বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে বিশ্ব গত সোমবার করোনা সংক্রমণের ৪৬তম সপ্তাহ পার করেছে। তবে বাংলাদেশে এই সংক্রমণের কাল পার করেছে ৩৯ সপ্তাহ। গত ৮ নভেম্বর সংক্রমণের আট মাস পূর্ণ হয়।
অন্যদিকে দেশে মৃত্যু শুরু হওয়ার পর আজ বুধবার আট মাস পূর্ণ হচ্ছে। এর মধ্যে দেশে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ছিল জুন মাসে আর সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিল জুন-জুলাই মাসে। এর আগে-পরে আক্রান্ত ও মৃত্যু—দুটি সূচকই ওঠানামা করেছে।
এর মধ্যে সংক্রমণ আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলেও অক্টোবরের প্রথম দিক থেকে আবার কখনো ধীরে, কখনো হঠাৎ লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। মৃত্যুর ক্ষেত্রেও একই ধরন। ফলে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে দুর্বোধ্য অবস্থায় পড়েছেন দেশের বিশেষজ্ঞরা।
অন্য দেশগুলোর সঙ্গে কোনো সূচকেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি ঠিকঠাক মিলছে না। বিশেষ করে দৈনিক শনাক্ত ৫ শতাংশের নিচে নামানোর টার্গেট নেওয়া হলেও বাংলাদেশ ১০ শতাংশের নিচে যেতে পারেনি। বরং এখন অনেকটা মাঝপথ থেকেই ঘুরে আবার ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে।
সর্বশেষ এক সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে। মৃত্যু গত কয়েক দিন কিছুটা কম থাকলেও গতকাল হঠাৎ করেই আবার লাফিয়ে বেড়ে ফিরে গেছে প্রায় দুই মাস আগের চেহারায়। অর্থাৎ গত ২১ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর তথ্য জানানো হয় ৪০ জনের।
এরপর গতকাল আবার তা ৩৯ জনে ওঠে। মাঝের দিনগুলো মৃত্যু ছিল এর নিচে। এর মধ্যে ১২ অক্টোবরের পর এক দিনের জন্যও মৃত্যু ৩০-এর ওপরে ওঠেনি, যা ছাড়িয়েছে গতকাল।
ইউরোপে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকেও দেশের সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছিল। এখন ওই আশঙ্কা সত্যের দিকে যাচ্ছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট—আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, সংক্রমণ এখন বৃদ্ধির দিকে। অনেক দিন দৈনিক সংক্রমণ হার ১০-১২ শতাংশের মধ্যে
থেকে তা এখন আবার ১২-১৪ শতাংশের মধ্যে ঘুরছে। এটা যদি ১৫-২০ শতাংশে উঠে চার সপ্তাহ এর মধ্যেই অবস্থান করে বা আরো ওপরে যায়, তবে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারব, দ্বিতীয় ঢেউয়ে পড়েছি। কিন্তু এখনো যেহেতু ওঠানামা করছে, তাই সেটি বলার উপায় নেই।
অন্যদিকে, মৃত্যু যেমন গত কয়েক দিন কম ছিল আবার এক দিন হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। এই এক দিনের বৃদ্ধি দিয়ে পরিস্থিতি বিবেচনার সুযোগ নেই। এটা বিভিন্ন কারণেই হতে পারে। তবে যদি সামনে আরো এমন ঊর্ধ্বমুখী মৃত্যু চলতে থাকে, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে।
