বাঙালির ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আর এ স্বাধীনতা অর্জনের মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিটি সংগ্রামে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে তিনি জাতিকে দেখিয়েছেন মুক্তির প্রকৃত পথ। রক্তচুষা পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শোষণের প্রায় ২৩ বছর তিনি বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য আপোসহীনভাবে লড়াই সংগ্রাম করেছেন। বছরের পর বছর কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দিজীবন কাটিয়েছেন—তবুও বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রশ্নে আপোস করেননি। অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতার মোহ কিংবা ফাঁসির রজ্জু কোনো কিছুই তাকে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে ফেরাতে পরেনি।
বাঙালির এ শ্রেষ্ঠ সন্তানের জন্মশতবার্ষিকী (মুজিববর্ষ) নাানা আয়োজনে দেশব্যাপী যথাযথমর্যাদায় পালিত হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ রাজধানী ঢাকায় একটি সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী প্রকাশ্যে সভা করে জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে জাতির পিতার একটি ভাস্কর্য নির্মাণের পরিকল্পনার বিরোধিতা শুরু করে। এমনকি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হলে তা ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার ভয়ানক দম্ভোক্তিও করে। অথচ ভাস্কর্য ও মূর্তির মধ্যে পার্থক্য সবাই জানে। ভাস্কর্য শহরের সৌন্দর্য বর্ধন ও জাতীয় হেরিটেজ রক্ষার জন্য তৈরি করা হয়। মূর্তি বা প্রতিমা তৈরি করা হয় পূজা করার জন্য। পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশেই সেই দেশের জাতীয় নেতা ও বীরদের ভাস্কর্য আছে। ভাস্কর্য নির্মাণের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক বা বিরোধ নেই। হাজার বছরের মুসলিম সভ্যতার দিকে আমরা তাকালেই দেখব ইউরোপ, এশিয়া, আরব এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে ইসলামি সংস্কৃতির নানা উপস্থাপনের মধ্যে ভাস্কর্য অন্যতম প্রধান হিসেবে স্থান করে আছে।
ভাস্কর্য বিরোধিতার পেছনে রয়েছে একটি ধর্মান্ধ অপশক্তি। মূলত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা দ্বারা যখন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি, তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুরা ধর্মের নামে মিথ্যাচার প্রচার করতে হেফাজতিদের মাঠে নামিয়েছে। ধর্মের নামে এধরনের মিথ্যাচার দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই শুরু হয়। ১৯৫৪ সালে যখন যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে নৌকা মার্কা নিয়ে এই বাংলার মানুষ মুসলীম লীগের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে ভোটের যুদ্ধে নেমেছিল সেদিন ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল নৌকা মার্কায় ভোট দিলে বিবি (বউ) তালাক হয়ে যাবে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বলা হয়েছিল আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে দেশে ইসলাম থাকবে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রচার করা হলো—আমাদের জাতীয় পতাকায় সূর্য রয়েছে, এটা বেদাত বা ধর্মবিরোধী। কারণ এই পতাকায় হিন্দুরা পূজা করে, সেই সূর্য রয়েছে। এরপর বলা হলো, মাদরাসায়-স্কুলে জাতীয় সংগীত গাওয়া যাবে না, কারণ এই গান হিন্দু কবির লেখা। তারপর যাত্রা, জারিসারি, নবান্ন, শারদ উৎসব, বসন্ত উৎসবকে হিন্দুর উৎসব আখ্যা দিয়ে তা ধর্মবিরোধী প্রচার করা হয়। এভাবে এরা ভাষা শহীদ মিনার ভাঙার চেষ্টা করেছে। সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সমালোচনা করেছে এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। সবশেষে যুক্ত হলো বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা। সরকার যদি গোড়াতেই শক্ত হতো তাহলে দেশে ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে পরিস্থিতি এতটা জটিল হতো না। ধর্মান্ধদের দাবির প্রেক্ষাপটে ২০০৮ সালে ঢাকা হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে যখন বাউল স্থাপত্যের ভাস্কর্য সরানো হয়, তখনই সমস্যাটির সূত্রপাত। তারপর বিমানের ঢাকা অফিসে বলাকার ভাস্কর্য ভাঙন, হেফাজতিদের দাবি অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে থেকে গ্রিক ভাস্কর্য অপসারণই ধোলাইখাল এলাকায় জাতির পিতার ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতায় রসদ জুগিয়েছে।
আমরা মনে করি, স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতিকে হেয়-অপমান করার এ ধরনের দুঃসাহস শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয় বাংলাদেশকে অস্বীকার করা; বাঙালি জাতিসত্তা ও হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দেশটিকে আফগানিস্তান ও ইরাকের মতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার অপচেষ্টা। কাজেই বিজয়ের মাসে ঐক্যবদ্ধভাবে যথার্থ যুক্তির সাহায্যে স্বাধীনতার শত্রু ও উগ্র ধর্মান্ধ অপশক্তিকে রুখে দিয়ে তাদের স্পর্ধা ও আস্ফাালনের দাঁতভাঙা জবাব দিতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও সাবেক ছাত্রনেতা।