হেফাজতে ইসলামের সম্মেলনের আগে সংবাদ সম্মেলন করে প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর অনুসারী একদল দাবি করেছেন, সংগঠটির নেতৃত্বে জামায়াত-বিএনপি সমর্থকদের আনার তোড়জোড় চলছে। আজ শনিবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন আহমদ শফীর ছোট শ্যালক মো. মঈন উদ্দিন।
এসময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহী। উপস্থিত ছিলেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির ছয় সদস্য এবং আহমদ শফীর নাতি মাওলানা কায়সার।
সংবাদ সম্মেলনে আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানি উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও ‘হত্যার হুমকি’ পেয়ে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানানো হয়। এসময় কাউন্সিল না করার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি আহমদ শফীর মৃত্যুকে ‘পরিকল্পিত হত্যা’ আখ্যায়িত করে তার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিও জানানো হয়।
আহমদ শফীর মৃত্যুর পর আগামীকাল রোববার হেফাজতের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছে। হেফাজত মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরীর অনুসারীদের তৎপরতায় অনুষ্ঠেয় ওই সম্মেলনে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ পাননি বলে শফী সমর্থকদের অভিযোগ।
মঈন উদ্দিন বলেন, কাউন্সিলের মাধ্যমে হুজুরের হাতে গড়া অরাজনৈতিক কওমী সংগঠনকে পরিকল্পিতভাবে জামায়াত-শিবির, বিএনপির হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
আহমদ শফীর পরিবারের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, হযরতের হত্যার বিচারের পূর্বে কোনো কাউন্সিল না করার জন্য হেফাজতে ইসলামের সকল দায়িত্বশীলদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।
এক প্রশ্নের জবাবে মঈনুদ্দীন রুহী বলেন, এটা দিনের মতো পরিষ্কার, জামায়াত-শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এই কাউন্সিল। তাদের চলাফেরা দেখেই এটা প্রতীয়মান। কিছু সংখ্যক উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। আজ যারা কাউন্সিল করছে তাদের কারও কারও ছবি দেখা গেছে তাদের (জামায়াত) সাথে। অনুরোধ করছি, আপনারা মূলধারায় ফিরে আসুন। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। ১৫ নভেম্বরের পর সিনিয়রদের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেব।
শাপলা চত্বরের সেই সমাবেশে জামায়াত সঙ্গে ছিল কি না- এ প্রশ্নের জবাবে মঈনুদ্দীন রুহী বলেন, জামায়াতকে নিয়ে আমরা মাঠে কখনও প্রোগ্রাম করিনি। শাপলা চত্বরে জামায়াত বা বিএনপিকে ডাকিনি। কওমী অঙ্গন এবং আহমদ শফী জামায়াত-শিবির এবং মওদুদীবাদের বিরুদ্ধে। জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা যদি হেফাজতের অজ্ঞাতে কোনো কর্মসূচিতে ঢুকে পড়েন… কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে আমরা ছিলাম না। আমরা রাজনীতির সিঁড়ি নই। কাউকে ক্ষমতা থেকে নামাতে বা কাউকে বসাতে আমরা নই।
একপক্ষের সম্মেলন আয়োজনের মধ্যে আরেক পক্ষের হেফাজতের সংবাদ সম্মেলন করা কি সংগঠনে বিভক্তির প্রকাশ- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, আল্লামা আহমদ শফী হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা। যারা উনার মতাদর্শে থাকবে তারাই আসল হেফাজতে ইসলাম।
শফী ‘পরিকল্পিত হত্যার’ শিকার
