গাজী গ্রুপ চট্টগ্রামের জন্য টার্গেট খুব একটা বড় ছিল না। জেমকন খুলনার করা ১৫৭ রানের জবাবে তাদের প্রয়োজন ছিল টপঅর্ডার ব্যাটসম্যানদের ভালো কোন ইনিংস। কিন্তু তা খেলতে পারেননি লিটন দাস, সৌম্য সরকাররা। তবে পাঁচ নম্বরে নেমে দায়িত্বশীল ব্যাটিং করলেন শামসুর রহমান, সঙ্গ দিয়ে ক্যামিও ইনিংস খেলেন অফস্পিনিং অলরাউন্ডার নাহিদুল ইসলাম। এ দুজনের শেষের ঝড়েই রোমাঞ্চকর জয় পেয়েছে চট্টগ্রাম।
ম্যাচ জেতার জন্য শেষের ১২ বলে ২৫ রান প্রয়োজন ছিল টেবিল টপারদের। শুভাগত হোমের করা ১৯তম ওভারে ২ ছক্কার মারে ১৬ রান নিয়ে নেন নাহিদুল, খেলেন ১০ বলে ১৮ রানের ইনিংস। শেষ ওভারে বাকি থাকা ৯ রান নিতে পুরো ৬টি বলই খেলে চট্টগ্রাম। আলআমিনের করা সেই ওভারের শেষ বলে ডিপ ফাইন লেগ দিয়ে ছক্কা হাঁকিয়ে দলের জয় নিশ্চিত করেন ৩০ বলে ৪৫ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলা শামসুর।
এই ম্যাচ হারলেও পয়েন্ট টেবিলের দ্বিতীয় স্থান থেকে নামতে হয়নি খুলনাকে। সাত ম্যাচে ৪ জয় নিয়ে এখনও তারা রয়েছে দুই নম্বরেই। অন্যদিকে ছয় ম্যাচে পঞ্চম জয় পাওয়া চট্টগ্রাম সুসংহত করেছে নিজেদের শীর্ষস্থান। তবে দুই দলই পেয়ে গেছে প্লে অফের টিকিট।
প্রচণ্ড কুয়াশার মাঝে ১৫৮ রান তাড়া করতে নেমে দ্বিতীয় ওভারেই প্রথম ধাক্কা খায় চট্টগ্রাম। মাশরাফি বিন মর্তুজার করা প্রথম ওভারে ৬ রান নেয়ার পর, সাকিব আল হাসানের করা প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকানোর চেষ্টায় এগিয়ে শট করেন লিটন দাস।কিন্তু ব্যাটে-বলে হয়নি, বল উঠে যায় আকাশে। মিড অন থেকে পেছনে দৌড়ে দারুণ ক্যাচ লুফে নেন অতিরিক্ত ফিল্ডার রিশাদ হোসেন। লিটনের ব্যাট থেকে আসে ৪ রান।
তিন নম্বরে নেমে সাকিবের মুখোমুখি প্রথম বলেই চার মেরে দেন মাহমুদুল হাসান জয়। সাকিবের করা পরের ওভারে জোড়া চারের পর উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে লং অন দিয়ে ছক্কা মারেন তিনি। এর আগের ওভারে মাশরাফির বোলিংয়ে কভার ড্রাইভে দৃষ্টিনন্দন বাউন্ডারি হাঁকান যুব বিশ্বকাপ মাতানো এ ব্যাটসম্যান। তবে ইনিংস বড় করতে পারেননি। শুভাগত হোমের করা পঞ্চম ওভারের শেষ বলে ছক্কা মারতে গিয়ে শেষ হয় জয়ের ১৪ বলে ২৪ রানের ইনিংস।
পাওয়ার প্লে’র ৫ ওভারের মধ্যে দুই উইকেট হারিয়ে ফেললেও, শেষ ওভারে উইকেটে এসে তিনটি চার মারেন চট্টগ্রাম অধিনায়ক মোহাম্মদ মিঠুন। কিন্তু অপরপ্রান্তে একদমই ব্যাটে-বলে করতে পারছিলেন না সৌম্য সরকার। মুখোমুখি ১৮তম বলে মারেন প্রথম বাউন্ডারি। কিন্তু আউট হয়ে যান ২২তম বলে। সাকিবের বলে অনসাইডে খেলতে গিয়ে ধরা পড়েন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের হাতে, রান করেন মাত্র ১৯।
