেরিকার কোনো চাপ আছে কি না। তিনি বললেন, এই মুহূর্তে কেন, বাংলাদেশের ওপর আমেরিকার নানা ধরনের চাপ সব সময়ই বহমান। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুজনই এই চাপ সম্পর্কে অবহিত ও সতর্ক। আমেরিকার ইচ্ছা, আমাদের নিরাপত্তা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতি ইত্যাদিতে সহযোগিতা দানের নামে বাংলাদেশকে কোনো ধরনের সামরিক অথবা অসামরিক জোটে জড়িয়ে ফেলা। প্রধানমন্ত্রী এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সতর্ক। তিনি আমেরিকার সঙ্গে সর্বোচ্চ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে দেশের সর্বপ্রকার উন্নয়নকাজে আমেরিকার সাহায্য ও সহযোগিতা চান। কিন্তু কোনো ধরনের জোটে জড়াতে চান না। এ ব্যাপারে তাঁর কূটনীতি এখন পর্যন্ত সফল।
আমার ধারণা, বাংলাদেশের একটি সুধীসমাজ আশা করেছিল, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ও সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং জোট-রাজনীতিতে যেতে বাংলাদেশের অনিচ্ছা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনা আমেরিকা ও ভারত দুই দেশেরই বন্ধুত্ব হারাবেন এবং তারা হাসিনা সরকারের পাশ থেকে সরে দাঁড়াবে। তাদের সেই আশাটি পূর্ণ হয়নি। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি সেক্রেটারি স্পষ্টই বলেছেন, গণতন্ত্র চর্চার জন্য বিশ্বের যে অঞ্চলটির খ্যাতি নেই, সেই অঞ্চলের দেশ হয়েও বাংলাদেশের উন্নতি, অগ্রগতি প্রশংসনীয়। কথায় বলে, ‘ঢাকের আওয়াজ থামলেই মিষ্টি।’ আমাদের সুধীসমাজের প্রচারণা, তথাকথিত নিরপেক্ষ পত্রিকাগুলোর কৌশলী প্রচারকার্য যে জনসাধারণের কানে মিষ্টি আওয়াজ দিচ্ছে না এবং তারা তা বিশ্বাসও করছে না—এই বোধটা সুধীসমাজের মধ্যে ফিরে এলেই দেশ বাঁচবে, তারাও বাঁচবে।
লন্ডন, সোমবার, ২৬ অক্টোবর ২০২০