লিখিত বক্তব্যে মঈন উদ্দিন বলেন, শাহ আহমদ শফী স্বাধীনতার পক্ষে থাকায় তার উপরে বহুবার আঘাত এসেছে। তিনি প্রকাশ্যে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বক্তব্য ও বই লেখায় তার প্রতি জামায়াত-শিবিরের ক্ষোভ ছিল দীর্ঘদিনের। শাপলা চত্বরে জামায়াত-শিবির ও বিএনপির ফাঁদে পা না দেওয়ায় তখন থেকেই শফী হুজুরকে দুনিয়া থেকে বিদার করার জন্য ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাতে।
তিনি বলেন, ১৬ সেপ্টেম্বর কিছু ছাত্রকে উসকে দিয়ে মাদ্রাসায় জামায়াত-শিবিরের লেলিয়ে দেওয়া ক্যাডার বাহিনীকে ব্যবহার করে মাদ্রাসাকে অবরুদ্ধ করা হয়। হুজুরের ছাত্র ও অত্যন্ত পছন্দের জুনাইদ বাবুনগরী মাদ্রাসায় অবস্থান করে মীর ইদ্রিস, নাছির উদ্দিন মুনীর, মুফতি হারুন ইজাহার, ইনআমুল হাসান গংদের দিয়ে একের পর এক মাদ্রাসার তহবিল লুটতরাজ ও ভাংচুর করে। দুর্বৃত্তরা হজরতের খাস কামরায় প্রবেশ করে ভাংচুর, লুটতরাজ, গালিগালাজ, হুমকি ধমকি ও নির্যাতন চালায়।
আহমদ শফীকে হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালকের পদ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল দাবি করে মঈন উদ্দিন বলেন, এতে তিনি ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় হজরতের অক্সিজেন লাইন বারবার খুলে দেওয়ায় তিনি মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং কোমায় চলে যান। অনেক কষ্ট করে চিকিৎসার জন্য বের করা হলেও রাস্তায় পরিকল্পিতভাবে অ্যাম্বুলেন্স আটকিয়ে সময়ক্ষেপণ করে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।
আহমদ শফীর শ্যালক মঈন উদ্দিন বলেন, আল্লামা শাহ আহমদ শফী হুজুর জামায়াত-শিবিরের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি- আল্লামা শাহ আহমদ শফী আপনাকে মেয়ের মতো মহব্বত করতেন। জামায়াত-শিবিরের যে সকল প্রেতাত্মারা হাটহাজারী মাদ্রাসায় অবস্থান করে হুজুরকে হত্যা করেছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করে তাদের অবিলম্বে বিচারের মুখোমুখি করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
এই কাউন্সিল ‘অবৈধ’
প্রশ্নের জবাবে মঈনুদ্দীন রুহী বলেন, হেফাজতে ইসলামের বর্তমানে কোনো শুরা কমিটি নেই। ২০১৪ সালে প্রস্তাব হয়েছিল। কিন্তু শফী হুজুর বলেছিলেন শুরা করলে সারাদেশের আলেমদের নিয়ে করতে হবে। হেফাজতে ইসলাম এত বড় দেশব্যাপী সংগঠন যে তাহলে হাজার খানেক সদস্য হবে শুরার। তাই শুরা কমিটি হয়নি।
তিনি বলেন, নিজেরা আমির হওয়ার জন্য এ্ই শুরা কমিটির কথা বলা হচ্ছে। আমাদের গঠনতন্ত্র অনুসারে আমিরের অবর্তমানে সিনিয়র নায়েবে আমির ভারপ্রাপ্ত হবেন। কেন্দ্রীয় কমিটি ও নির্বাহী কমিটির মতামতের ভিত্তিতে আমির নির্বাচন হবে। কেন্দ্রীয় ও নির্বাহী কমিটির এখন পর্যন্ত কোনো সভা হয়নি। মহাসচিব নিজেই কাউন্সিলের ডাক দিয়েছেন।
রোববার সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেলে যাবেন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে মঈনুদ্দীন রুহী বলেন, কাউন্সিলে যিনি সভাপতিত্ব করবেন (মহিবুল্লাহ বাবুনগরী) তিনি আগেই পদত্যাগ করেছেন। এরপর আর হেফাজতে ফিরে আসেননি। তাই এই কাউন্সিল অবৈধ। সাতজন যুগ্ম মহাসচিবের মধ্যে পাঁচজন আমন্ত্রণ পাননি। ৩৫ জন নায়েবে আমিরের মধ্যে ২৩ জন এখনও দাওয়াত পাননি। এবং তারা যেন আসতে না পারেন পরিকল্পিতভাবে সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে মাওলানা সারওয়ার, আশরাফ উদ্দিন, আতিক মোহাম্মদ, মো. কাসেম, শামসুল হক ও ওসমান কাসেমী উপস্থিত ছিলেন।