ডোনাল্ড ট্রাম্প বিদায় নিলেন। আগামীকাল ২০ জানুয়ারি জো বাইডেন আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিচ্ছেন। তাতে কি আমেরিকাসহ পশ্চিমাজগতে নতুন যুগের সূচনা হবে? অনেক পশ্চিমা মিডিয়া সেই আশাই প্রকাশ করেছে। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। বেশির ভাগ পশ্চিমা মিডিয়া এখন বলছে, ‘Trump was the worst president ever’ অর্থাৎ ট্রাম্পের চেয়ে নিকৃষ্ট প্রেসিডেন্ট আর কেউ হতে পারেন না। ট্রাম্প অবশ্যই মানুষ হিসেবে নিকৃষ্ট, প্রেসিডেন্ট হিসেবেও নিকৃষ্ট ছিলেন। কিন্তু তাঁর চেয়ে নিকৃষ্ট প্রেসিডেন্ট আর কখনো ছিল না, এ কথাটা সত্য নয়। তাহলে আসল সত্য কী?
ট্রাম্পের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল চিন্তাশীল লেখক ক্রিস্টোফার কল্ডওয়েল ট্রাম্পের চেয়েও নিকৃষ্ট প্রেসিডেন্ট বলেছেন জর্জ বুশ জুনিয়রকে। বলেছেন, বুশ দু-দুটি যুদ্ধ শুরু করেছেন। দুটিতেই জয়ী হতে পারেননি। বিশ্ব অর্থনীতিকে আরো চূড়ান্ত ভাঙনের মুখে রেখে গেছেন। কল্ডওয়েলের কথার সঙ্গে আরো কথা যোগ করা যায়। ট্রাম্প অহরহ মিথ্যা কথা বলতেন। কিন্তু জর্জ বুশের মতো বিরাট মিথ্যা কথা বলে অন্যায় ও অবৈধ যুদ্ধ বাধাননি। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের হাতে বিশ্ব ধ্বংসের মারণাস্ত্র আছে, এই ডাহা মিথ্যা কথা ট্রাম্প বলেননি। জাতিসংঘকে অমান্য করে এই বিশ্ব সংস্থাটিকে অকেজো করে ফেলেননি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে বলা হয়, তিনি আমেরিকান গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন। কথাটা সত্য। কিন্তু আমেরিকান গণতন্ত্রকে বলিদানের যূপকাষ্ঠে টেনে এনেছিলেন ট্রাম্পের আগের কয়েকজন প্রেসিডেন্টই। ট্রুম্যান, রিগান, ক্লিনটন, বুশ-পিতা-পুত্র সবাই। ট্রাম্প বলিদানের কাজটা করেছেন মাত্র। তাঁর আগের প্রেসিডেন্টদের ছিল এলিট চেহারা, সভ্যভব্য আচরণ। মার্কিন এলিট ক্লাসের সমর্থন ছিল তাঁদের পেছনে। তাঁরা নিন্দিত হননি; কিন্তু নিন্দিত হয়েছেন ট্রাম্প। কারণ তাঁর চেহারা এলিটসুলভ নয়। কথাবার্তায় ছিল না এলিট ক্লাসের সভ্যতাভব্যতা। তাই তাঁকে যেকোনো নামে ডাকা যায়। কেউ তাতে আপত্তি জানাবে না।
ট্রাম্পের আগের কয়েকজনের চরিত্র বিচার করে দেখা যাক। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান—একজন আদর্শ প্রেসিডেন্ট। মানবসভ্যতার ইতিহাসের অত্যন্ত কলঙ্কজনক কাজ হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে প্রথম অ্যাটম বোমা ফেলার আদেশ দিয়েছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি—তিনি পরাজিত ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তিতে সাহায্য করার জন্য ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন—ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারির জন্য নিজ দেশে অভিশংসনে পড়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তানের হানাদারদের অস্ত্র জুগিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন—যিনি অক্সফোর্ডে ছাত্র থাকাকালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা করে শোভাযাত্রা করেছিলেন। তিনিই প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর লিবিয়ায় চোরাগোপ্তা বোমা হামলা চালিয়ে প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফির ছয় বছরের শিশুকন্যাসহ অসংখ্য নর-নারী হত্যা করেন। জোড়া বুশ (পিতা-পুত্র)—গণতন্ত্র ও মানবতার বিরুদ্ধে হামলা চালনাকারী। মধ্যপ্রাচ্যে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করার নায়ক। কয়েকজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁদের আমলে অন্যায়ভাবে ইরাকের বিরুদ্ধে ১২ বছর ধরে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে ১৭ লাখ শিশু ও নারীর প্রাণহানি ঘটিয়েছিলেন।
