দক্ষিণ এশিয়ায় বাণিজ্যিক-কূটনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশকে পাশে পেতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তুরস্ক। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছে। আধুনিক মুসলিম বিশ্বে ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে ওঠা দেশটি বরাবরই ভারতীয়দের শত্রুভাবাপন্ন পাকিস্তানকে সমর্থন-সহযোগিতা দিয়েছে। এবার বাংলাদেশকেও সেই কাতারে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টায় নেমেছে তুরস্ক।
আজ শনিবার দ্য ইউরেশিয়ান টাইমসে ভারতীয় সাংবাদিক স্মৃতি চৌধুরীর একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভারতের সর্বকালীন মিত্র বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্কের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা চলছে।
সম্প্রতি দুইদিনের সফরে ঢাকায় এসেছিলেন তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু। সেখানে তুর্কি দূতাবাসের নতুন ভবন উদ্বোধন করেছেন তিনি।
সফরকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে তুর্কি মন্ত্রীর। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধিতে যা যা দরকার, সবই করতে রাজি তুরস্ক।
এদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং তরুণ জনসংখ্যার ভূয়সী প্রশংসা করে মেভলুত কাভুসোগলু জানিয়েছেন, তুরস্কের ‘এশিয়া এনিউ’ উদ্যোগের অন্যতম প্রধান অংশীদার বাংলাদেশ।
বৈঠকের বিষয়ে ড. মোমেন স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নির্ধারিত এজেন্ডায় না থাকলেও বৈঠকে দুইপক্ষের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তুর্কি মন্ত্রী এ বিষয়ে তাদের মতামত জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, তুরস্কের মন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন, তার দেশ বিশ্বমানের সামরিক সরঞ্জাম উত্পাদন করছে এবং সেগুলো বিক্রিতে কোনও ধরনের শর্ত আরোপ করে না।
আব্দুল মোমেন বলেন, এ বিষয়ে তাত্ক্ষণিক কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বিষয়ক কেনাকাটার উৎসে বৈচিত্র্য আনতে চায়।
২০১৩ সালে তুরস্কের কাছ থেকে অটোকার কোবরা সাঁজোয়া যান কিনেছিল বাংলাদেশ। এরপর ২০১৭ সালে ডেল্টা ডিফেন্স নামে একটি তুর্কি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলারের বিনিময়ে ৬৮০টি হালকা সাঁজোয়া যান কেনার অর্ডার দেয়া হয়। ২০১৯ সালে আরেক তুর্কি প্রতিষ্ঠান রকেটসানের কাছ থেকে মাঝারিপাল্লার রকেট লঞ্চার কেনার অনুমতি দিয়েছে ঢাকা।
১৯৭৪ সালে তুরস্ক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। তবে ২০১২ সালে বাংলাদেশে ’৭১ সালে যুদ্ধপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামী নেতাদের বিচার শুরু হলে এর নিন্দা জানায় আঙ্কারা। এঘটনায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে কিছুটা ভাঁটা পড়েছিল।
তবে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জাতিসংঘ, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) মতো জায়গাগুলোতে বাংলাদেশকে বরাবরই সমর্থন দিয়েছে তুরস্ক।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর বাংলাদেশই তুরস্কের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। অবশ্য গত কয়েক বছর ধরে দিল্লি-আঙ্কারা সম্পর্ক খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করায় ভারত সরকারের কড়া সমালোচনা করেছে তুরস্ক। কাশ্মীর ইস্যুতে তারা বরং পাকিস্তানেরই পাশে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি জাতিসংঘেও উপস্থাপন করায় তুরস্কের ওপর বেশ ক্ষিপ্ত ভারত।
তুরস্ক বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন পশ্চিমাদের প্রাধান্য দিয়েছে। ক্ষমতার শেষবেলায় এসে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। তারা রাশিয়ার কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র সুরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ কেনায় এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভারতীয় থিংক ট্যাঙ্ক বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সহযোগী গবেষক ড. যথার্থ কোচিয়ার বলেন, পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল বৃদ্ধি এবং মুসলিম বিশ্বে চলমান আধিপত্যের লড়াই তুরস্ককে তার ঐতিহ্যবাহী মিত্র, পশ্চিমা এবং প্রতিবেশী ইসলামী দেশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তারা এশিয়ার মতো কম সংকটপূর্ণ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের বাজি ধরছে।