অধিনায়ক মিঠুনও বেশিদূর যেতে পারেননি। হাসান মাহমুদের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে ধরা পড়ার আগে ২১ বলে করেন ২৩ রান। তখনও জয়ের জন্য ৪৯ বলে ৭৮ রান প্রয়োজন ছিল চট্টগ্রামের। পঞ্চম উইকেটে ২৫ রান যোগ করেন শামসুর রহমান ও মোসাদ্দেক সৈকত। তবে সাবলীল ব্যাটিং করতে পারেননি সৈকত। ইনিংসের ১৫তম ও মাশরাফির শেষ ওভারের পঞ্চম বলে ছক্কা হাঁকান ঠিক। কিন্তু পরের বলেই তাকে সোজা বোল্ড করে নিজের প্রথম উইকেট নেন মাশরাফি।
জয়ের জন্য তখন সমীকরণ ৩০ বলে ৫৩ রান। কিন্তু হতাশ করেন জিয়াউর রহমান, ৪ বলে মাত্র ৬ রান করে ফিরে যান সাজঘরে। এরপর পুরো দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন শামসুর রহমান। সমীকরণ যখন ১৮ বলে ৩৭ রান, তখন হাসান মাহমুদের ওভারে জোড়া চারের মারে নিয়ে নেন ১২ রান। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ ১৯তম ওভারটি করেন শুভাগত হোম, সেই ওভারেই ১৬ রান নিয়ে নেন নাহিদুল ইসলাম।
শুভাগতর করা সেই ওভারের প্রথম বলেই আউট হতে পারতেন নাহিদুল। এক্সট্রা কভারে দাঁড়িয়ে তার ক্যাচ ছেড়ে দেন মাহমুদউল্লাহ। পরে এটিই হয়ে যায় ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। কেননা পরের চার বলে লং অন দিয়ে দুইটি ছক্কা মারেন নাহিদুল। এছাড়া নেন আরও ২ রান। শেষ বলে লংঅফে ধরা পড়লেও সেই ওভারে ১৬ রান তুলে চট্টগ্রামকে এগিয়ে দেন নাহিদুল।
শেষ ওভারের দায়িত্ব বর্তায় আলআমিনের কাঁধে। প্রথম বল ডট করলেও দ্বিতীয় বলেই মোস্তাফিজের কাছে চার হজম করেন তিনি। পরের তিন বলে আসে আরও ৩ রান। ফলে শেষ বলে জয়ের জন্য বাকি থাকে ২ রান। শেষ বলটি ফুলটস করে বসেন আলআমিন, ফাইন লেগ দিয়ে ছক্কা মেরে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন শামসুর রহমান। তিনি অপরাজিত থাকেন ৫ চার ও ২ ছয়ের মারে ৩০ বলে ৪৫ রান করে।
এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে সমর্থকদের দারুণ এক দৃশ্য উপভোগের সুযোগ করে দিয়েছিল খুলনা। তিন নম্বরে সাকিব আল হাসান নামার পর, চার নম্বরেই ব্যাটিংয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় মাশরাফি বিন মর্তুজাকে। অবশ্য একসঙ্গে তিন বলের বেশি ব্যাটিং করা হয়নি খুলনা দলের সবচেয়ে বড় দুই তারকার। দুর্ভাগ্যজনক রানআউট হন মাশরাফি। পরে ইনিংস বড় করতে পারেননি সাকিবও।
