মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিপর্যস্ত বিশ্ববাসী। প্রতিদিনই বাড়ছে সংক্রমণের হার। এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশের মতো ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে ভ্যাকসিন কিনতে ইতোমধ্যে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। চুক্তির আওতায় প্রথম ধাপে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বা টিকা কিনে জনগণের মাঝে বিনামূল্যে দেয়া হবে। এই ভ্যাকসিন কিনতে মোট প্রস্তাবিত খরচের অর্ধেক টাকা ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে বরাদ্দ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের তৈরি এ টিকার ভারতীয় উৎপাদক সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত ৫ নভেম্বর চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে অক্সফোর্ডের তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে সিরাম ইনস্টিটিউট।
জানা যায়, সিরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত ভ্যাকসিনের পরিবহন ব্যয়সহ প্রতি ডোজের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৫ মার্কিন ডলার। ভ্যাকসিনের আনুষঙ্গিক উপকরণের জন্য ব্যয় ১ দশমিক ২৫ ডলার ধার্য করা হয়। এতে প্রতি ডোজ ভ্যাকসিন বাবদ মোট খরচ দাঁড়ায় ৬ ডলার ২৫ সেন্ট। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের নেয়া তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের মোট মূল্য দাঁড়ায় এক হাজার ৫৮৯ কোটি ৪৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
সরকারিভাবে এই ভ্যাকসিন ক্রয়, পরিবহনসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় হিসাবে উল্লিখিত অংকের টাকা বরাদ্দ চায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। তাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ৭৩৫ কোটি ৭৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। যার মধ্যে ভ্যাকসিন কিনতে ৬৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং আনুষঙ্গিক খরচ হিসাবে বাকি ৯৯ কোটি ৯৯ লাখ ৩২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের চাহিদাপত্র পাওয়ার পর গত ৩০ নভেম্বর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান ভ্যাকসিন কেনার বিষয়ে অর্থনৈতিক বিষয়ক সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে সারসংক্ষেপ পাঠান। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে পাঠানো এ সারসংক্ষেপে করোনা ভ্যাকসিন কিনতে সরকারের ব্যয় ও ডোজপ্রতি ভ্যাকসিনের ব্যয় উল্লেখ করা হয়।
পরে গত ২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজনে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করে করোনা ভ্যাকসিন কিনতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রস্তাবের নীতিগত অনুমোদন দেয় অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এরপর স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রস্তাবিত বরাদ্দ থেকে প্রথম ধাপে অর্ধেক বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়।
এরপর অর্থ বিভাগ (বাজেট অনুবিভাগ-১) থেকে অর্থ বরাদ্দের মঞ্জুরি আদেশ জারি করা হয়। এতে বলা হয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে কোভিড-১৯ প্রতিরোধক ভ্যাকসিন ক্রয়ের লক্ষ্যে পরিবহন খরচসহ কোল্ড চেইনে পৌঁছানো পর্যন্ত তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনতে (ওষুধ ও প্রতিষেধক বাবদ) এক হাজার ২৭১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৬৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং কোল্ড চেইন ইকুয়েপমেন্ট, এডি সাইরিংগস বক্সেস ক্রয়, ভ্যাকসিন কেন্দ্র পর্যন্ত পরিবহন, জনবল, মাইক্রোপ্লানিং ও তালিকা প্রণয়ন, সুপারিশ ও মনিটরিং, প্রশিক্ষণ, প্রচার-প্রচারণাসহ মানুষের শরীরে ভ্যাকসিন দেয়া পর্যন্ত খরচ হিসাবে প্রায় ১০০ কোটি টাকাসহ মোট ৭৩৫ কোটি ৭৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা চলতি (২০২০-২১) অর্থবছর অর্থ বিভাগের বাজেটে ‘করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় তহবিল’ থেকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অনুকূলে প্রদানের মঞ্জুরি আদেশ নির্দেশক্রমে জারি করা হলো।
অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত দেয়া হয়েছে। শর্তগুলো হলো- ভ্যাকসিন ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন নিতে হবে; সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটির অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে; অর্থ বিভাগের মতামত গ্রহণপূর্বক ব্যাংক গ্যারান্টি চূড়ান্ত করতে হবে; অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে দ্য পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট-২০০৬ এবং দ্য পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস-২০০৮ অনুসরণসহ যাবতীয় আর্থিক বিধি-বিধান যথাযথভাবে পালন করতে হবে এবং ভ্যাকসিন ক্রয় ও কোল্ড চেইন ইকুয়েপমেন্ট, এডি সাইরিংগস বক্সেস ক্রয় বাবদ ব্যয় সম্পাদনের এক মাসের মধ্যে ব্যয় করা অর্থের সাপেক্ষে যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রত্যয়নসহ বিল-ভাউচার ও ব্যয় প্রতিবেদন অর্থ বিভাগে পাঠাতে হবে।
প্রথম ধাপে খাতভিত্তিক বরাদ্দ
প্রথম ধাপে তিন কোটি ডোজ টিকা জনগণের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ইতোমধ্যে অর্ধেক টাকা বরাদ্দ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। বিভিন্ন খাতে এ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রথম ধাপে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রস্তাবিত করোনা ভ্যাকসিনের ডোজ (ওষুধ ও প্রতিষেধক) বাবদ এক হাজার ২৭১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার বিপরীতে ৬৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আপ্যায়ন ব্যয়ের জন্য প্রস্তাবিত ৮৯ কোটি ৮৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়নি। প্রস্তাবিত হায়ারিং চার্জ ছয় লাখ ৮০ হাজার টাকার পুরোটাই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
প্রচার ও বিজ্ঞাপন ব্যয়ের জন্য প্রস্তাবিত ১৪ কোটি ১৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়নি। ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের জন্য প্রস্তাবিত এক কোটি দুই লাখ টাকার পরিপ্রেক্ষিতেও কোনো টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়নি। ভ্রমণ ব্যয়ের জন্য প্রস্তাবিত ছয় কোটি ৭৬ লাখ ১৯ হাজার টাকার পরিপ্রেক্ষিতেও কোনো বরাদ্দ হয়নি। বরাদ্দ হয়নি স্বাস্থ্য বিধান সামগ্রীর জন্য প্রস্তাবিত তিন কোটি ৩৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকাও।
পণ্যের ভাড়া ও পরিবহন ব্যয়ের প্রস্তাবিত ৯৩ কোটি ৩০ লাখ ৯৮ হাজার টাকার মধ্যে আট কোটি ৯৮ লাখ ৪৪ হাজার টাকা, প্রশিক্ষণ ব্যয়ের জন্য প্রস্তাবিত ১৫ কোটি ১৬ লাখ ৬৮ হাজার টাকার মধ্যে ১২ কোটি ৮০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা, চিকিৎসা ও শল্য চিকিৎসা সরঞ্জামাদি বাবদ প্রস্তাবিত ৫৮ কোটি ৫৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকার বিপরীতে ৫৬ কোটি ৫৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা, মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ের জন্য প্রস্তাবিত ছয় কোটি ২৬ লাখ এক হাজার টাকার পুরোটাই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এছাড়া জরিপের জন্য প্রস্তাবিত ৯৫ লাখ টাকার বিপরীতে কোনো টাকাই বরাদ্দ দেয়া হয়নি। সম্মানী বাবদ প্রস্তাবিত ১০ কোটি চার লাখ ৭৬ হাজার টাকার মধ্যে তিন কোটি ৯৯ লাখ ১৮ হাজার টাকা, প্রকৌশলী এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি বাবদ প্রস্তাবিত ১৩ কোটি ৬৪ লাখ ৭০ হাজার টাকার পুরোটাই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বরাদ্দ হয়েছে ডাটাবেজ বাবদ প্রস্তাবিত তিন কোটি ৬৯ লাখ ৯৪ হাজার টাকার পুরোটাই। তবে চিকিৎসা ব্যয় বাবদ প্রস্তাবিত ২১ লাখ ৫৪ হাজার টাকার বিপরীতে কোনো টাকাই বরাদ্দ দেয়া হয়নি।
ভ্যাকসিন কিনতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনার ভ্যাকসিন কিনতে আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে এক হাজার ৫৮৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়েছিলাম। এরই প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে অর্থ বিভাগ থেকে আমাদের প্রস্তাবের অর্ধেক টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এটি প্রথম ধাপের টাকা। পরে বাকি টাকা দেয়া হবে। এখন আমাদের কাজ শুরু করার জন্যই প্রথম ধাপের এই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এটি দিয়ে আমরা কাজ শুরু করব।’