এই তালিকার সব প্রেসিডেন্টের কীর্তি উল্লেখ করা হয়নি। ট্রাম্পের আমলে আমেরিকার এই পাপের ঘরা পূর্ণ হয়েছিল। ট্রাম্প তাঁর ঢাকনাটা মাত্র খুলে দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে তাঁর জয়লাভের কারণ ছিল। বহুকাল ধরে আমেরিকার সাদা ওয়ার্কিং ক্লাস ও এলিট ক্লাসের দ্বারা উপেক্ষিত ও অত্যাচারিত হচ্ছিল। কালোদের মতো অত অত্যাচারিত না হলেও সাদা ওয়ার্কিং ক্লাস এলিটদের দ্বারা সর্বত্র উপেক্ষিত হওয়ায় ক্ষুব্ধ হচ্ছিল। তাদের এই ক্ষোভের আগুনে কেরোসিন ঢালে কালো বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট হওয়া। গোটা সাদা ওয়ার্কিং ক্লাসের মধ্যে এই ভয় ঢোকে আমেরিকা কালোদের দেশ ছিল, তা আবার কালোদের হাতে চলে যাচ্ছে।
ক্রিস্টোফার কল্ডওয়েল বলেছেন, সাদা ওয়ার্কিং ক্লাসের মনের এই ভয়টাই কাজে লাগিয়ে ট্রাম্প হিলারিকে নির্বাচনে পরাজিত করেন। এই পরাজয় আমেরিকার এলিট ক্লাসের পরাজয়। ট্রাম্পের ওয়ার্কিং ক্লাসের মতো কথাবার্তা, আচার-আচরণ, আমেরিকায় আবার শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য ফিরিয়ে আনার তত্ত্ব ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এই ওয়ার্কিং ক্লাসকে খুশি করেছে। ট্রাম্প কৌশলে তাঁর আমেরিকা ফার্স্ট থিওরিতে বর্ণবাদ ঢুকিয়েছেন। তাদের অত্যাচারিত হওয়ার মূলে যে শ্রেণিবৈষম্য কাজ করেছে, সেটা তাদের বুঝতে না দিয়ে বোঝানো হয়েছে, তাদের সব দুঃখ-দুর্দশার কারণ বহিরাগত কালোরা। সাদা এলিট ক্লাসও এই প্রচারণা দ্বারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করেছে। হিটলারও এভাবে জার্মানিতে ত্রিশের মন্দায় পীড়িত জার্মান ইয়ুথ ও ওয়ার্কিং ক্লাসকে তাদের সব দুঃখের জন্য দায়ী ইহুদিরা এই তথ্য মিলিয়ে মূলত তাদের সাহায্যেই ক্ষমতা দখল করেছিলেন। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প তার অন্যথা করেননি।
কিন্তু গতবারের নির্বাচনে ক্লিনটন পরিবারবিরোধী যে সাদা এলিট ক্লাসের সমর্থন ট্রাম্প পেয়েছিলেন, এবার তা পাননি। যদিও তাঁর ওয়ার্কিং ক্লাস ভোটবাক্স ছিল অটুট। ট্রাম্প পরাজিত হওয়ায় এই ওয়ার্কিং ক্লাসের সমর্থকরা কংগ্রেস ভবনে এসে হাঙ্গামা করার মাধ্যমে তাদের ক্ষোভ প্রকাশে দ্বিধা করেনি। কিন্তু হিটলারের জার্মানি ছিল একটি মহাযুদ্ধে পরাজিত দেশ। দেশটির ছিল পরাজিত সেনাবাহিনীও। হিটলারের ক্ষমতা দখলের পেছনে ছিল তাদের সমর্থন। ট্রাম্প সেনাবাহিনীর সমর্থন পাননি। আর আমেরিকাও যুদ্ধে পরাজিত দেশ নয়।
মার্কিন গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছিল বহু আগে। ট্রাম্প তাঁর কফিনে শেষ পেরেকটি মেরেছেন মাত্র। মার্কিন এলিট ক্লাস প্রশাসনে ওয়ার্কিং ক্লাসের ডমিনেন্স সহ্য করতে রাজি নন। তাই কফিন থেকে গণতন্ত্রের মৃতদেহ তুলে এনে তাতে আবার প্রাণদানের দুরূহ দায়িত্ব পড়েছে জো বাইডেনের ওপর। হোয়াইট হাউসকে ওয়ার্কিং ক্লাস-কালচার থেকে মুক্ত করে স্ট্যাচু অব লিবার্টির গায়ে আবার হোয়াইটওয়াশ করার দায়িত্বও পড়েছে বাইডেনের ওপর।
