তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন দীর্ঘ সাংগঠনিক তৎপরতা, লড়াই-সংগ্রাম এবং নানান ধরনের প্রতিকূলতা অতিক্রম করে। এই লম্বা সময়ে তাঁর সহযোগী হিসেবে যিনি ছিলেন সবচেয়ে কাছের মানুষদের একজন, নির্বাচিত হবার দুদিন পরেই তাঁর ঘনিষ্ঠ ওই মানুষটির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলো এক অফিসের কর্মকর্তাকে অপদস্ত করার। অভিযোগের সত্যতা পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়েই, তিনি বিভিন্ন দপ্তরে ঘনিষ্ঠ মানুষটির নামোল্লেখ করে চিঠি লিখলেন ‘… আমার কেউ না। … যদি কোনো অফিসে আমার আত্মীয় পরিচয় দেয় কিংবা
আমার নাম ভাঙিয়ে সুবিধা নিতে চায়, তাকে যেন গুরুত্ব দেওয়া না হয়।’ পরে জানা গেল অভিযোগকারীর কিছু দাপ্তরিক অনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে অভিযুক্ত ব্যাক্তি কয়েকজন দলীয় কর্মীর সঙ্গে আলোচনা করেন। এদের একজন অতি উৎসাহী হয়ে অভিযোগকারীর সঙ্গে তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা-কাটাকাটি করলে সে নিজেকে রক্ষা করার জন্য সাংসদের নিকট উল্টো তাঁর ঘনিষ্ঠজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। পরে বিভাগীয় তদন্তে অভিযোগকারীর অনৈতিকতার সত্যতা মিলে।
সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতা ওর একবছর বয়সী সন্তানসহ স্ত্রীকে লন্ডনে রেখে দেশে চলে এসেছিল প্রিয় নেতার নির্বাচনে প্রচারণা চালানোর জন্য। নির্বাচনে বিজয়ী নেতার সফরসঙ্গী হয়ে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবর জেয়ারত করে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ছাত্রলীগের সাবেক ওই নেতাটির। এই ঘটনার কয়েকমাস মাস পর ওই নেতার ছোট ভাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষকে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করে। এরপর ছোট ভাইটি গ্রেপ্তার হয় পুলিশের হাতে। অনেক কাকুতি-মিনতি করেও ওই ছেলের মা সাংসদকে দিয়ে পুলিশকে বলাতে পারেননি ছেলেকে ছাড়ার জন্য। সাংসদ সুস্পষ্টভাবে বলে দিলেন, ‘অধ্যক্ষ সাহেবের কাছে যান। তাঁর কাছে ছেলের হয়ে ক্ষমা চান। তিনি যদি ক্ষমা করে দেন। তাহলেই আমি পুলিশকে বলব। এটাই আপনার ছেলেকে রক্ষার একমাত্র উপায়।’
নীতি-নৈতিকতার ব্যাপারে নেতার এমন কাঠিন্য, হাল-আমলের রাজনীতিকদের মধ্যে বিরল। এটা নিকটজনের কাছে তাঁকে অপ্রিয় করলেও সাধারণ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, তাঁর যে কর্মীটি টুঙ্গিপাড়া থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল, যদি সেই কর্মীর পরিবারের জন্য কোনো সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন হতো তিনি নিজেকে উজাড় করে দিতেন। ওই পরিবারটির তা দরকার হয়নি। তাই বলে কোনো অপরাধে সমর্থন দেবেন না। এমন অনেক ঘটনা আমার জানা আছে।
২০০৪ সালের কথা। বন্যায় সারাদেশ তলিয়ে গেছে। আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পরিস্থিতিও ভয়াবহ। আমি তখন দৈনিক ‘প্রথম আলো’র জেলা প্রতিনিধি। এমন ভীতিকর সময়ে তিনি আমাকে ফোন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সামগ্রিক বন্যাপরিস্থিতি, ত্রাণতৎপরতা ইত্যাদি নানা বিষয়ে জানতে চান। রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন বিএনপি-জামাতের জোট। ব্যক্তিগতভাবে তখন তিনি জোট সরকারের আক্রোশের শিকার হয়ে ৯৬ সালে ‘জনতার মঞ্চ’ গঠনের ‘অপরাধ’সহ একাধিক প্রতিহিংসামূলক মামলার আসামি। এমন নাজুক অবস্থায়ও তিনি সরকারি কলেজ শিক্ষিকা স্ত্রী এবং বন্ধু-বান্ধবদের কাছে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় ছুটে আসেন।
