‘ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) হাজী মোহাম্মদ সেলিমের ছেলে ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩০ নম্বর ওয়ার্ড (বরখাস্ত) কাউন্সিলর ইরফান সেলিমের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট করতে অসৎ উদ্দেশ্যে কে বা কারা উদ্ধার করা পিস্তলটি তার বাসায় রেখে যায়। ইরফান সেলিমের এলাকায় তার বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র বহন বা প্রদর্শন তথা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে অংশগ্রহণের কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’
গত ৫ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর হাকিম আশেক ইমামের আদালতে অস্ত্র মামলায় ইরফান সেলিমকে অব্যাহতির সুপারিশ করে দেয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে (চার্জশিট) এসব কথা উল্লেখ করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, চকবাজার থানার পরিদর্শক মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন। প্রতিবেদনটি গ্রহণের বিষয়ে শুনানির জন্য ৮ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য রয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে করা অস্ত্র মামলার ঘটনাস্থল ২৬ নং চাঁন সর্দার দাদাবাড়ী। এই বাসার মালিক বর্তমান ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম। মামলার আসামি ইরফান সেলিম তার পুত্র। ইরফান সেলিম বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর। মামলার বাদী এজাহার ও জব্দ তালিকায় মামলার ঘটনাস্থল ইরফান সেলিমের ব্যক্তিগত শয়ন কক্ষে উল্লেখ করেন। তবে মামলাটি সরেজমিনে তদন্তকালে সাক্ষ্য প্রমাণে দেখা যায় যে, মামলার ঘটনাস্থলটি ইরফান সেলিমের ব্যক্তিগত শয়ন কক্ষ নয়। সেটি ছিল একটি অতিথি কক্ষ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইরফান সেলিমের পরিবার একটি রাজনৈতিক পরিবার হওয়ায় ওই অতিথি কক্ষে বিভিন্ন আগন্তুক অতিথি, রাজনৈতিক নেতাকর্মী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতেন। ইরফান সেলিম দীর্ঘ সময় বিদেশে থেকে পড়ালেখা করেছেন। তিনি ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কানাডায় বিবিএ পড়া শেষ করেছেন। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট করার জন্য এবং সমাজে তার সম্মান ক্ষুন্ন করাসহ সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য অসৎ উদ্দেশ্যে কে বা কারা মামলার জব্দকৃত পিস্তলটি অভিযুক্ত ইরফান সেলিমের অতিথি কক্ষে রেখেছেন। ইরফান সেলিমের এলাকায় তার বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র বহন বা প্রদর্শন তথা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে অংশগ্রহণের কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তদন্ত কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেছেন, মামলার জব্দকৃত আলামত পিস্তলের বিষয়ে মামলার বাদী এজাহারে এবং জব্দ তালিকায় কার অস্ত্র এবং কার দেখানো মতে জব্দ হয়েছে তা উল্লেখ করেননি। অস্ত্র মামলার গোপনে ও প্রকাশ্য তদন্তে গৃহীত সাক্ষ্য প্রমাণে অভিযুক্ত ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে অত্র মামলার অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয় নাই। বিধায় ইরফান সেলিমকে মামলার দায় হতে অব্যাহতি দানের প্রার্থনা করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হলো।
গত ২৫ অক্টোবর নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমদ খান মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন। এ সময় হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের গাড়িটি তাকে ধাক্কা মারে। এরপর তিনি সড়কের পাশে মোটরসাইকেলটি থামিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়ান এবং নিজের পরিচয় দেন। তখন গাড়ি থেকে ইরফানের সঙ্গে থাকা অন্যরা একসঙ্গে তাকে কিল-ঘুষি মারেন এবং মেরে ফেলার হুমকি দেন। তার স্ত্রীকে অশ্লীল ভাষায় গালগালও করেন তারা।
এরপর ২৬ অক্টোবর সকালে ইরফান সেলিম, তার বডিগার্ড মো. জাহিদুল মোল্লা, এ বি সিদ্দিক দিপু এবং গাড়িচালক মিজানুর রহমানসহ অজ্ঞাত দু-তিনজনকে আসামি করে ধানমন্ডি থানায় মামলা করেন ওয়াসিফ আহমদ খান। ওই দিনই পুরান ঢাকার বড় কাটরায় ইরফানের বাবা হাজী সেলিমের বাড়িতে দিনভর অভিযান চালায় র্যাব। এ সময় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত মাদক রাখার দায়ে ইরফান সেলিমকে এক বছর কারাদণ্ড দেন। ইরফানের দেহরক্ষী মো. জাহিদকে ওয়াকিটকি বহন করার দায়ে দেন ছয় মাসের সাজা।
এরপর ২৮ অক্টোবর র্যাব-৩ এর ডিএডি কাইয়ুম ইসলাম বাদী হয়ে চকবাজার থানায় ইরফান সেলিম ও দেহরক্ষী জাহিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদকের পৃথক চারটি মামলা করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ২৬ নং চাঁন সর্দার দাদাবাড়ি ভবনের ৪র্থ তলা তল্লাশি করে দরজার ডান দিকে পশ্চিম রুমের ভেতরে আসামি জাহিদুল মোল্লা (৩৫) এর দেহ তল্লাশিকালে তার নিকট হতে একটি কালো রংয়ের বিদেশি পিস্তল, ৪০৬ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, দুইটি মোবাইল উদ্ধার করা হয়। এরপর বাদী তার সঙ্গীয় ফোর্সসহ ওই ভবনের ৪র্থ তলার এক নম্বর আসামি মোহাম্মদ ইরফান সেলিমের (৩৭) ব্যক্তিগত শয়ন কক্ষে প্রবেশ করে তল্লাশিকালে একটি বিদেশি অবৈধ পিস্তল, গুলি, ম্যাগাজিন ও বিয়ার পেয়ে বিধি মোতাবেক জব্দ তালিকামূলে জব্দ করে আসামিদের নিয়ে ওই ভবনের ৫ম তলার একটি রুমে প্রবেশ করে একটি এয়ারগান, কালো রংয়ের দুইটি ছোরা, একটি চাইনিজ কুড়াল, বিদেশি হকিস্টিক, এক বোতল বিদেশি মদ, ৩৮টি কালো রংয়ের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ব্যাটারি এবং চার্জারসহ ওয়াকিটকি সেট, ক্যামেরাযুক্ত ড্রোন উদ্ধার করেন, যা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের উপস্থিতিতে ও তার নির্দেশে জব্দ করা হয়।
- আরও পড়ুন >> দেশে উদ্ভাবিত প্রথম পিসিআর টেস্ট কিটের অনুমোদন
এজাহারে উল্লেখ করা হয়, উদ্ধারকৃত অবৈধ অস্ত্র, গুলি এবং মাদক সংক্রান্তে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা সন্তোষজনক জবাব কিংবা কোনো বৈধ কাগজপত্র প্রদর্শন করতে পারেননি। বিধায় আসামিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে আলাদা আলাদা মামলা দায়ের করা হয়েছে। আসামি ইরফান সেলিম ব্যাটারি, চার্জার, ওয়াকিটকি সেট অবৈধভাবে হেফাজতে রেখে ব্যবহারের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম তাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং মাদক রাখায় এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও একমাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন।