নতুন বছরের নতুন প্রত্যাশা ।। ড. আতিউর রহমান

ড. আতিউর রহমান
ড. আতিউর রহমান। ফাইল ছবি

২০২০ সালের মতো এমন সর্বনাশা সংকটকাল মানবজাতির ইতিহাসে আগে কখনো আসেনি। এমনিতেই জলবায়ুর পরিবর্তনের চাপে পৃথিবী দিশাহারা। এর ওপর এই ভাইরাস আক্রমণে বিশ্বজুড়েই বেড়েছে অনিশ্চয়তা। তবু এত দ্রুত এই ভাইরাসের কয়েকটি টিকা আবিষ্কার এবং অন্তত দুটির প্রয়োগের খবরে বিশ্ববাসী বেশ খানিকটা আশাবাদী হয়ে উঠেছে। তবে এরই মধ্যে মহামারির দ্বিতীয় ঢেউটি সবাইকে কিছুটা অস্বস্তিতেও ফেলেছে। এমনি দোলাচলের মধ্যে এই দুর্যোগের বছরকে বিদায় জানালাম। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি আর মহামারিজনিত অর্থনৈতিক অচলাবস্থার একটি স্পষ্টতর চিত্রও আমরা দেখতে পাচ্ছি। সব শেষ হিসাব অনুসারে সারা বিশ্বে ১.৭ মিলিয়ন মানুষকে আমরা হারিয়েছি করোনায়। অর্থনৈতিক ক্ষতি আনুমানিক ১০ ট্রিলিয়ন ডলার। এই ক্ষতির রেষ শিগগিরই পূরণ হওয়ার নয়। সত্যি বলতে, মহামারি আসার আগেও বিশ্ব অর্থনীতি নানা কারণে হুমকির মুখে ছিল। রাজনৈতিক সংঘাত আর জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বিশ্বনেতৃত্বের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় প্রতিশ্রুতির অভাবও দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবে হাজির ছিল। তাই বিশেষজ্ঞরা আরেকটি মহামন্দার আশঙ্কা করছিলেন আগে থেকেই।

অস্বীকার করার উপায় নেই, এই দুর্যোগ বিশ্ব অর্থনীতির আন্তঃসংযোগ অনেকটাই দুমড়েমুচড়ে ফেলেছে। আর আমাদের অর্থনীতির বড় অংশ (রপ্তানি) এখন বহির্বিশ্বের চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাপী এই বিপর্যয় আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক অভিযাত্রায়ও দিয়েছে জোর ধাক্কা। মহামারির আগে এক দশকে আমরা দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্যের হার অর্ধেক কমিয়ে যথাক্রমে ২০ ও ১০ শতাংশের আশপাশে নামিয়ে এনেছিলাম। কিন্তু মহামারির ফলে দুটি হারই অন্তত ১০ শতাংশ করে বেড়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকোচনের মধ্যে আমাদের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক রয়েছে ঠিকই; কিন্তু মহামারি না থাকলে আমরা দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জনের কাছাকাছি নিশ্চয়ই এত দিনে পৌঁছে যেতে পারতাম।

universel cardiac hospital

আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের অভিযাত্রায় একটা ছেদ পড়েছে, এ কথা মেনে নিয়েও বলতে হবে, মহামারিজনিত অর্থনৈতিক অচলাবস্থা মোকাবেলায় আমরা সমতুল্য অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক ভালো করেছি। সম্প্রতি প্রকাশিত ব্লুমবার্গ কভিড-১৯ রেজিলিয়েন্স সূচকেও ৫৩টি দেশের মধ্যে করোনা প্রতিরোধে সাফল্যের বিচারে বাংলাদেশ চার ধাপ এগিয়ে স্থান করে নিয়েছে প্রথম ২০-এর মধ্যে। পেছনে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াকে। অন্যরা যখন অর্থনীতির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত, সে সময় এডিবি ও আইএমএফের মতো সংস্থাগুলো বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৪ থেকে ৬ শতাংশ হবে বলছে। আমরা মনে করি, বাস্তবে প্রবৃদ্ধি হবে আরো বেশি। এমনকি বারবার বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে কম আশাবাদী বিশ্বব্যাংকও তাদের মন বদলেছে। তাদের ‘সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস’ মহামারি মোকাবেলা, প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে দক্ষতার বিচারে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার সামনে রেখেছে বাংলাদেশকে।

এই সাফল্যের ভিত্তি এক দিনে তৈরি হয়নি। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের অভিযাত্রাটা শুরু করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন দেশের শাসনভার কাঁধে নিয়ে মাত্র সাড়ে তিন বছরে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করতে পেরেছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, দেশদ্রোহী ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে তাঁকে শারীরিকভাবে হারাতে হয়েছিল। স্বদেশ তখন চলতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উল্টো দিকে। ১৯৯৬-এ অনেক ত্যাগ ও সংগ্রামের পর দেশের দায়িত্ব নেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় দেশ আবার সঠিক পথে ফিরলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সামষ্টিক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা শুরু হয়। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত আবার এই অভিযাত্রায় ছেদ পড়ে দেশি-বিদেশি চক্রান্তে। তবে ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের এক অভাবনীয় উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে গেছে বাংলাদেশ।

১৯৭৫ থেকে ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ২৭৮ ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮৫৬ ডলারে। এই বৃদ্ধির ৭৩ শতাংশই হয়েছে গত ১০ বছরে। ১৯৯০ পরবর্তীকালে অর্থনীতির উদারীকরণের ফলে প্রবৃদ্ধির হার বাড়তে শুরু করলেও গত এক দশকের প্রবৃদ্ধির হার আগের চেয়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি। বিবিএসের তথ্য মতে, ২০০৭-০৮ পর্যন্ত গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের একটু বেশি। আর পরের ১০ অর্থবছরে এই অনুপাত প্রায় ৭ শতাংশ (২০১৮-১৯-এ প্রবৃদ্ধির হার প্রথমবারের মতো ৮ শতাংশ অতিক্রম করেছিল)। ১৯৭৬-এ বাংলাদেশ থেকে রপ্তানীকৃত পণ্যের মূল্য ছিল বার্ষিক মাত্র ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৯-এ এসে দাঁড়িয়েছে ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। অর্থাৎ পাঁচ দশকের কম সময়ে বেড়েছে প্রায় ৯৮ গুণ। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালেও এই পরিমাণ ছিল ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ১৯৭৬ সাল থেকে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হয়েছে বিগত এক দশকে।

এই অভাবনীয় প্রবৃদ্ধির সুফল সুষমভাবে বণ্টনের ক্ষেত্রেও আমরা বেশ খানিকটা সফল হয়েছি। প্রথমত, দ্রুত জিডিপি বাড়লে যতটা মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করা হয় গত এক দশকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের জনবান্ধব মনিটারি পলিসিকে কৃতিত্ব দিতেই হবে। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে জিডিপিতে কৃষির অবদান কমেছে, বেড়েছে শিল্প খাতের অংশ। তাতে গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ওপর খুব নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। গ্রামাঞ্চলে আয়ের ৬০ শতাংশ এখন আসছে অকৃষি উৎস থেকে। আর খাদ্য উৎপাদনেও প্রশংসনীয় অর্জন আমাদের রয়েছে। ১৯৭৫-৭৬ থেকে ১৯৮৯-৯০ অর্থবছর সময়কালে আমরা গড়ে বছরে ১৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করেছি। পরের দুই দশকে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল বছরে ২৪ মিলিয়ন মেট্রিক টনে। গত এক দশকে এই পরিমাণ আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে বছরে ৩৭ মিলিয়ন মেট্রিক টনে। কৃষি উৎপাদন সূচকে আমরা এখন চীন, ভারত ও ভিয়েতনামেরও ওপরে। আর অকৃষি কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকায় কৃষি মজুরিও বেড়েছে। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, আমাদের ভোগবৈষম্য সূচক অনেকটাই স্থিতিশীল ছিল মহামারির আগ পর্যন্ত। আর জীবনের আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হ্রাসে অর্জন এবং শিক্ষা সংস্কারে আমাদের অগ্রগতির সঙ্গে বিবেচনা করলে সহজেই বোঝা যায় কী কারণে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের রোল মডেল বলা হয়।