যে কোনো দুর্যোগে বিত্তহীন, এমন কী নিম্নবিত্ত মানুষ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে সাহায্য সহযোগিতা পান। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় পড়ে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা। ২০০৪ সালের বন্যায় তিনি নিজ এলাকার নিম্নবিত্ত লোকজনকে ত্রাণ দেয়ার পাশাপাশি খুঁজে খুঁজে এমন অনেককে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন, যাঁরা মুখ খুলে সাহায্য চাইতে পারেন না। ওই দুর্যোগে আমার জ্ঞাতসারে বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় সম্পৃক্ত দশ-বারো জন ব্যক্তিকে নীরবে অর্থ সাহায্য করেছেন।
প্রতিকূল সময়ে ঘুরে দাঁড়াবার শিক্ষা হয়তো মুক্তিযুদ্ধ থেকেই অর্জন করেছেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করতে যখন যান, তখন তিনি ঢাকা কলেজ ছাত্রসংসদের প্রথম নির্বাচিত জিএস ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে আহত হয়েছেন। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন। বাকশাল গঠনের পর ছাত্রলীগ-ছাত্রইউনিয়ন মিলে জাতীয় ছাত্রলীগের যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেখানে ২১ সদস্যের একজন ছিলেন তিনি। জাতীয় ছাত্রলীগের ওই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন শেখ শহীদুল ইসলাম, যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন সাবেক ডাকসু ভিপি মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর প্রতিকূল সময়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। প্রকৃত অর্থে ছাত্রলীগ পূনর্ঘটন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ মিছিল-মিটিং সংঘটনে তিনি ছিলেন নেতৃত্বস্থানীয় দুই-তিন জনের একজন। ডাকসু নির্বাচনে তিনি জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, ভিপি প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
পরে তিনি চলে যান প্রশাসনে। সেখানেও তাঁর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। ছিয়াশির সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিবের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। জনতার মঞ্চের মূল সংগঠকদের একজন। পরে ছিয়ানব্বইয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০০১ সালের প্রতিকূল সময়ে মামলা-হামলা মাথায় নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নিজের গ্রাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিনাইরে বঙ্গবন্ধুর নামে কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই কলেজটি এখন জেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সেই সময় কলেজটি এমপিওভুক্তি পায়নি। অথচ তাঁর দল যখন ক্ষমতায় এল তিনি নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেতা সাবেক সাংসদ ও প্রতিমন্ত্রী হারুন আল রশীদের মায়ের নামে তাঁর নিজ গ্রাম নরশিংসারে প্রতিষ্ঠিত বেগম নূরুন্নাহার কলেজ এবং সুহিলপুর গ্রামে হারুন আল রশীদের নিজের নামে গড়া কলেজকে এমপিওভুক্তি পেতে সহযোগিতা করেন। শুধু তাই নয়, হারুন আল রশীদের অনুরোধে কলেজ দুটির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন তিনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া -৩ নির্বাচনী এলাকার অন্তত আটটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষকের এমপিও না থাকায় তাদের বেতনের সংস্থান করতেও হয় তাঁকেই। তাঁর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিজয়নগরে চম্পকনগর ও পূর্বাচল কলেজ নামে আরো দুটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গত কয়েকবছরের মধ্যে। বহু ছাত্রের পড়াশোনার খরচ দেন তিনি। তাঁর সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়াকে আমি চিনি, যে কিনা রীতিমতন চড়াও হয় মানুষটির ওপর।
এতক্ষণ যাঁর কর্মতৎপরতার বর্ণনা দিলাম তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনের তিনবারের নির্বাচিত সাংসদ রবিউল আলম মো. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আপামরসাধারণের রবিউল ভাই। আজ তাঁর জন্মদিন।
শুভ জন্মদিন রবিউল ভাই।