মিনিস্টার গ্রুপ রাজশাহীর বিপক্ষে আগের ম্যাচ উদ্বোধনী জুটিতে ভালো করেছিলেন জাকির হাসান ও জহুরুল ইসলাম অমি। আজও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ভাল কিছুর। কিন্তু পঞ্চম ওভারে দারুণ এক বাউন্সারে ফর্মে থাকা জাকিরকে ফিরিয়ে দেন তরুণ বাঁহাতি পেসার শরীফুল ইসলাম। নিজের পরের ওভারে আরেক ওপেনার জহুরুলেরও উইকেট নেন শরীফুল। জহুরুল ১৯ বলে ২৬ ও জাকির করেন ১৫ বলে ১৫ রান।
সপ্তম ওভারের শেষ বলে জহুরুল ফেরার পরই চার নম্বরে আসেন মাশরাফি। রাকিবুল হাসানের করা অষ্টম ওভারের প্রথম বলে সিঙ্গেল নিয়ে খোলেন রানের খাতা। কিন্তু এক বল পর হন রানআউট। রাকিবুলের করা অফস্ট্যাম্পের বাইরের ডেলিভারিতে সজোরে স্ট্রেইট ড্রাইভ করেছিলেন স্ট্রাইকে থাকা সাকিব। যা রাকিবুলের হাতে লেগে আঘাত হানে ননস্ট্রাইকের স্ট্যাম্পে। তখন আবার উইকেটের বাইরে দাঁড়িয়ে মাশরাফি। ফলে বিদায়ঘণ্টা বাজে তার ১ বলে ১ রানের ইনিংসের।
সাকিব-মাশরাফির জুটি যেমন জমেনি, তেমনি জমেনি সাকিব, মাহমুদউল্লাহ ও ইমরুল কায়েসদের ব্যাটিং। শরীফুলের বোলিংয়ে পুল করে ফাইন লেগ দিয়ে একটি ছক্কা মারলেও, ১৬ বল খেলে ১৫ রানের বেশি করতে পারেননি সাকিব। পরে নিজের দ্বিতীয় রান নেয়ার পথে চতুর্থ বাংলাদেশি হিসেবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৪ হাজার রানের মাইলফলকে প্রবেশ করেন মাহমুদউল্লাহ। তার ব্যাটে ছিল বড় কিছু করার প্রতিশ্রুতি।
কিন্তু আউট হন শরীফুলের বুদ্ধিদীপ্ত এক স্লোয়ারে। উইকেট ছেড়ে খেলতে চেষ্টা করেছিলেন মাহমুদউল্লাহ, তা বুঝতে পেরে স্লোয়ার ইয়র্কার করেন শরীফুল। ব্যাটে লাগলেও বোল্ড হন মাহমুদউল্লাহ। তার ব্যাট থেকে আসে ১৭ বলে ২৬ রান। এর আগে মোস্তাফিজুর রহমানের বলে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরে যান ২৩ বলে ২৪ রান করা ইমরুল। হতাশ করেন আরিফুল হক (৯ বলে ৬) ও শামীম পাটোয়ারি (৬ বলে ৫)।
যখন অল্পেই থেমে যাওয়ার শঙ্কা খুলনার ইনিংসে। তখন একা হাতেই দলকে লড়াকু সংগ্রহ এনে দেন শুভাগত হোম। বিশেষ করে মোস্তাফিজের করা শেষ ওভারে ২ চারের সঙ্গে ১ ছয়ের মারে ১৪ রান নিয়ে খুলনাকে ১৫৭ রানে পৌঁছে দিয়েছেন শুভাগত। শেষপর্যন্ত মাত্র ১৪ বলে ৬ চার ও ১ ছয়ের ৩২ রানে অপরাজিত থেকে গেছেন নয় নম্বরে নামা এ ব্যাটসম্যান।
চট্টগ্রামের পক্ষে বল হাতে ৩ উইকেট নিয়েছেন শরীফুল। মোস্তাফিজ নিয়েছেন ২টি উইকেট।