জো বাইডেন তা পারবেন। তিনি নিজেও এলিট ক্লাসের লোক। ব্যক্তিগত জীবনে অনেক ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হলেও একজন ভালো প্রশাসক ও সংগঠক। ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে সিনেটর নির্বাচিত হওয়ায় মার্কিন রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতাও প্রচুর। তিনি সঙ্গে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেয়েছেন কমলা হ্যারিসকে। তিনি মিশ্র বর্ণের মহিলা। মার্কিন রাজনীতির সাদা-কালো দুটি দিক সম্পর্কে ভালো জানেন। তাদের যুক্ত প্রচেষ্টা হবে ট্রাম্পের পূর্ববর্তী আমেরিকার মানবিক ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সহজসাধ্য কাজ তা মনে হয় না।
জো বাইডেন বলেছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম কাজ হচ্ছে করোনা মহামারির কবল থেকে আমেরিকাকে মুক্ত করা। তাঁর দ্বিতীয় কাজ, তাঁর মতে, ট্রাম্পের আমল ছিল আমেরিকার অন্ধকার যুগ। এই অন্ধকার যুগ থেকে আমেরিকাকে আলোয় ফেরানো। প্রথম কাজ মহামারি ঠেকানোও হবে একটি দুঃসাধ্য কাজ। ট্রাম্প ইচ্ছাকৃতভাবে করোনা ঠেকানোকে গুরুত্ব দেননি। ফলে চার লাখের ওপর মানুষ এরই মধ্যেই মারা গেছে। এটা তো গেল সংকটের একটা দিক। অন্যদিকে ট্রাম্প গোটা ইউরোপের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন করে গেছেন। ব্রেক্সিট সমস্যা থেকে শুরু করে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি একলা চলার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। চীনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক এখন শত্রুতার। তাইপের ওপর থেকে সব বিধি-নিষেধ তুলে দিয়ে তিনি চীনকে আরো উসকানি দিয়ে রেখে গেছেন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলছেন, অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র দুই নীতির ক্ষেত্রেই বাইডেন হয়তো ওবামা নীতিতে ফিরে যাবেন। তবে চীনের ব্যাপারে তিনি হয়তো ট্রাম্পের নীতিতেই অবিচল থাকবেন। কারণ চীনের সঙ্গে আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক। এই দ্বিতীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে না পারলে ধনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক বিশ্বে আমেরিকার নেতৃত্ব ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।
ধনবাদী গণতন্ত্রের জগতে বাইডেন কি আমেরিকার আগের আধিপত্য ফিরিয়ে আনতে পারবেন? অনেকে তা বিশ্বাস করেন না। ট্রাম্পের শক্তির যে মূল উৎস বর্ণবাদী সাদা ওয়ার্কিং ক্লাস—ট্রাম্প ক্ষমতা থেকে সরে গেলে তারা পৌত্তলিক বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর ফ্যাসিবাদী আমেরিকা ফার্স্ট তত্ত্ব ছড়াতে এবং এই ফ্যাসিবাদের একটি শক্তিশালী স্তম্ভ আমেরিকায় খাড়া হবে। এই স্তম্ভের সঙ্গে যুদ্ধ করে জেতাটাই হবে জো বাইডেনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। গণতন্ত্রের বর্ম পরিধান করে তাঁকে ফ্যাসিবাদ ও বর্ণবাদের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। তিনি শত্রুর সঙ্গে আপস করলে জার্মানির হিডেনবার্গ ও ইতালির ভিক্টর ইমানুয়েলের মতো গণতান্ত্রিক আমেরিকার ভাবমূর্তি রক্ষায় ব্যর্থ হবেন। আর আপস না করলে নিক্সন ও কেনেডির মতো মাথায় আততায়ীর তরবারি ঝুলবে। অনেক পারিবারিক ও রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি পার হয়ে এসে বাইডেন এখন শক্ত মনের মানুষ। দেখা যাক, তাঁর নেতৃত্ব আমেরিকা ট্রাম্পের অন্ধকার যুগ পার হতে পারে কি না?
লন্ডন, সোমবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২১