তনিমা তাসনিম অনন্যার জন্ম বাংলাদেশের নরসিংদী জেলায়। বাবার চাকরির সুবাদে তার শৈশব কেটেছে রাজধানী ঢাকায়। গৃহিণী মায়ের অধিকাংশ সময় কাটত রান্নাঘরে। পাঁচ বছর বয়সী তনিমাকে গল্পের ছলে মঙ্গলগ্রহে মহাকাশযান অবতরণ সম্পর্কে বলেছিলেন তার মা। মায়ের মুখে শোনা গল্পে মহাকাশ নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে অনন্যা। জ্যোতির্বিদ্যায় পড়াশোনার চিন্তা ভর করে তার মাথায়।
ঠিক দুই যুগ পর রহস্যেঘেরা ব্লাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের বেড়ে ওঠা এবং পরিবেশের ওপর এর প্রভাব নিয়ে পূর্ণাঙ্গ চিত্র এঁকে দেখালেন তিনি। আর তাতেই বাজিমাত! বিশ্বের সেরা ১০ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন তনিমা তাসনীম অনন্যা। ২৯ বছর বয়সী অনন্যা এখন সম্ভাবনামনায় জ্যোতির্পদার্থবিদ।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক সায়েন্স নিউজ অনন্যার এ সাফল্যের খবর প্রকাশ করেছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘এসএন টেন: সায়েন্টিস্ট টু ওয়াচ’ এর তালিকার শুরুতেই অনন্যাকে স্থান দিয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জনপ্রিয় গণমাধ্যমটি। যেখানে অনন্যার কাজকে ‘অসাধারণ গবেষণা’ বলে উল্লেখ করা হয়।
চলতি বছর এ তালিকায় স্থান পাওয়া প্রত্যেকেই ৪০ বা এর চেয়েও কম বয়সী। তারা প্রত্যেকেই নোবেল বিজীয়দের দ্বারা মনোনীত হয়েছেন।
সায়েন্স নিউজের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি অনন্যা সবচেয়ে ভারি কৃষ্ণগহ্বর আঁকতে সক্ষম হয়েছেন। সচিত্র গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন, মহাবিশ্বে কোথায় কীভাবে কৃষ্ণগহ্বর বেড়ে উঠছে এবং কীভাবে তারা পরিবেশকে প্রভাবিত করছে। তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এটি সম্পন্ন করেছেন।
অনন্যা জানিয়েছেন, ছোটবেলা থেকে আগ্রহের কারণে মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তবে বাংলাদেশে এ বিষয়ে তেমন পড়াশোনার সুযোগ না থাকায় তিনি বিদেশে যেতে আগ্রহের কথা পরিবারকে জানান। প্রথমে কোনোভাবেই বিদেশে পড়তে যেতে দিতে রাজি ছিল না তার পরিবার। তবে অনন্যার আগ্রহের কাছে হার মেনেছে তার বাবা-মা।
২০০৬ সালে অনন্যার বয়স যখন ১৫ ছুঁই ছুঁই, তখনি ইন্টারন্যাশনাল জেনারেল সার্টিফিকেট অব সেকেন্ডারি অ্যাডুকেশন কোর্স শুরু করেন তিনি। লক্ষ্য ছিল ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জন করে বিদেশে পাড়ি জমানোর। সেই মিশনেও বাজিমাত করে অনন্যা। সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে প্রথম হন তিনি। সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়েও। ফলে সহজেই স্কলারশিপে বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ মেলে। এরপরই ভিজিটিং স্টুডেন্ট হিসেবে যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে যান তিনি।
২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ার ব্রায়ান মাওর কলেজ থেকে স্নাতক করেন অনন্যা। পরে তিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পিএইচডি করেন। তনিমা বর্তমানে ডার্টমাউথ কলেজের একটি পোস্টডক্টোরালের গবেষণা সহযোগী।
গবেষণার পাশাপাশি তিনি বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী নারী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি পরামর্শদাতা নেটওয়ার্ক, ‘ওয়াই-স্টেম’ এর সহ-প্রতিষ্ঠা হিসেবে কাজ করছেন। যুক্ত ছিলেন নাসা ও সার্নের বেশ কিছু প্রজেক্টের সাথেও। বিজ্ঞান নিয়ে যখনই যেখানে তিনি সুযোগ পেয়েছেন, লুফে নিয়েছেন।
তবে ব্ল্যাক হোল তার অন্যতম আগ্রহের বিষয়। সায়েন্স নিউজকে অনন্যা বলেন, আমার মা স্বল্প শিক্ষিত ছিলেন। তবে খবরের কাগজ পড়ে যেটুকু বুঝতেন, রান্নাঘরে আমাকে তা গল্প করে শোনাতেন। আমি তখন বুঝতে পারি মহাবিশ্বে আরও অন্যান্য জগত রয়েছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমি জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়তে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। তবে আমার দেশে এ ধরনের সুযোগ ছিল না বললেই চলে। এজন্য আমাকে পরিবার ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে হয়।
তিনি আরও বলেন, বাবা-মাকে প্রতিজ্ঞা করে এসেছিলাম- বিদেশে গিয়ে কোনো পার্টিতে যাব না এবং মদপানও করব না। পরিবারের পক্ষ থেকে আমাকে অল-উইমেন স্কুলে ভর্তি হওয়ার শর্তজুড়ে দেয়া হয়। আমি সব মেনে দেশ ছেড়ে আসি। কারণ আমি শুধু পড়াশোনা ও গবেষণার চিন্তায় মগ্ন থাকতাম। অন্যদিকে আমার খেয়াল ছিল না।
তনিমা তাসনিম অনন্যার মতে মহাজগতের কাঠামো বুঝতে সবার আগে ব্লাকহোলগুলোকে জানতে হবে। তার সচিত্র মডেলে তিনি মহাজাগতিক দূরত্বের ব্লাকহোলগুলোকে পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করে দেখিয়েছেন।
অন্যন্যা বলেছেন, ব্লাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর গ্যালাক্সিতে শক্তি যোগালে তারার সৃষ্টি হয়। কখনও কখনও এটি গ্যাসও ছড়িয়ে দেয়।