অবিশ্বাস্য এক স্বপ্ন বাস্তবায়ন করল বাংলাদেশ। প্রমত্তা পদ্মার বুক চিড়ে দক্ষিণবঙ্গের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যে সেতুর স্বপ্ন দেখেছিল আজ তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর টু-এফ নামে ৪১তম স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে সব অপেক্ষার অবসান হয়েছে। স্প্যানটি বসানোর মধ্যে দিয়ে এক সুতোয় মিলেছে পদ্মার দুই পাড়। প্রমত্তা পদ্মা জুড়ে এখন দৃশ্যমান হয়েছে স্বপ্নের সেতুর পুরো কাঠামো।
বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ১১টার দিকে স্প্যানটি বসার সঙ্গে সঙ্গেই মুন্সিগঞ্জের মাওয়া থেকে মাদারীপুরের জাজিরা প্রান্ত পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়েছে পুরো সেতু। ৪০তম স্প্যান বসানোর ছয় দিনের মাথায় বসানো হলো ৪১তম স্প্যানটি। তবে শেষ স্প্যান বসানোর পর পুরো পদ্মা সেতু দৃষ্টিসীমার মধ্যে চলে এলেও সেতুটি চালুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও ১০ মাস থেকে এক বছর।
পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আব্দুল কাদের বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে নয়টার পর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর স্প্যান বসানোর কার্যক্রম শুরু হয়। পুরোপুরি কাজ শেষ হয় সকাল সোয়া ১১টার দিকে। আর এর মধ্যে দিয়ে দৃশ্যমান হয় সেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। স্প্যানটি বসানোর মধ্যে দিয়ে রচিত হয় এক নতুন মাইলফলক।
৪ ডিসেম্বর ৪০তম স্প্যানটি বসানোর পর পদ্ম সেতুর শেষ স্প্যান নিয়ে মানুষজনের আগ্রহের মাত্রা আরও বাড়ে। ওই দিনই জানানো হয়েছিল, শেষ স্প্যান বসবে ১০ বা ১২ ডিসেম্বর। শেষ স্প্যানটি পাঠানোর আগে কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে তৈরি হয় আনন্দঘন মুহূর্ত। স্প্যানটি সাজানো হয় বাংলাদেশ ও চীনের পতাকা দিয়ে। স্প্যানের গায়ে বাংলা, ইংরেজি, চাইনিজ ভাষায় লেখা বিশেষ বার্তায় বলা হয়েছে, ‘বহু বছরের প্রচেষ্টায় দেশি-বিদেশি শ্রম শক্তির মাধ্যমে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের পথে’।
বসানোর জন্য গতকাল বিকালে তিয়ান-ই নামে ভাসমান ক্রেনের মাধ্যমে, মাওয়া কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে পিলারের কাছে নেয়া হয় ৪১তম স্প্যানটি। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে শেষ স্প্যানটি বসানোর কার্যক্রম শুরু করে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীরা। সকালে পজিশনিং, পিলারের উচ্চতায় স্প্যানটিকে তোলা ও বেয়ারিংয়ের ওপর রাখার কার্যক্রম শুরু হয়। প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টার প্রচেষ্টায় সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বসানো হয় স্প্যানটি।
শেষ স্প্যান বসানোর ঐতিহাসিক মুহূর্তটি উদযাপনের বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছিল সেতু বিভাগ। কিন্তু করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে সব কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। আজ অনেকটা অনাড়ম্বরভাবেই স্প্যান তোলার কাজ সম্পন্ন হয়।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোমেন লিমিটেড।
নির্মাণ কাজ শুরুর পর নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ঝড়-ঝঞ্ঝার প্রতিকূলতার মধ্যেও থেমে থাকেনি সেতুর কাজ। নির্মাণ শুরুর তিন বছরের মাথায় ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নং পিয়ারে বসানো হয় প্রথম সুপারস্ট্রাকচার (স্প্যান)।
মূল সেতুর ৪২টি পিয়ারে বসানো হবে ৪১টি স্প্যান এমন পরিকল্পনায় সময়ের সঙ্গে এরপর কর্মযজ্ঞ এগিয়ে চলা। আজ ৪১তম স্প্যানটি বসানোর মধ্যে দিয়ে গত ৩ বছরে সেতুতে সবগুলো স্প্যান বসানো হলো। এসব স্প্যানের মধ্যদিয়ে চলবে রেল আর উপর দিয়ে অন্যান্য যানবাহন।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত সূত্র বলছে, আগামী বছরের ডিসেম্বরে সেতু চালু করতে হলে চলতি মাসের মধ্যে সব স্প্যান বসাতেই হতো। অর্থাৎ শেষ স্প্যানটি বসানোর মাধ্যমে পরিকল্পনামতোই কাজ এগোয়।
জানা গেছে, পদ্মা সেতুর সার্বিক অগ্রগতি সাড়ে ৮২ শতাংশের বেশি। মূল সেতুর কাজের বাস্তবায়ন কাজের অগ্রগতি ৯১ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি ৮৮.৩৮ শতাংশ। মূল সেতুর কাজের চুক্তি মূল্য ১২ হাজার ১৩৩.৩৯ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৭২৩ দশমিক ৬৩ কোট টাকা। নদীশাসন কাজের বাস্তব অগ্রগতি ৭৫.৫০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৬৫.১৭ শতাংশ। নদীশাসন কাজের চুক্তি মূল্য ৮ হাজার ৭০৭.৮১ কোটি টাকা এবং এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৬৭৪.৪৮ কোটি টাকা।