পাঁচ মাসে বিদেশে গেছেন মাত্র ৮ হাজার কর্মী

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিদেশযাত্রা
ফাইল ছবি

মহামারি করোনাভা ইরাসের ধাক্কায় দেশের অভিবাসন খাতে নেমে এসেছে বিপর্যন্ত। লকডাউন তুলে নিয়ে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার ওপর থেকে বিধিনিষেধ শিথিল করার পরও দেখা যাচ্ছে বিদেশে যাওয়া বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা লাখ থেকে হাজারের ঘরে নেমে এসেছে। গত জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে মাত্র ৮০০০ শ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। অন্যান্য বছরগুলোয় এই একই সময়ে লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে যেতো। এই অভিবাসন পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরে যেতে আরও অন্তত কয়েক বছর সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য মতে, করোনা ভাইরাসের কারণে চাকরি হারিয়ে চলতি বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ অভিবাসী কর্মী বাংলাদেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া যারা বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিলেন করোনা ভাইরাসের লকডাউনের মধ্যে তারাও দেশ ছাড়তে পারেননি।

universel cardiac hospital

এমন অবস্থায় আগে যেখানে প্রতিবছর সাত থেকে আট লাখ শ্রমিককে বিদেশে পাঠানো হতো। সেখানে চলতি বছর বিদেশে পাড়ি জমাতে পেরেছে এক লাখ ৯০ হাজারের মতো মানুষ, যাদের ৯৬% গিয়েছে প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার আগে।

এরমধ্যে এপ্রিল-জুন পর্যন্ত লকডাউনের কারণে একজনকেও পাঠানো যায়নি। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশে গিয়েছে মাত্র আট হাজার অভিবাসী।

তবে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি আগের চাইতে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসায় বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে হলেও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। তাই খুব স্বল্প পরিসরে হলেও বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া আবার শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জাহাঙ্গীর আলম।

যুগ্ম সচিব বলেন, ‘মানুষ এখন জীবন জীবিকার জন্য ঘর থেকে বের হতে শুরু করেছে। বিদেশেও শ্রমিক দরকার, আমরাও দিতে চাই। আরব দেশগুলোতে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ সেভাবে আসেনি। তাই এরিমধ্যে অল্প অল্প করে ওই দেশগুলোতে যাওয়া শুরু হয়েছে। সামনে এটা আরও বাড়বে।’

এদিকে মালয়েশিয়ার বাজার যদি খুলে যায় তাহলে আরও বেশিসংখ্যক শ্রমিক পাঠানো সম্ভব হবে বলে তিনি জানান। এরইমধ্যে উজবেকিস্তান, রোমানিয়াসহ নতুন কয়েকটি দেশে শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সেইসঙ্গে বিভিন্ন দেশে করোনা ভাইরাসের টিকা চলে আসায় অভিবাসনের এই গতি সামনের দিনগুলোতে আরও ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করছেন জাহাঙ্গীর আলম।

যুগ্ম সচিব বলেন, ‘ভ্যাকসিন অনেক পজিটিভ একটা পরিবর্তন আনবে। কারণ শ্রমিকরা চাইলে ভ্যাকসিন নিয়ে নিজেদের নিরাপদ প্রমাণ করে বিদেশে যেতে পারবে, আবার ওইসব দেশ শ্রমিকদের ভ্যাকসিন দিয়ে তাদেরকে সেই দেশে কাজে রাখতে পারবে।’

বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে পাড়ি জমান তাদের প্রত্যাশা থাকে দ্রুত ভালো আয় রোজগারের মাধ্যমে নিজের ও পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন করা। এছাড়া ওই দেশগুলোর সামাজিক নিরাপত্তা ও আপদকালীন সুবিধা পাওয়ায় বেশিরভাগই দেশে ফিরতে চান না। বরং বিদেশেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চান।

শেয়ার মার্কেটে ধস এবং ব্যবসায় লোকসান দিয়ে গত সাত বছর আগে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম। তার মতে, দ্রুত ভাগ্য ফেরাতে সেইসঙ্গে দেশের লাখ লাখ টাকার ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের বাইরে স্থায়ী হওয়াই একমাত্র উপায়। দেশ ছাড়ার কয়েক বছরের মাথায় তিনি সব ঋণ পরিশোধ করেন, জীবনে সচ্ছলতাও ফেরে।

তবে করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে গত নয় মাস ধরে বেকার আছেন আশরাফুল ইসলামের মতো অনেক অভিবাসী। কিন্তু তারপরও তিনি দেশে ফিরতে চান না। অপেক্ষায় আছেন কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয় সূচকে বাংলাদেশ শীর্ষ দশটি দেশের কাতারে থাকায় এই খাতকে দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারের পাশাপাশি পুরো অভিবাসন খাতকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়েছেন রামরুর চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী। বিশেষ করে করোনা ভাইরাসের কারণে, বাসাবাড়ির কাজ, কৃষি, মেডিকেল, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে শ্রমিক নেয়ার হার বেড়েছে।

বাংলাদেশ যদি এই বাজারটা ধরতে এখন থেকেই যদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক তৈরি করে এবং এখনো যেসব শ্রমিক দেশের বাইরে আছে তাদের যেন ফেরত আসতে না হয় সে ব্যাপারে সরকার যদি কূটনৈতিক তৎপরতা চালায় তাহলে পরিস্থিতি খুব দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে আসবে বলে তিনি আশা করছেন।

তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘ভারত, পাকিস্তান, নেপালের মতো অনেক দেশ কিন্তু চেষ্টায় আছে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় বহির্বিশ্বে যে শ্রমিকের চাহিদা তৈরি হয়েছে সেটাকে ধরার। এখন তারা কোন দেশ থেকে শ্রমিক নেবে সেটা নির্ভর করবে কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর। বাংলাদেশের সেদিকেই মনযোগ দেয়া প্রয়োজন।’

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান মনে করছেন, যারা ইতিমধ্যে বিদেশে কাজ হারিয়ে ফিরে এসেছেন তাদের পুনরায় বিদেশে যাওয়ার সুযোগ বেশ সীমিত। সেক্ষেত্রে এই ফিরে আসা এই মানুষগুলোকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দ্রুত পুনর্বাসন করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করছেন।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

শেয়ার করুন