জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার সঙ্গে জড়িত নেপথ্যে থাকা সকলকে চিহ্নিত করতে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। রোববার রাতে জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মময় ও বর্ণাঢ্য জীবনের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা এই দাবি জানান।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এই আলোচনায় আরো অংশ নেন কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী, চীফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী, সরকারী দলের ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক, অধ্যাপক আলী আশরাফ, ওয়াসিকা আয়েশা খান মুহাম্মদ শফিকুর রহমান এবং বিরোধী দলীয় উপনেতা জি এম কাদের ও জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী দেশ ও জনগণের জন্য বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের অবদানের কথা তুলে ধরে বলেন, সামরিক শাসন আমলে প্রবর্তিত ফাস্ট লেডি না হয়েও বঙ্গমাতা আজীবন কাজ করেছেন। যুদ্ধে নির্যাতিত দুই লক্ষ মা বোনের পূনর্বাসনে নিরবে-নিভৃতে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রামে নানা ভাবে প্রেরণা জুগিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, সোনার বাংলা গড়ার কাঠামো তৈরি করে গিয়েছিলেন। তাঁর যোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা সেই স্বপ্নের সাধ পাচ্ছি। ‘হেনরি কিস্ঞ্জিারের তলাবিহীন ঝুড়ি’ আর বাংলাদেশ নেই। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কাজ চলছে। বঙ্গবন্ধু আজ নেই কিন্তু তাঁর প্রতিচ্ছবি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা বিশ্বে উন্নয়নের মডেল হিসেবে সফলতা লাভ করছি। তার নেতৃত্বে দ্রুতই দেশ উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌছাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের একটিই মাত্র লক্ষ্য ছিল, তা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। পাকিস্তানীরা চেয়েছিলো চিরদিন শোষণ-বৈষম্যের শৃঙ্খলে বাঙ্গালীকে বন্দী রাখবে। কিন্তু বাঙালি জাতিকে শোষণ-বঞ্চণা, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতেই ছিলেন আপোষহীন। পাকিস্তানের শুরুতে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমি কখনো পূর্বপাকিস্তান বলবো না’। এরপর তিনি লড়াই শুরু করেছিলেন। তিনি বছরের পর বছর কারাগারে থেকে নির্যাতন সহ্য করেছেন বঙ্গবন্ধু। সর্বশেষ দেশকে স্বাধীন করেছেন। তিনি আরো বলেন, স্বাধীন দেশে তারা পাকিস্তানী কায়দায় দেশ চালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ চলেছেন। বঙ্গবন্ধুর অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। পৃথিবীর হাতে গোণা কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে শেখ হাসিনা স্থান করে নিয়েছেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য প্রধানমন্ত্রী চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ রাজনৈতিক আদর্শ যাচাই না করে অনেককে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে বলেন, আজকে এত সমর্থন আওয়ামী লীগের। সবখানে আওয়ামী লীগ। আমাদের ভয় লাগে। কোথায় কাকে রাখতেছেনে। তাদের হিসাব করছেন? এই ছেলেটি কখনো ছাত্রলীগ করেছে, একদিন জয়বাংলার শ্লোগান দিয়েছে। তার বাবা-দাদা আওয়ামী লীগ করছেন? আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান? তদ্বিরে যাকে-তাকে কী পয়েন্টে বসিয়ে দিচ্ছেন!
পনের আগস্ট নিহত হওয়ার সাড়ে চার ঘন্টা আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছিল উল্লেখ করে ফিরোজ রশীদ বলেন, মনি ভাইয়ের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সেদিন আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। রাত সাড়ে ১১টায় আমাদের ডাকলেন। চারদিকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমাদের একটি কথা মাত্র বলেছিলেন, ‘তোমাদের সতর্ক থাকতে হবে। তোমাদের যুবলীগের একটি ছেলেও যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আমি বহিস্কার করে দেবো।’ এরপর মনি ভাইয়ের সাথে কথা বললেন। আমরা নীচে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মনি ভাই নিচে নেমে চলে গেলেন। একটা কথাও বললেননি। মুখটা মলিন ছিলো। কী ষড়যন্ত্র ছিলো? যেটা বঙ্গবন্ধু মনি ভাইকে বললেন। আর পরদিন.. আমরা জানতে পারতাম যদি বেঁচে থাকতেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার নেপথ্যের ঘটনায় কমিশন গঠনের কথা বলে তিনি বলেন, আজ পর্যন্ত আপনারা একটি কমিশন গঠন করতে করলেন না। যারা আত্ম-স্বীকৃতি খুনি তাদের বিচার করতে পারছি। কিন্তু এর পেছনে কী ছিলো?
সংসদীয় গণতন্ত্রে বঙ্গবন্ধু এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন বলে উল্লেখ করেন চীফ হুইপ নূর ই আলম চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু খুব স্বল্প সময়ে অত্যান্ত দক্ষতা ও দূরদর্শীতা পরিচয় দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর দ্রুত স্বীকৃতি আদায় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভূক্ত করতে সচেষ্ট হন। তিনি খুবই স্বল্প সময়ে একটি সংবিধান উপহার দিয়েছেন। কোন রকম বাড়তি ট্যাক্স আরোপ না করে একটি নতুন বাজেট প্রণয়ন করেন। সুনির্দ্দিষ্ট উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা করে তার বাস্তবায়ন শুরু করেন।
সরকারী দলের শফিকুর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধু শুধু, রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, তিনি সাংবাদিকও ছিলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিলো। মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিকদের অবদানের কথা সময় তুলে ধরতেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের জমিটি তিনিই দিয়েছিলেন। এখন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে ২০তলা আধুনিক ভবন করার ঘোষণা দিয়েছেন। দ্রুতই সেই প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়ন হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে সাংবাদিকদের জন্য একটি আইন করেছিলেন। সেই আইনের বলেই ওয়েজ বোর্ড হয়েছে। কয়েকবার ওয়েজ বোর্ড হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কোভিড আসার আগ থেকে সাংবাদিকদের জন্য তিনি কল্যাণ তহবিল করেছেন। কল্যাণ তহবিলের অর্থ কমপক্ষে ৩০ কোটি কম হবে না। তাছাড়া প্রত্যেক দুস্থ সাংবাদিকদের জন্য নগদ টাকাও দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর মতোই সাংবাদিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।