এসব অর্জনের ওপর ভিত্তি করে আমরা যখন আরো বড় স্বপ্ন দেখছিলাম, তখনই মহামারির আঘাত এসেছে। এত দিনের অর্জিত সামষ্টিক অর্থনৈতিক শক্তির ওপর ভিত্তি করে প্রধানমন্ত্রী দ্রুততম সময়ের মধ্যে জিডিপির ৪.৩ শতাংশের সমান ২১টিরও বেশি স্টিমুলাস প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। নিঃসন্দেহে এর মাধ্যমে জনসহমর্মী নেতৃত্বের নীতি সক্রিয়তার সন্ধান মেলে। এই নীতিকে তিনি বোধগম্য ভাষায় নিরন্তর জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছেও দিচ্ছেন। তবে এই প্যাকেজগুলোর বাস্তবায়নে, বিশেষ করে ছোট উদ্যোক্তাদের কাছে এসবের সুফল পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য অসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশীদারি আরো ১০ হাজার কোটি টাকার নয়া প্রণোদনা কর্মসূচি চালু করতে চাইছে সরকার। নতুন বছরে এটি হবে ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার। কৃষি, খুদে ও মাঝারি উদ্যোগ এবং সর্বোপরি সবুজ প্রবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই স্টিমুলাসগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে দ্রুততম সময়ে আমরা প্রবৃদ্ধির আগের ধারায় ফেরার ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারি। ২০২০ সালের সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো সে কথাই বলছে।

২০১৯-এর জুনে আমাদের রিজার্ভ ছিল ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে (৩১ শতাংশ বৃদ্ধি)। এর পেছনে প্রধানতম ভূমিকা রেখেছে রেমিট্যান্স। ২০২০ সালে এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। করোনা আসার আগেই ২ শতাংশ প্রণোদনা এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সহজে অর্থ প্রেরণের সুযোগ সৃষ্টি করার ফলেই এই প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিশ্ববাজারে স্থবিরতার কারণে আমাদের রপ্তানি আয় প্রাথমিকভাবে কিছুটা ঝুঁকির মধ্যে পড়লেও পরিস্থিতি আবার অনুকূল হতে শুরু করেছে। প্রণোদনার মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুরু থেকেই ‘বিজনেস কনফিডেন্স’ ধরে রাখতে চেয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন যেকোনো সংকটে তাঁর সরকারের সহায়তা বজায় থাকবে উদ্যোক্তাদের, শ্রমজীবী মানুষ ও কৃষকদের জন্য। এই বার্তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির ওপর। ২০২০-এর জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রপ্তানির পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে রপ্তানির চেয়ে ১ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক আরো জানিয়েছে, অক্টোবর ২০১৯-এর তুলনায় অক্টোবর ২০২০-এ টোটাল ডমেস্টিক ক্রেডিট বেড়েছে ১১ শতাংশের বেশি। বছরের শুরুতে তা ৮ শতাংশে নেমে এসেছিল। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ পরিস্থিতিও আশাব্যঞ্জক। আর সবচেয়ে বড় কথা, এখনো মূল্যস্ফীতি ধরে রাখা গেছে ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যেই। ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধি হয়নি অতটা। স্টিমুলাস বাস্তবায়ন এবং যথাযথ ফিসকাল পলিসির মাধ্যমে তাদের হাতে অর্থ পৌঁছানো গেলে টিকে থাকা নিয়ে আর সংশয় থাকবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক খুবই চেষ্টা করছে অর্থনীতিতে তারল্য বজায় রাখতে এবং ছোট উদ্যোক্তাদের কাছে প্রচলিত ও সৃজনশীল পথে প্রণোদনার ঋণ পৌঁছে দিতে। পাশাপাশি রাজস্ব খাতকেও তৎপর রাখার চেষ্টা করছেন প্রধানমন্ত্রী।