এদিকে আজ দেশে সংক্রমণে মৃত্যুর আট মাসের মাথায় এসে গতকাল পর্যন্ত সরকারি হিসাবে মোট শনাক্ত দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৩৬ হাজার ৬৮৪ জনে। এর মধ্যে মারা গেছে ছয় হাজার ২৫৪ জন। মাসওয়ারি গড় করলে মৃত্যু হয় ৭৮২ জনের আর দিনে ২৬ জনের।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গতকাল পর্যন্ত এক মাসে দেশে মারা গেছে ৬০৪ জন। আর এই এক মাসে শনাক্ত হয়েছে ৪৮ হাজার ১৪৫ জন। এর আগে ১৮ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছে ৮৪ জন, ১৮ এপ্রিল থেকে ১৮ মে পর্যন্ত মারা গেছে ২৬৫ জন, ১৮ মে থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত মৃত্যু হয় ৯৯৪ জনের। ১৮ জুন থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত মারা যায় সর্বোচ্চ এক হাজার ২৩৮ জন, ১৮ জুলাই থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত মারা যায় এক হাজার ১৫৯ জন, ১৮ আগস্ট থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক হাজার ১১৯ জন এবং ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত মারা গেছে ৮০১ জন।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এক মাস ধরে মৃত্যু কম থাকলেও এক সপ্তাহে কিন্তু বাড়ছে। আর সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যু বাড়বে—এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য আমরা বারবার বলছি, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা বয়স্ক এবং আগে থেকে বিভিন্ন রোগের জটিলতায় আক্রান্ত তাঁরা যেন বাড়িতে না থাকেন। তাঁদের হাসপাতালে যাওয়া জরুরি। এমন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী বাড়িতে থাকলে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়বে।
অন্যদিকে দেশে প্রথম শনাক্ত থেকে শুরু করে মাসওয়ারি হিসাবে প্রথম মাসে শনাক্ত ছিল ২১৮ জন, দ্বিতীয় মাসে শনাক্ত হয় ১২ হাজার ৯১৬ জন, তৃতীয় মাসে শনাক্ত হয় ৫৫ হাজার ৩৭৪ জন, চতুর্থ মাসে শনাক্ত হয় এক লাখ ১৩৭ জন, পঞ্চম মাসে ৮৩ হাজার ৯৫৭ জন, ষষ্ঠ মাসে ৪৫ হাজার ৩৪১ জন এবং সপ্তম মাসে ৪৪ হাজার ৩৬৮ জন।
এদিকে সুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম মাসে হয় ১৬৫ জন, দ্বিতীয় মাসে এক হাজার ৯৬৬ জন, তৃতীয় মাসে ১২ হাজার ৪৫৯ জন, চতুর্থ মাসে ৬৩ হাজার ৫৪২ জন, পঞ্চম মাসে ৬৭ হাজার ৪৮২ জন, ষষ্ঠ মাসে শনাক্ত ছিল ৭৪ হাজার ৮৫৭ জন, সপ্তম মাসে ৭৮ হাজার ৯৮৯ জন এবং অষ্টম মাসে সুস্থ হয়েছে ৪৮ হাজার ২৩৩ জন (৮ নভেম্বর পর্যন্ত)। ৯ নভেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত আরো ১৩ হাজার ১২৭ জন সুস্থ হয়েছে।
গতকাল মৃত্যুর সংখ্যা ৩৯ হওয়ার কারণ জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দেশে উত্তরাঞ্চলে মৃত্যু কিছুটা বেড়েছে। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টায় অন্যান্য এলাকাসহ যেখানেই করোনায় মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে, আমরা সেই তথ্য প্রকাশ করেছি।’
এই কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুসারে ২৪ ঘণ্টার হিসাবে শনাক্ত হার ১৩.৮৩ শতাংশে উঠেছে গতকাল। মোট শনাক্ত হার ১৬.৯৭ শতাংশ। সুস্থতার হার ৮০.৮১ শতাংশ এবং মৃত্যু হার ১.৪৩ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির তথ্য বলছে, ২৪ ঘণ্টায় নতুন শনাক্ত দুই হাজার ২১২ জন এবং সুস্থ হয়েছে এক হাজার ৭৪৯ জন। ২৪ ঘণ্টায় মৃত ৩৯ জনের মধ্যে পুরুষ ৩০ জন এবং নারী ৯ জন। বয়স হিসাবে মৃত্যু ১১-২০ বছরের মধ্যে একজন, ২১-৩০ বছরের একজন, ৩১-৪০ বছরের একজন, ৪১-৫০ বছরের দুজন এবং বাকি ৩৪ জন বা ৮৮ শতাংশই ৫১ বছরের বেশি। মৃত ব্যক্তিদের ২২ জন ঢাকা বিভাগের, পাঁচজন চট্টগ্রামের, তিনজন রাজশাহীর, দুজন করে বরিশাল ও সিলেটের এবং পাঁচজন রংপুরের।