দ্রুতগামী অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ছেদ আর দুর্যোগ মোকাবেলায় সাফল্যের অভিজ্ঞতার মধ্যেই আসছে নতুন আরেকটি বছর। সামনের বছর যেমন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে, তেমনি নতুন সম্ভাবনাও আমাদের মনে আশা জাগাচ্ছে। যেমন—উপর্যুপরি বন্যায় আমন ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সরকারের খাদ্য কর্মসূচি বাস্তবায়নে আরো ১৩ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানির কথা শোনা যাচ্ছে। এ জন্য চাল আমদানির শুল্ক ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি আমনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার অতিরিক্ত সাত লাখ টন বোরো উৎপাদনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। করোনার ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ৩.১৯ শতাংশ। গত বছর ওই সময়ে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৯ শতাংশ। অক্টোবর ও নভেম্বরে রাজস্ব প্রবৃদ্ধির ধারায় গতি বেড়েছে। তবে আমরা আশা করছি, ডিজিটাইজেশনের সুফল নিয়ে তারা কর আহরণ দক্ষতা বাড়াতে সক্ষম হবে। এরই মধ্যে তার নমুনাও দেখা যাচ্ছে। যেমন—মোট রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক ধারা দেখা গেলেও আয়কর আহরণে সামান্য হলেও ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেছে (০.৪১ শতাংশ)। আরেকটি ভালো খবর হলো, দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের পালে ইতিবাচক হাওয়া লেগেছে। ‘এশিয়া ফ্রন্টিয়ার ক্যাপিটালে’র সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গেল বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সূচকের উত্থান (২৪.৪ শতাংশ) এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ। যে সাহস ও সংস্কারের সূত্রপাত এই বাজারের নয়া রেগুলেটররা দেখিয়ে চলেছেন তাকে সাধুবাদ জানাই। সর্বোপরি অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সবচেয়ে দরকারি যে বিনিয়োগ পরিবেশ, সেটি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমরা বহুদূর এগিয়ে এসেছি এত দুর্যোগের পরও। অবশ্যই বাস্তব কারণেই বৈদেশিক বিনিয়োগের পালে এ বছর তেমন হাওয়া লাগেনি। তবে আগামী বছর এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক রূপান্তরের সম্ভাবনা দেখা দেবে বলে আশা করছি। গত সপ্তাহে ঢাকায় নিয়োজিত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি তাই বাংলাদেশকে বিনিয়োগের জন্য আদর্শ জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ মেগা অবকাঠামো প্রকল্পের পাশাপাশি কর, কাস্টমস প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দ্রুত হ্রাসকরণের মাধ্যমে আসলেই বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে।

দুর্যোগে বঙ্গবন্ধু যেভাবে আমাদের পথ দেখিয়েছেন, তাঁর সুযোগ্য কন্যাও একইভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি আমাদের মাঝে জাগিয়ে তুলতে পেরেছেন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার মনোবল ও দক্ষতা। একই সঙ্গে তিনি সবুজ পুনরুদ্ধারের আশাবাদও ব্যক্ত করে চলেছেন। সম্প্রতি লন্ডনের বিশ্ববিখ্যাত পত্রিকা দ্য ফিন্যানশিয়াল টাইমসের এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন জলবায়ু সংকট মোকাবেলা করে এই বিশ্বকে ‘আরো সবুজ, পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ’ দেখতে চান। তাঁর এই প্রত্যাশা আমাদেরও প্রত্যাশা। তাই মহামারি মোকাবেলা করতে পারছি আর আশাবাদী হতে পারছি নতুন বছর নিয়ে। মহামারি মোকাবেলার এই অভিজ্ঞতা আমাদের আরো শক্তিশালী করেছে বলেই মনে করি। তাই আগামী বছর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে আমাদের অভিযাত্রা আরো বেগবান হবে, সেই প্রত্যাশা রাখছি। সবাইকে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর পাশাপাশি জানাচ্ছি নববর্ষের শুভেচ্ছা।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

dratiur@gmail.com

শেয়ার করুন